যেন সিনেমাকেও হার মানায় রাকিটিচের প্রেমের গল্প
হলিউড সিনেমায় প্রেমের গল্প তো অনেক দেখেছেন। তবে ক্রোয়েশিয়ান ফুটবলার ইভান রাকিটিচের জীবনে আছে এমন এক প্রেমের গল্প, যা অনেক সিনেমার গল্পকেও হার মানায়।
সময়টা ২০১১। রাকিটিচের বয়স তখন সবে ২১। চার বছর জার্মান ক্লাব শালকেতে খেলার পর স্প্যানিশ ক্লাব সেভিয়া কিনে নেয় তাকে। সেভিয়ার সঙ্গে চুক্তি করার জন্য ভাই দেজানকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমবারের মতো স্পেনের মাটিতে পা রাখেন রাকিটিচ।
ভাইকে সাথে নিয়ে যখন হোটেলে এসে উঠলেন রাকিটিচ, রাত তখন প্রায় দশটা। পরের দিন সেভিয়ায় গিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও চুক্তির আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হবে। নতুন একটি দেশে খেলতে এসে কিছুটা নার্ভাস রাকিটিচ তাই স্নায়ুচাপ কাটানোর জন্য ভাইকে নিয়ে এক বারে গেলেন। তখনও কী আর তিনি জানতেন, এই বারে গিয়েই তিনি খুঁজে পাবেন তার ভবিষ্যৎ জীবনসঙ্গীকে!
ভাইয়ের সঙ্গে বসে গল্প করছেন, এমন সময়ে হোটেল বারে এক নারী ওয়েটারকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন রাকিটিচ। নিজের মনেই বলে উঠলেন, ‘এত সুন্দরও কোন মানুষ হতে পারে!’ মেয়েটিকে দেখিয়ে ভাইকে বলেও ফেললেন, ‘ওই মেয়েটিকে দেখেছ? ওর জন্যই আমি সেভিয়াতে খেলব, এবং ওকে বিয়ে করব।’ স্নায়ুচাপে ভুলভাল বকছেন মনে করে ভাই পাত্তা দিলেন না রাকিটিচের কথায়, কিন্তু প্রথম দর্শনে রাকিটিচ সত্যিই প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন সেই ওয়েটারের।
এরপর শুরু হলো রাকিটিচের জীবনের ‘সবচেয়ে কঠিন অধ্যায়।’ বাড়ি ভাড়া পাওয়ার আগে তিন মাস ওই হোটেলে ছিলেন রাকিটিচ, তিন মাসের প্রতিটি দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই তিনি হোটেল বারে চলে আসতেন সেই ওয়েটারকে দেখার জন্য। কফি আর অরেঞ্জ জুসের অর্ডার দিয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়েও থাকতেন তার দিকে। মেয়েটির সঙ্গে টুকটাক কথা বলারও চেষ্টা করতেন, কিন্তু স্প্যানিশ ভাষা না জানা থাকায় হাই-হেলোর বেশি আগাতে পারছিলেন না।
কিছুদিন পর খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারলেন, মেয়েটির নাম রাকুয়েল। কিন্তু সমস্যা হলো, মেয়েটি ইংরেজি জানে না। আবার রাকিটিচ এদিকে স্প্যানিশ জানেন না। পছন্দের মেয়েটির সাথে যোগাযোগ করার জন্য তাই দ্রুত স্প্যানিশ শেখার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন তিনি। সারাদিন স্প্যানিশ টিভি প্রোগ্রাম ও রেডিও শুনে যতটুকু স্প্যানিশ রপ্ত করলেন, সেটুকু দিয়েই কথা বলা শুরু করলেন রাকুয়েলের সাথে। রাকিটিচের এমন কাজকর্মে মজা পেতে শুরু করলেন রাকুয়েলও।
আস্তে আস্তে কিছুটা চেনাজানা হলে রাকুয়েলকে বাইরে কফি খেতে যাওয়ার প্রস্তাব দেন রাকিটিচ। কিন্তু ২০-৩০ বার প্রস্তাব দিলেও কোন না কোন অজুহাতে বারবার সেটি এড়িয়ে যেতে লাগলেন রাকুয়েল। শেষমেশ একদিন রাকিটিচের জোরাজুরিতে বলেই ফেললেন ডেটে না যাওয়ার কারণ। পেশাদার ফুটবলার রাকিটিচ যদি সামনের মৌসুমেই অন্য কোথাও চলে যান, সেই ভয়েই তার সাথে জড়াতে চাচ্ছেন না রাকুয়েল।
এই কথা শোনার পর রাকিটিচ ভাবলেন, রাকুয়েল তাকে এতটাই খারাপ খেলোয়াড় ভেবেছেন যে, সেভিয়া তাকে পরের মৌসুমেই ছেড়ে দিতে পারে, এমন আশঙ্কা করছেন তিনি! রাকুয়েলের মন জয়ের জন্য তাই ক্লাবের হয়ে দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে শুরু করলেন তিনি, যেন অন্তত বছর কয়েকের জন্য ক্লাবটিতে নিয়মিত হতে পারেন।
এরপর একদিন অপ্রত্যাশিতভাবে রাকিটিচের ভাগ্য খুলে গেলো। সেভিয়ায় এসেছেন সাত মাস হয়ে গেছে ততদিনে, শহরের অনেকেই তাই রাকুয়েলের প্রতি রাকিটিচের দুর্বলতার কথা জানত। একদিন হঠাৎ করে অপরিচিত এক নম্বর থেকে রাকিটিচের মোবাইলে একটি এসএমএস আসে, যেটিতে লেখা ছিল, ‘রাকুয়েল আজ কাজে নেই, বোনের সঙ্গে এক বারে কফি খেতে গেছেন।’ এই খবর শোনার পরে রাকিটিচকে আর পায় কে! দ্রুত এক বন্ধুকে নিয়ে চলে গেলেন সেই বারে।
হঠাৎ রাকিটিচের উপস্থিতি চমকে দিল রাকুয়েলকে। রাকিটিচও গিয়ে রাকুয়েলের বোনের সামনেই তাকে ডেটে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়ে বসলেন! সাত মাস ধরে না করে আসলেও এদিন আর রাকিটিচকে মানা করতে পারেননি রাকুয়েল। সেদিন থেকেই দুজনের প্রণয়, সেই প্রণয় পরে রুপ নিয়েছে পরিণয়েও।
পছন্দের মানুষটিকে পরে বিয়ে করে সংসার শুরু করেছেন রাকিটিচ। দুটি ফুটফুটে মেয়ের জন্ম দেয়া দম্পতিটি এখনও একসাথেই জীবন কাটিয়ে যাচ্ছেন।
রাকিটিচ পরে বলেছিলেন, রাকুয়েলকে রাজি করানোর এই সাতটি মাস তার কাছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার চেয়েও কঠিন ছিল! রোমান্টিক কাহিনী যে শুধু সিনেমার পর্দায় নয়, বাস্তব জীবনেও হতে পারে, সেটিই যেন প্রমাণ করে দিয়েছেন বার্সেলোনার এই ক্রোয়েশিয়ান মিডফিল্ডার!
Comments