‘নিখুঁত’ তালিকা এবং বিএনপি ‘খোঁজা’

মাদকবিরোধী অভিযানের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করছেন না কেউই। তা সত্ত্বেও অভিযানের কর্ম-পরিকল্পনা, উদ্দেশ্য-লক্ষ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে প্রথম দিন থেকেই। ‘বন্দুকযুদ্ধে’ প্রতিরাতে নিহতের ঘটনা জনমনে প্রশ্ন তৈরি করেছে। হঠাৎ করে কেন এই অভিযান? ‘বন্দুকযুদ্ধে’ কেন ‘মাদক ব্যবসায়ী’দের মৃত্যু?
বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড বন্ধ, মাদক ব্যসায়ীদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে শুক্রবার শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে মানবন্ধন। ছবি: স্টার

মাদকবিরোধী অভিযানের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করছেন না কেউই। তা সত্ত্বেও অভিযানের কর্ম-পরিকল্পনা, উদ্দেশ্য-লক্ষ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে প্রথম দিন থেকেই। ‘বন্দুকযুদ্ধে’ প্রতিরাতে নিহতের ঘটনা জনমনে প্রশ্ন তৈরি করেছে। হঠাৎ করে কেন এই অভিযান? ‘বন্দুকযুদ্ধে’ কেন ‘মাদক ব্যবসায়ী’দের মৃত্যু?

বিভিন্ন সংস্থার করা তালিকা অনুযায়ী চলছে অভিযান। আজকের আলোচনার মূল বিষয়- অভিযানের তালিকা।

১. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৩০ মে সংবাদ সম্মেলনে যা বলেছিলেন তা হুবহু উদ্ধৃত করছি, ‘আমরা কিন্তু অপারেশনে খুব হঠাৎ করে যাইনি। হয়তো আপনাদের মনে হতে পারে যে হঠাৎ করে শুরু করেছে। ঘটনা কিন্তু তা নয়। দীর্ঘদিন থেকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে, দেখা হয়েছে। কারা আনে। কোন কোন স্পট থেকে ঢুকছে। কোথা থেকে তৈরি হচ্ছে। কী হচ্ছে।’ (৩০ মে, সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী)

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য উদ্ধৃত করা প্রয়োজন মনে করছি, ‘আপনাদের (বিএনপি) মধ্যেও কে, কোথায় আছে। কে রাঘব বোয়াল, কে চুনোপুঁটি, তা খোঁজা হচ্ছে। মাদক ব্যবসার সঙ্গে কারা জড়িত।’(প্রথম আলো,৬ জুন ২০১৮)

এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে প্রশ্ন আসে-

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী ‘দীর্ঘদিন কাজ করে’ তালিকা করার পর, এখন নতুন করে ‘বিএনপিতে মাদক ব্যবসায়ী খোঁজা’ হচ্ছে কেন?

২. মাদক চোরাচালানিদের তালিকা প্রসঙ্গে ২০১৫ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি অনুষ্ঠানে কিছু কথা বলেছিলেন। সরকারের করা একাধিক তালিকায় উখিয়া-টেকনাফের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির নাম থাকা বিষয়ক এক প্রশ্নের উত্তরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘অনেকের নামই আসে। কিন্তু আমরা তাঁর সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাইনি...অনেকে ইমোশনালি নাম দিয়ে দেয়।’ (প্রথম আলো, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫)।

তার মানে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা এবং মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকায় ‘ইমোশনালি’ নাম দিয়ে দেওয়া যায়?

আবার র‍্যাবের ডিজি বলেছেন, তালিকা ‘নিখুঁত’।

একটা যুক্তি এক্ষেত্রে আসতে পারে যে, এটা তো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ২০১৫, মানে তিন বছর আগের বক্তব্য।

এবার অভিযান শুরুর পরও, তালিকার এক নম্বরে থাকা বদি বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন ‘অভিযোগ আছে, প্রমাণ নাই।’

কাউন্সিলর একরামুলের মৃত্যুর পর কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় সাবেক সাংসদ ও টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী, বদির উপস্থিতিতে বলেছেন ‘আপনি ২০০৮ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই এদেশে ইয়াবা পাচারের কাজ শুরু করেছেন। আপনি গত ১০ বছরে গোটা দেশটাকে ইয়াবায় ছেয়ে দিয়েছেন।’ (কালের কণ্ঠ, ১৯ মে)

৩. বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, মাদকবিরোধী অভিযানের নামে সরকারবিরোধী বা তাদের নেতা-কর্মীদের হত্যা করা হচ্ছে। সম্প্রতি বিএনপি এবং ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণা করা শুরু হয়েছে। বিএনপি বলতে চাইছে, কমিটিতে যাদেরকে স্থান দেয়া হয়েছে, তাদেরকে মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে তালিকায় ঢোকানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

এখন পর্যন্ত মাদকবিরোধী অভিযানে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়া প্রায় ১৪২ জনের মধ্যে বিএনপির এমন অভিযোগের সত্যতা সামনে আসেনি। একজনের পরিবর্তে আরেকজন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার ঘটনা জানা গেছে। যা ‘দু একটি ভুল’ বলে মানুষের জীবনকে অত্যন্ত হালকা করে দেখার চেষ্টা করেছেন ওবায়দুল কাদের। এখন ‘বিএনপি খোঁজা’ বিষয়ক যে কথা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলছেন, তা এক ধরনের শঙ্কা তৈরি করছে। অনেকটা বিএনপির বক্তব্যের ভিত তৈরি করে দিচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী তালিকায় অনেকে ‘ইমোশনালি নাম ঢুকিয়ে দেয়’। ‘অনেকে’ মানে কে, কারা? কেউ এসে বলল, আর দেশের গোয়েন্দা সংস্থা তালিকায় নাম ঢুকিয়ে দিল?  মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর তালিকায় নাম ঢুকিয়ে দিল? যে তালিকার ভিত্তিতে অভিযান-‘বন্দুকযুদ্ধ’ মানুষের মৃত্যু, সেই তালিকা করার প্রক্রিয়া এমন?

৪. তালিকা বিষয়ক এসব বক্তব্যের পরে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়-

ক. প্রধানমন্ত্রী, র‍্যাব, পুলিশ যে ‘নিখুঁত’ তালিকার ভিত্তিতে অভিযান ‘বন্দুকযুদ্ধে’র কথা বলছেন, সেই তালিকা নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রীও সন্দেহ- সংশয়মুক্ত নন।

খ. দীর্ঘ অনুসন্ধান করে যে তালিকা করা হয়েছে, তাতে শীর্ষ স্থানে থাকা বদির নাম, মন্ত্রীদ্বয়ের বক্তব্য অনুযায়ী তথ্য- প্রমাণের ভিত্তিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তালিকার ৫ নম্বরে থাকা মং মং সেন, ৬ নম্বরে থাকা মুজিবুর রহমান, ৭ নম্বরে থাকা শুক্কুর, এরা বদির ভাই- আত্মীয়। অভিযানের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত তারা প্রকাশ্যে টেকনাফেই ছিল। বিষয়টি কি এমন যে, তাদের নামও তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি? কারণ প্রকাশ্যে থাকা অবস্থায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে দেখা যায়নি।

গ. ‘প্রমাণ ছাড়া’ কারও নাম যদি তালিকার এক নম্বরে স্থান পেতে পারে, নিচের দিকের মাদক চোরাচালানিদের বাহক বা বিক্রেতাদের নাম প্রমাণের ভিত্তিতে তালিকায় স্থান পেয়েছে, তা কী বিশ্বাসযোগ্য?

৫. তালিকায় ত্রুটি থাকলে জরুরি ভিত্তিকে, সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার। বিএনপির নতুন কমিটি ঘোষণার সময়, ‘বিএনপিতে মাদক ব্যবসায়ী খোঁজা’- ভুল বার্তা দিতে পারে। কমিটি ঘোষণার পরে যদি তারা মাদক ব্যবসায়ী হয়ে থাকে, কমিটি ঘোষণার আগেও তারা মাদক ব্যবসায়ীই ছিল। কমিটি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তারা মাদক ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেনি। পূর্বে তাদের নাম তালিকায় না থাকার অর্থ, হয় তারা মাদক ব্যবসায়ী নয় অথবা তালিকা সঠিকভাবে করা হয়নি। বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনায় নেওয়া দরকার। সবচেয়ে বেশি বিবেচনায় নেওয়া দরকার, মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার নামে মানুষ হত্যা করে, পৃথিবীর কোনো দেশ সফল হয়নি।

‘বন্দুকযুদ্ধে’ মৃত্যু মাদক নির্মূলে তো নয়ই, নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও সাফল্য আসার সম্ভাবনা নেই। সন্ত্রাসী- চোরাচালানি সবারই বিচার- শাস্তি প্রত্যাশিত, বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড নয়।

Comments