ঘুরে দাঁড়াতে হবে, কিন্তু কীভাবে?

শাহবাগের রাস্তায় হলুদ রঙের বোর্ডে লাল অক্ষরে লেখা ‘সাবধানে চলুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা’। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ‘সাবধান’ হতে হবে। ‘বহিরাগত’ মুক্ত করার অংশ হয়ত এই ‘সাবধানতা’। সেই সাবধানতা বিষয়ক দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবেই হয়ত পায়ের নখ উপড়ে দেওয়া হচ্ছে।
রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিববাড়ি এলাকায় ছাত্র-শিক্ষকদের মিছিলে হামলা চালায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ছবি: পলাশ খান

আহমেদ জাওয়াদ চৌধুরী চট্টগ্রাম ইংলিশ স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী। গণিত অলিম্পিয়াডে দেশের পক্ষে প্রথম স্বর্ণ পদক অর্জন করেছেন। গণিত অলিম্পিয়াড সম্পর্কে আমরা যে খুব বেশি কিছু জানি, তা নয়। ১১৬টি দেশের ৬১৫ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে এই স্বর্ণ পদক অর্জন। এটা যে কত বড় অর্জন, কতটা সম্মানের অর্জন, আমরা তা হয়তো ধারণা করতে পারছি না। ধারণা করার চেষ্টাও নেই। বাংলাদেশ দল স্বর্ণ ছাড়াও তিনজন ব্রোঞ্জ এবং দুইজন অনারেবল মেনশন পেয়েছেন।

এই দলটি রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান পেতে পারতেন। সাধারণ মানুষের মনেও যে বড় কোনো অনুভূতি জন্ম নিয়েছে, তাও হয়ত নয়।

খ.

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জুনিয়র কয়েকজন শিক্ষার্থী সিনিয়র দুজন শিক্ষার্থীকে পিটিয়েছে। একজন ছাত্রীর পায়ের নখ উপড়ে দিয়েছে। জাওয়াদদের সাফল্য, না উপড়ে ফেলা পায়ের নখ- কোন সংবাদটি মানুষকে আকর্ষণ করছে বেশি?

আহত ছাত্রী রাতে প্রক্টরকে ফোন করে যখন ঘটনা জানাচ্ছিলেন, তখন প্রক্টর পাল্টা প্রশ্ন করেছেন, তুমি রাতে ওখানে কেন গেছ?

শাহবাগের রাস্তায় হলুদ রঙের বোর্ডে লাল অক্ষরে লেখা ‘সাবধানে চলুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা’। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ‘সাবধান’ হতে হবে। ‘বহিরাগত’ মুক্ত করার অংশ হয়ত এই ‘সাবধানতা’। সেই সাবধানতা বিষয়ক দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবেই হয়ত পায়ের নখ উপড়ে দেওয়া হচ্ছে।

গ.

পিস্তল দিয়ে গুলি ছোড়ার ট্রেনিং নিচ্ছেন, এমন সংবাদ- ছবি প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে। ছাত্র সংগঠনের সেই ক্যাডার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। ছাত্রমৈত্রী নেতা রিমুকে কুপিয়ে হত্যা করা শিবির ক্যাডার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছিলেন। সেই সংবাদ অনুসন্ধান করে গণমাধ্যম প্রকাশ করেছিল। এখন অনুসন্ধান করতে হয় না, এমনিতেই জানা যায়। দৈনিক যুগান্তর প্রকাশ করেছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে ২০ লাখ টাকা লেনদেনের টেলিফোন সংলাপ।

দুইজন শিক্ষক একজনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার জন্যে ২০ লাখ টাকা নিয়েছেন। নিয়োগ দিতে না পেরে আবার সেই টাকা ফেরতও দিয়েছেন। টেলিফোন সংলাপ প্রকাশ হয়েছে একটি নিয়োগের। ৩৭ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছিল। উপাচার্য বলেছেন, অভিযোগ আকারে আসলে ব্যবস্থা নেবেন। দুর্নীতি বা অনিয়মের ক্ষেত্রে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখাবেন। জোর দিয়ে বলেছেন, অনিয়ম দুর্নীতি তিনি দূর করে ছাড়বেনই!

ঘ.

বিশ্বকাপ ফুটবল যেসব দেশ খেলে আমরা তাদের অনেকের চেয়ে বেশি দেখি। দেখা তো খারাপ কিছু নয়। কিন্তু দেখে কি কিছু শিখি? খেলার কথা বাদ দেই। দেখা বা দর্শক প্রসঙ্গে আসি। এশিয়ার দেশ হিসেবে জাপানের খেলা দেখে আমরা মুগ্ধ হয়েছি। আমরা তো বটেই, সারা পৃথিবী মুগ্ধ হয়েছে জাপানি দর্শকদের দেখে। খেলার পরে গ্যালারি পরিষ্কার করে জাপানি দর্শকরা শুধু এবারই নয়, আগেও দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন। প্যারিসে ফ্রান্সের সঙ্গে খেলায় পরাজিত হয়ে গ্যালারি পরিষ্কার করে মাঠ ছেড়েছিলেন জাপানি দর্শকরা। চোখ বড় করে বিস্মিত হয়ে তা দেখেছিলেন ফরাসিরা।

বিশ্বকাপে জাপানি খেলোয়াড়রা পরাজয়ের পরও ড্রেসিং রুম চকচকে-ঝকঝকে পরিষ্কার করে বিদায় নিয়েছেন। সারা পৃথিবী অবাক হয়ে তা দেখেছে। জাপান কিন্তু এটা হঠাৎ করে করেনি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা তারা জীবনের অংশ করে নিয়েছেন।

জাপানের দেখাদেখি সেনেগালের দর্শকরাও গ্যালারি পরিষ্কার করেছেন।

আমরা জাপানের মতো ফুটবল হয়ত খেলতে পারব না। কিন্তু জাতি হিসেবে, জাপানিদের দেখে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে কি একটু অনুপ্রাণিত হতে পারি না! ডাস্টবিনে ময়লা ফেলার ব্যাপারটা তো অন্তত শিখতে পারি। ভালো বা ইতিবাচক কিছু কী আমাদের আকর্ষণ করে না, অনুপ্রাণিত করে না?

ঙ.

রডের পরিবর্তে বাঁশ দিয়ে দেওয়াল নির্মাণের সচিত্র সংবাদ গতকালের ডেইলি স্টারেও প্রকাশিত হয়েছে। ভবন, সেতু, সড়কে রডের পরিবর্তে বাঁশ ব্যবহারের ঐতিহ্য ইতিমধ্যে আমরা তৈরি করেছি। রেল লাইনে স্টিলের পাতের পরিবর্তে বাঁশের অভিনব ব্যবহারও দেখেছেন বাংলাদেশের মানুষ। এই লেখা যখন লিখছি তখন জানলাম কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারের নির্মাণাধীন মূল গেট ভেঙে পড়েছে। নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার আগেই ভেঙে পড়ল। মূল ভবনগুলোর আস্তর খুলে পড়ার ছবি-সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকায়। কেন নতুন নির্মাণের এমন অবস্থা? অনেক ঘটনার মধ্যে একটি বলছি। আস্তর দেওয়ার কাজ করছিলেন স্থানীয় এক নেতার ছোট ভাই। এই ঠিকাদার সিমেন্টের সঙ্গে বালু না মিশিয়ে আশপাশের জমি থেকে বালু মাটি কেটে এনে সিমেন্টের সঙ্গে মিশিয়ে আস্তর দিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই তা খুলে পড়ছে। এত সংবাদের ভিড়ে এটাও ছোট্ট একটি সংবাদ। এর বেশি কিছু নয়।

চ.

লিখছি এলোমেলো কিছু ঘটনা। কিছু বুঝলেও, বুঝি না অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। যেন উত্তর নেই, প্রশ্নের পাহাড়। দেখছি তারুণ্যের হিংস্রতা। শিক্ষার্থীদের পেটানো হচ্ছে নির্দয়ভাবে। আঙ্গুল তুলে লাঞ্ছিত করা হচ্ছে শিক্ষকদের। আইন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী- যেন কেউ কোথাও নেই। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলছেন, ছাত্রলীগের কমিটি নেই। ছাত্রলীগের নামে কিছু হচ্ছে কিনা দেখতে হবে।

অথচ যারা ছাত্রদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করছে, ছাত্রীদের লাঞ্ছিত করছে, শিক্ষকদের অপমান- অসম্মান করছে, তারা প্রায় সবাই পরিচিত, জানা তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ও। পত্রিকায় ছবি ছাপা হচ্ছে, টেলিভিশনে দেখানো হচ্ছে। আক্রমণকারীরা টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিচ্ছে। পুলিশ তাদের কাউকে ধরছে না, ধরছে আক্রান্তদের।

কোটার মত একটি বিষয়, যা টেবিলে বসে আলোচনা করে খুব সহজে সমাধান করা সম্ভব ছিল। অথচ তারুণ্যের মেধা- নৈতিকতার কী নিদারুণ অপচয়ের সাক্ষী হয়ে থাকছে বাংলাদেশ!

ছ.

৪৭ বছর বয়স ক্লান্ত বা ঝিমিয়ে যাওয়ার নয়। সক্রিয় থাকার কথা পূর্ণ উদ্যমে।

বাংলাদেশ যে ক্লান্ত হয়ে গেছে বা যাচ্ছে বা উদ্যমে ভাটা পড়ছে, সেই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে না। আশা সম্ভাবনার বহু কিছু আছে।

তা সত্ত্বেও, ৪ কোটি ৮২ লাখ কর্মক্ষম বেকার হতাশা নিয়ে ঘুরছেন। আশার চেয়ে হতাশার পাল্লা কি ভারি হয়ে যাচ্ছে? এর সঠিক উত্তর কি আমরা জানি? জানেন নীতিনির্ধারকরা? চেষ্টা করেছেন জানার? একটু কি অনুধাবন করার চেষ্টা করতে হবে না? মেধাকে প্রাধান্য না দিয়ে, কেমন বাংলাদেশ নির্মাণ করতে চাইছি?

চোখের সামনে লাখ লাখ অনিয়ম-অরাজকতা। শেখার বা অনুপ্রাণিত হওয়ার মতো সংবাদের অভাব। থাকলেও তা চাপা পড়ে যায়, সামনে আসে না। মানুষই তো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি। সেই মানুষ হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে যাবে?

এত ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ তো উদ্যম হারাতে পারে না। ঘুরে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু কীভাবে?

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

7h ago