‘এলোমেলো চুল আর ললাটের ভাঁজ’

“সেই দিনটির কথা কোনোদিনও ভুলবো না। আমার মনের খুব গভীরে গেঁথে আছে। থেকে যাবে চিরদিন”- কথাটা বলে জানালা দিয়ে দূরের দিকে চোখ রাখলেন তিনি। চোখের মধ্যে আলাদা রকমের মুগ্ধতা। চোখ না ফিরিয়েই বললেন, “সেই দিনটি হলো ১৯৮৪ সালের ৮ জানুয়ারি।”
“আমার ‘এলোমেলো চুল আর ললাটের ভাঁজ’ গানটি প্রথম বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়েছিল”- কথাটি বলতে বলতে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী কনক চাঁপা।
কবিদের হয়তো এমন হয়। গান গাইলেও ভেতরে ভেতরে একজন কবি বাস করেন মনের খুব ভেতরে। “আরে ধুর আমি কবি নই, আমি লিখি আমার অনুভব। চাওয়া-পাওয়া, না পাওয়া, ব্যক্তিগত অনুভব লিখি।”
একটি দোয়েল ডেকে উঠল জানালার ওপাশে। স্পষ্ট শোনা গেল সেই ডাক। জানালায় চোখ ভাসিয়ে দিয়ে উচ্চারণ করলেন, “আমাদের ধর্মে পুনর্জন্ম নেই, বিশ্বাসও করে না। তারপরও আমি আরেকটি জীবন চাই। যেখানে আমার জীবনটিকে নিজের মতো করে কাটাব। আমি কৃষকের বউ না, কৃষক হয়ে জন্মাতে চাই।”
কোনো অভিমান বা রাগ কি পুষে রেখেছেন কনক চাঁপা? তা না হলে এমন করে বললেন কেন? একটু পর সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল।
বললেন, “গাছগাছালি আমার অনেক প্রিয়। মাঝে মাঝে শস্যদানা মাটিতে পুঁতে দেই, সেখান থেকে গাছ হতে দেখলে আমার অনেক আনন্দ হয়। ভাবি মাটির কী শক্তি! আমার জমি কিনে চাষবাস করতে ইচ্ছে করে।”
রোদটা এসে কনক চাঁপার মুখের ওপর পড়ে। আশ্চর্য সুন্দর লাগে মুখটা। আপন মনে বলতে থাকেন, “এই ইট-কাঠের জীবনে হাঁপিয়ে উঠি। জীবনটা ইট-কাঠের মধ্যে কাটেনি। আমার বাবার বাড়ি মাদারটেক। বাসার সামনে শীতলক্ষ্যার খাল ছিল। জোয়ার-ভাটা ছিল। আমার আব্বা আমার গান আর প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটাতেন। এখন আর সে রকম নেই। ইটের বস্তি হয়ে গেছে। খুব কষ্ট হয়।”
কথা বলতে বলতে একটু দম নিলেন তিনি। জোরে জোরে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিলেন কয়েকবার। এর মধ্যে আজ বাবা ভর করেছেন। ঘুরেফিরে বাবার কথাই বলছেন। “একজন দক্ষ শ্রমিক যেভাবে কাজ করেন, আমিও তাই করি। জুতো কালি করা থেকে কাপড় ইস্ত্রি করা সবকিছুই জানি। পা দিয়ে ধান শুকাতে জানি। আমার বাবা নিজে কাপড় কিনে এনে জামা বানিয়ে দিতেন। স্বভাব কবি ছিলেন তিনি। লিখতে, আঁকতে পারতেন। একজন সব্যসাচী আমার বাবা। তারই মেয়ে আমি।”
একটু থেমে বললেন, “আব্বা বলতেন, যখন যা করবে পুরো মনোযোগ দিয়ে করবে। আমি যখন গান করি, তখন আমি ক্লান্ত থাকি না। বলি না আমার মুড নেই। গান করব না। খুব সচেতন থাকি। গান আমার কাছে দায়িত্ব বলে মনে হয়।”
“ছোটবেলায় আমার গানের খাতায় তিনি স্বর্গীয় হাতে লিখে দিতেন। সেই খাতাগুলো আমি পরম মমতায় ছুঁয়ে দিই। আব্বা জীবন্ত হয়ে ওঠেন। মুহূর্তেই বলে ওঠেন- ‘মাগো, আমার গানের পাখি শোন।’ উফ…”- চোখ ছুঁয়ে জল ছলছল করছে কনক চাঁপার। আকাশেও মেঘ জমেছে। একটু পরই হয়তো বৃষ্টি নামবে। তার আগেই চোখ দুটি ভিজে গেল তার। স্মৃতি আজ ভর করেছে ভীষণ করে। স্মৃতি বৃষ্টি হয়ে ঝরছে সারাদিন।
“পাঠ্যবইয়ের ফাঁকে ফাঁকে বাড়তি কিছু বই চোখের পলকে পড়ে ফেলতাম। ‘বেগম’ পত্রিকা আমার মনে ভালোবাসার এক দ্বার উন্মোচন করে দিল। তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, নজরুল, ফররুখ আহমেদ, সৈয়দ মুজতবা আলী, সত্যজিৎ রায়, সমরেশ মজুমদার এদের বইয়ের সঙ্গে পরিচিত হলাম। কিছু বুঝতাম, কিছু বুঝতাম না।”
“একটু একটু করে আমার ভেতরে তৈরি হলো জীবনবোধ। বই না পড়লে সেই বয়স থেকে এই জীবনবোধ আমার মধ্যে তৈরি হতো না।”
“অনেক পরে আমার সুফিয়া কামাল, জসীমউদ্দীন, সৈয়দ শামসুল হক, শামসুর রাহমান, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, ইমদাদুল হক মিলনের লেখার সঙ্গে পরিচয় হয়। তাদের লেখা আমাকে ঋদ্ধ করেছে। জীবনের নানাবিধ বিষয় আমাকে শিখিয়েছে বই। নূপুরের শব্দের চেয়ে বইয়ের পাতা খোলার শব্দ আমার কাছে প্রিয়।”
“ঈদ এলে যত টাকার শাড়ি কিনি, তত টাকার বই কিনি। বই পড়ার কারণে জীবনে অনেক খারাপ অভ্যাস আমাকে ছুঁতে পারেনি। পরনিন্দা, সাজগোজ, পরচর্চা নিয়ে সময় কাটাতে হয় না। এই ডিজিটাল সময়েও বই পড়ি। আমার মা ছিলেন ব্রিটিশ কাউন্সিলের গ্রন্থাগারের সদস্য।”
বৃষ্টি থেমে গেছে একটু আগে। জানালা দিয়ে এক টুকরো নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে। কনক চাঁপা উঠে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়ালেন। এক ঝলক শীতল হাওয়ায় ঘরভর্তি হয়ে গেল। একজন শিল্পী সঠিকভাবে গান শিখলে যে কোনো অবস্থায় গান গাইতে পারবেন। সেটি নদীর ধার, লেন কিংবা বন্ধ ঘর- যাই হোক না কেনো। গান গাইতে তার কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা না। একজন শিল্পীর আত্মবিশ্বাস থাকলে যে কোনো জায়গায় যে কারো সঙ্গে গান গাইতে পারবেন।
“ভীষণ স্পষ্টবাদী মানুষ আমি। সরল-সোজা কথা বলি। নতুনদের অনেকের গান ভালো লাগে। কিন্তু অটো টিউনার থেকে তাদের বের হয়ে আসতে হবে”- একটু রাগ-বিষাদ, অভিমান যেন ছড়িয়ে পড়ল। “জয়নুল আবেদীনের ছবির সামনে গিয়ে দাঁড়ালে একটু অন্যরকম মনে হবে। যা ক্যালেন্ডার কিংবা অন্য কোথাও পাবেন না।” একটু হেসে উঠলেন কনক চাঁপা। বৃষ্টি শেষে মেঘ চিরে বেরিয়ে আসা রোদ্দুরের মতো।
“সফলতা হলো মানুষের কাছে পরিচিতি পাওয়া। এটিই সবচেয়ে বড় সফলতা। গাড়ি, বাড়ি এসব কিন্তু বড় সফলতা নয়। আমার কয়টা গান মানুষের মনের মধ্যে থাকল, এটিই আমার সফলতা। গানগুলোই আমার অনুভব। আমার মতো পাওয়া।”
“যখন স্কুলে পড়ি। স্কুল থেকে এসে গান শুনতাম। গানের মিউজিকসহ সবকিছু মুখস্থ ছিল। রেডিওতে গান শুনতাম। সিডি ছিল না। ফেরদৌসী রহমান, খুরশীদ আলম, রুনা লায়লার গান মিউজিকসহ আমার মুখস্থ থাকত। জীবনের অনেক সময় একটু একটু করে উন্মোচিত হচ্ছে। নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয় না। নদী তার পানি নিয়েই গতিপথ পরিবর্তন করে।”
তিনবার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন কনক চাঁপা। সিনেমার গানে তার এই অর্জন। ঘরের শোকেসে সাজানো রয়েছে পুরস্কারগুলো। কাছে গিয়ে সেগুলো ছুঁয়ে দেখলেন। হয়তো গানগুলোকেই ছুঁয়ে দেখলেন তিনি।
“সব পেলে তো মৃত্যু হয়। জীবনে যতটা দিয়েছি। তার চেয়ে অনেক বেশি শ্রোতারা আমাকে দিয়েছেন। ‘যে প্রেম স্বর্গ থেকে আসে’ গানের সঙ্গে তারা নাচেন। নেচে এসে আমাকে জননী বলে ছবি তোলার ইচ্ছা প্রকাশ করে। এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে।”
“পৃথিবীর পথে আমি হাঁটছি নিরন্তর। চলছি তো চলছি। হেঁটেই যাচ্ছি। চলার পথে কত আলপথ পেরিয়ে এলাম। হোঁচট খেলাম। চোরাকাঁটা বিঁধল আমার গেরুয়াতে। একতারাটা হাত থেকে ঘাসের বিছানায় রেখে চোরাকাঁটা ছাড়ালাম।”
“আমার জীবনসঙ্গী বাউল। গানে সুর বাঁধেন। তার নাম মঈনুল ইসলাম খান। আমার বাঘমামা। এই নামেই ডাকি তাকে। আমাকে গভীরভাবে জড়িয়ে রেখেছেন চারদিক থেকে। আজীবন এমন করে জড়িয়ে রাখুক। এভাবেই আমার জীবন চলতে থাকুক-” ধীরে লয়েই কথাগুলো বলে সাক্ষাতকার শেষ করছেন তিনি।
Comments