চিকিৎসাহীন তরিকুল ঢাকার পথে

ছাত্রলীগের হাতুড়িপেটা ও লাঠির আঘাতে গুরুতর আহত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তরিকুল ইসলামকে ঢাকায় নেওয়া হচ্ছে। আজ রোববার সকালে তরিকুলকে নিয়ে একটি অ্যাম্বুলেন্স ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়।
গত কয়েকদিন তরিকুলের যেখানে চিকিৎসা হয়েছে সেই বেসরকারি রয়াল হাসপাতালে গিয়ে গতকাল দেখা যায়, পায়ের আঙুল থেকে উরু পর্যন্ত ব্যান্ডেজ, মাথার বাম পাশে আটটি সেলাই নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় পড়ে ছিলেন তরিকুল। বিছানায় পাশ ফিরে শোয়ার পর্যন্ত শক্তি নেই শারীরে। পা সটান রেখে পিঠের পেছন দিকে হাত রেখে মাঝে মাঝে একটু হেলান দেওয়ার চেষ্টা, আবার শোয়া—এভাবেই গত তিন দিন কেটেছে তার।
নিজের অবস্থা সম্পর্কে তরিকুল বলছিলেন, ‘নড়াচড়া করলেই ভাঙা হাড়ে এত যন্ত্রণা হয়, মনে হয় যেন সূচ ফুটছে।’ গত ২ জুলাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে রাস্তায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বেধড়ক পেটায় তাকে। হাতুড়ি দিয়ে তার ডান পায়ের দুটি হাট ভেঙে দেওয়া হয়। ধারণা করা হচ্ছে, হাতুড়ির আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মেরুদণ্ড।
এই অবস্থার মধ্যেই গত বৃহস্পতিবার রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র ধরিয়ে দেওয়া হয় তরিকুলকে। সেদিন বিকেলে রাজশাহী নগরের লক্ষ্মীপুর এলাকার বেসরকারি রয়াল হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। তরিকুলকে যেদিন এই হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় সেদিন একবার ডাক্তার এসে কিছু পরীক্ষা করতে দিয়েছিলেন। এর পর থেকে গতকাল শনিবার রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত আর কোনো ডাক্তার তাকে দেখেননি। তবে নার্সরা সার্বক্ষণিক তার খেয়াল রেখেছেন। এই বেসরকারি হাসপাতালে তরিকুলের যে ধরণের আঘাত তার চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও নেই।
তরিকুল বলছিলেন, ‘কি এক কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়েছি। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পেলাম না। এখন বেসরকারি হাসপাতালেও ডাক্তার দেখছে না।’
তরিকুলের বোন ফাতেমা বেগম ও বন্ধুরা জানান, ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালের একজন চিকিৎসকের সঙ্গে অনলাইনে তরিকুলের ব্যাপারে কথা হয়েছে। এক্স-রে রিপোর্ট ও অন্যান্য পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে তিনি বলেছেন, এখনই তরিকুলের ভাঙা পায়ে সার্জারি করা প্রয়োজন। ফাতেমা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য রোববার [আজ] তরিকুলকে তারা ঢাকায় নিয়ে যাবেন। তরিকুলের বন্ধুদেরও অভিযোগ, ‘রাজশাহীতে তরিকুল ভালো চিকিৎসা পাচ্ছে না।’
গতকাল বিকেল ৩টায় যখন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে তরিকুলের দেখা হয় তখন তিনি দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন। তার থালায় ছিল ছোট মাছের তরকারি, সবজি আর ডাল আর অল্প একটু ভাত। খাওয়া শেষ হওয়া মাত্রই বমি করে ফেলেন তিনি। খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে নার্সরা ছুটে আসেন। আবার বমি হলে তাদেরকে ডাকতে বলে চলে যান তারা।
বন্ধুরাই এখন পালা করে তরিকুলের সঙ্গে থাকছেন। যে-ই তাকে দেখতে আসছে সাধ্যমত অল্প কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করছে। অন্যদের কাছ থেকেও অল্প কিছু সহযোগিতা নেওয়ার চেষ্টা করছেন তার বন্ধুরাই। এভাবেই চিকিৎসা চলছে তরিকুলের।
তার এক বন্ধু মঞ্জুরুল ইসলাম বলছিলেন, বিভিন্ন পরীক্ষা করতেই ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। এখন তাদের কাছে আর তেমন টাকাও নেই। সামনের দিনগুলোতে কিভাবে চিকিৎসা চলবে সেই চিন্তায় তারা এখন দিশেহারা।
হাসপাতালের একজন কর্মচারী জানান, পুঠিয়া হেলথ কমপ্লেক্সের অর্থোপেডিক সার্জন সাঈদ আহমেদের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন তরিকুল। ফোনে যোগাযোগ করা হলে দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, রাত সাড়ে ৮টার পর তিনি তাকে দেখতে যাবেন। এর এক ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরও না আসায় তাকে আবার ফোন করা হলে তিনি বলেন, কিছুক্ষণ আগেই তিনি তার চেম্বারে তরিকুলের টেস্টের রিপোর্ট দেখেছেন। পরে তিনি তরিকুলকে দেখতে আসবেন।
ডা. সাঈদ বলেন, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়ার পর থেকে তরিকুলের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। সর্বশেষ এক্স-রে রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে তরিকুলের ভাঙা হাড় যেভাবে থাকার কথা সেখান থেকে কিছুটা সরে গেছে। এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে আনা নেওয়া করায় এমনটা হয়েছে বলে তার ধারণা।
তিনি বলেন, হাত দিয়ে ধরে তার ভাঙা হাড়গুলো সঠিক অবস্থানে আনার চেষ্টা করবেন তারা। এভাবে সম্ভব না হলে আগামী দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে সেখানে অস্ত্রোপচার করতে হবে। এছাড়া এক্স-রে রিপোর্টে তরিকুলের মেরুদণ্ডেও কিছু সমস্যা দেখা যাচ্ছে। রাজশাহী মেডিকেলে থাকার সময় এটি ধরা পড়েনি।
‘তরিকুল বলছে, তার পিঠে তীব্র ব্যথা হচ্ছে। কিন্তু এক্স-রে রিপোর্ট দেখে সমস্যাটি বোঝা যাচ্ছে না। নিশ্চিত হওয়ার জন্য তার মেরুদণ্ডের এমআরআই ও সিটি স্ক্যান করতে বলেছি।’
এর আগে ড. সাঈদ জানিয়েছিলেন, তরিকুলের ভাঙা হাড় পায়ের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গিয়েছিল। এই ক্ষতটা সেরে গেলে দুই সপ্তাহ পর পায়ে অস্ত্রোপচার করার প্রয়োজন হবে। এছাড়াও তার মাথাতেও মারাত্মক আঘাত লেগেছে। অস্ত্রোপচার করতে হলে এই ক্ষতগুলো থেকে সেরে ওঠা প্রয়োজন।
কোটা সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভের সময় গত ২ জুলাই তরিকুলকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গেটের সামনে রাস্তায় ঘিরে ধরে পেটায় ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন মিলে যখন লাঠি নিয়ে তরিকুলকে পেটাচ্ছিল তখন আব্দুল্লাহ আল মামুন লোহার হাতুড়ি দিয়ে তার পিঠে ও পায়ে আঘাত করে। কাঠের উপর যেভাবে পেরেক পোঁতা হয়, সেভাবে তরিকুলের শরীরে আঘাত করছিল হাতুড়ি দিয়ে।
তরিকুল এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক। তিনি ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র। তার বাড়ি গাইবান্ধায়। তিন ভাইবোনের মধ্যে তরিকুল দ্বিতীয়।
লাঠি- হাতুড়ির আঘাতে যন্ত্রণায় কাতরানো তরিকুলকে পুলিশ ও কয়েকজন সাংবাদিক রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে।
তরিকুলের অবস্থা সম্পর্কে তখন হাসপাতালটির অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগের প্রধান এমএকে শামসুদ্দিন বলেছিলেন, তার ভাঙা হাড় জোড়া লাগতে অন্তত তিন মাস সময় লাগবে। তবে এর তিন দিন বাদেই ছাড়পত্র দিয়ে দেওয়া হয় তরিকুলকে। এর পরই তরিকুলের বন্ধুবান্ধবরা ধরা ধরি করে একটি ভ্যানে করে লক্ষ্মীপুর এলাকার রয়াল হাসপাতালে ভর্তি করেন।
তরিকুলের বোন বলেন, গোবিন্দগঞ্জে তার ভাইয়ের উপযুক্ত চিকিৎসা সম্ভব না। তাছাড়া তার বাবা মা দুজনেই অসুস্থ। ছেলে মেয়েদের পড়ালেখার খরচ মেটানোর পর চিকিৎসা করানোর সঙ্গতিও নেই তাদের।
তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগের লোকজন বাড়িতে গিয়ে বাবা-মাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে গেছে। তারা জিজ্ঞাসা করেছে আমরা জামায়াত-শিবির করি কি না। আমরা কোনোদিন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না।’
Comments