বেলজিয়ান ফুটবলারের অবিশ্বাস্য যাত্রার গল্প

মাত্র আট বছর আগেও তিনি ছিলেন একজন পোস্টম্যান। জীবিকার জন্যে গ্রামের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত দিনভর কঠোর পরিশ্রম করে লোকের চিঠি বিলি করতেন। সেই থমাস মুনিয়ের এখন বেলজিয়ামের জার্সি গায়ে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালের মঞ্চে। জীবন যদি ঘুরে দাঁড়ানোর অবিশ্বাস্য মঞ্চ হয়, তবে নিঃসন্দেহে সেই মঞ্চের মনকাড়া গল্পটি এই বেলজিয়ান ডিফেন্ডারের।
Thomas Meunier
বেলজিয়ামের অনুশীলনে থমাস মুনিয়ের। ছবি: রয়টার্স (ফাইল)

মাত্র আট বছর আগেও তিনি ছিলেন একজন পোস্টম্যান। জীবিকার জন্যে গ্রামের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত দিনভর কঠোর পরিশ্রম করে লোকের চিঠি বিলি করতেন। সেই থমাস মুনিয়ের এখন বেলজিয়ামের জার্সি গায়ে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালের মঞ্চে। জীবন যদি ঘুরে দাঁড়ানোর অবিশ্বাস্য মঞ্চ হয়, তবে নিঃসন্দেহে সেই মঞ্চের মনকাড়া গল্পটি এই বেলজিয়ান ডিফেন্ডারের।

মুনিয়েরের বয়স তখন মাত্র ১৮ বছর। জীবন ধারণের জন্য টাকা দরকার, আর সেই টাকা উপার্জনের জন্য পোস্টম্যানের চাকরি নেন মুনিয়ের। সূর্য ওঠার আগেই ভোর পাঁচটায় শুরু হয়ে যেত মুনিয়েরের দিনভর খাটনির চাকরি। শহরের বাড়িগুলো কাছাকাছি থাকে বলে চিঠি পৌঁছে দেয়ার কাজটা কিছুটা হলেও সহজ হয়। কিন্তু গ্রামে একেকটি বাড়ির মধ্যকার দূরত্ব বেশি থাকায় মুনিয়েরকে পরিশ্রম করতে হতো আরও বেশি। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে চিঠি পৌঁছে দিতেন তিনি।

কিন্তু মুনিয়েরের গল্পটা এমন হওয়ার কথা ছিল না। দুই হাজার অধিবাসী সম্পন্ন সেইন্ট-ওডে নামক ছোট্ট এক গ্রামে জন্ম নেয়া মুনিয়েরের গোটা পরিবারটাই ছিল ফুটবল পাগল। মুনিয়েরের বাবা ছিলেন পেশাদার ফুটবলার। মুনিয়েরের দাদুও ছিলেন ফুটবল পাগল। অন্য আর দশটা বাচ্চার মতো তার জীবনও কাটছিল পড়াশোনা আর ফুটবল নিয়ে। কিন্তু মুনিয়েরের জীবনে পালাবদলের শুরু ১২ বছর বয়সে, যখন তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়। মুনিয়ের ও তার বোনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেন তার মা।

দুই সন্তানকে মানুষ করতে অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন মুনিয়েরের মা। মুনিয়েরের আজ এই পর্যায়ে আসার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান যদি কারোর থেকে থাকে, তো সেটা তার মায়ের। তিনজন মানুষের খাবার জোটানোর জন্য নিজের সবটা দিয়ে খেটেছেন তিনি। ভোর ছয়টা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত কাজ করতেন নার্স হিসেবে। এরপর আরও কিছু অতিরিক্ত উপার্জনের আশায় লোকের বাসায় বাসন ধোঁয়ার কাজও করেছেন। দুর্দশা বেড়ে যায় আরও, যখন মুনিয়েরের দাদা-দাদীও এসে যোগ দেন এই পরিবারে। অতিরিক্ত দুইজন মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে রাত নয়টায় বাসায় ফেরার পর আবার রেস্টুরেন্টেও কাজ করতে যেতেন মুনিয়েরের মা।

কিন্তু তাও ছেলের স্বপ্নে এতটুকু আঁচ লাগতে দেননি। ১৩ বছর বয়সী মুনিয়েরকে ভর্তি করে দেন বেলজিয়ামের অন্যতম বড় ক্লাব স্ট্যান্ডার্ড লিয়েজেতে। বাড়ির দূরে গিয়ে বোর্ডিংয়ে থেকে খেলার চেষ্টা করেছেন মুনিয়ের, কিন্তু মন ভরাতে পারেননি ক্লাব কর্তৃপক্ষের। ফলাফল, দুই বছর পর ক্লাব দরজা বন্ধ করে দেয়।

মুনিয়ের হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু হাল ছাড়েননি তার মা। তৃতীয় বিভাগের ক্লাব ভার্টনের কর্তৃপক্ষের কাছে অনেক বলে কয়ে মুনিয়েরের ট্রায়ালের ব্যবস্থা করেন, প্রথম ম্যাচেই দশ গোল করে ক্লাবে সুযোগ পেয়ে যান।

কিন্তু খেলার সুযোগ পেলেও টাকা পয়সা বেশি পাচ্ছিলেন না মুনিয়ের। ততদিনে স্কুলের পাটও চুকিয়ে ফেলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার মতো সামর্থ্য নেই, আবার ফুটবল খেলেও টাকা আসছে না। ১৮ বছরের মুনিয়ের তাই পেট চালানোর জন্য পোস্টম্যানের চাকরি নিতে হলো। চার বছর পোস্টম্যান হিসেবে কাজ করেছেন, এরপর আরেকটু ভালো বেতনের আশায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন গাড়ি প্রস্তুতকারক কোম্পানিতেও!

ভার্টনে খেলার সময় মুনিয়েরের বেশ কিছু গোলের ভিডিও ভাইরাল হয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেই ভিডিওতে মুনিয়েরের স্কিল দেখে মুগ্ধ হয়ে বেলজিয়ামের সবচেয়ে বড় ক্লাব ব্রাগ ১ লাখ ইউরো দিয়ে চুক্তি করে মুনিয়েরের সাথে। এই এক চুক্তিই বদলে দিলো মুনিয়েরের ভাগ্য, সেটা যেমন আর্থিকভাবে, তেমনি মাঠের পজিশনের দিকেও। ছোটবেলায় স্ট্রাইকার হিসেবে খেলা মুনিয়ের তাই এখন বেলজিয়াম দলের রাইট ব্যাক।

ক্লাব ব্রাগেতে নিয়মিত খেলেছেন তিনি, কখনোই শুরুর একাদশ থেকে বাদ পড়েননি। মুনিয়েরের এমন ধারাবাহিক পারফরম্যান্স চোখ এড়ায়নি বেলজিয়াম জাতীয় দলের নির্বাচকদের। যার ফল হিসেবে ২০১৩ সালে প্রথমবারের মতো জাতীয় দলে ডাক পান মুনিয়ের।

এরপর বাকি গল্প তো সবাই জানেন। বেলজিয়ান ক্লাব ব্রাগ থেকে ২০১৬ সালে চার বছরের চুক্তিতে যোগ দেন ফরাসি ক্লাব পিএসজিতে। ক্লাবের পাশাপাশি জাতীয় দলেরও অবিচ্ছেদ্য অংশ এখন তিনি। জীবনের চূড়ান্ত কঠিন রুপ দেখে আসা মুনিয়েরের জন্য এমন ভবিষ্যৎই হয়তো লিখে রেখেছিলেন ফুটবল বিধাতা!

 

 

Comments

The Daily Star  | English

Yunus's 'Reset Button' call was not about erasing Bangladesh's proud history: CA office

He meant resetting the software, not the hardware created by 1971 Liberation War, statement says

2h ago