অবশেষে তাহারা ‘সচেতন’ হইলেন!

ছবি: সংগৃহীত

খুবই ভালো সংবাদ যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি সরব হয়েছেন। গত মার্চ মাস থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে, একটি দুটি ব্যতিক্রম ছাড়া শিক্ষক সমিতিকে নীরব থাকতে দেখা গেছে। সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি। শিক্ষক সমিতির সরব হয়ে ওঠা কর্মসূচির দিকে একটু নজর দেওয়া যাক।

১. আজ (২৫ জুলাই) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি একটি মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে। শিক্ষক সমিতির প্যাডে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষর করা প্রতিবাদলিপির কিছু অংশ তুলে ধরছি, ‘গত ১৯ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে এক সমাবেশে অত্যন্ত অপ্রাসঙ্গিকভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পর্কে অধ্যাপক আকমল হোসেন (অবসরপ্রাপ্ত) বলেছেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রী তিনি কি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন? তার পিতা... তার পিতা তিনি কি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন?’ আমরা বিস্মিত হই এই ভেবে যে, এ ধরনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য সত্ত্বেও উক্ত সমাবেশের আয়োজকরা তার এ বক্তব্যের কোনো প্রতিবাদ তো করেনইনি বরং বাহবা দিয়েছেন। ঘটনা পরম্পরায় প্রতীয়মান হয় যে, জনাব আকমল হোসেনের বক্তব্য তার একক বক্তব্য নয়, এটি সেই অতি প্রতিক্রিয়াশীলদের অপভাবনার বহিঃপ্রকাশ; যারা মহান মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে বারংবার বিতর্ক তৈরির অপপ্রয়াস চালাচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে আঘাত করে তারা শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধকেই নয়, বাংলাদেশের অস্তিত্বের উপরও আঘাত করেছেন।’

শিক্ষক সমিতি প্রতিবাদলিপিতে আরও কিছু শব্দ ব্যবহার করেছে ‘ইতিহাস বিকৃতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী, সংবিধানবিরোধী, রাষ্ট্রদ্রোহিতার সামিল, মিথ্যা ও দুরভিসন্ধিমূলক, বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করার হীন ও গভীর চক্রান্ত’- ইত্যাদি।

২. যার বিরুদ্ধে এমন কঠিন শব্দে অভিযোগ করছে শিক্ষক সমিতি সেই অধ্যাপক আকমল হোসেন শিক্ষার্থীবান্ধব একজন স্বজ্জন মানুষ হিসেবে পরিচিত। তিনি এভাবে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে প্রশ্ন তুললেন, তাদের মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন- তা বিস্মিত হওয়ার মতোই? এই অবস্থায় অধ্যাপক আকমল হোসেনের পুরো বক্তব্য শুনে আবারও বিস্মিত হতে হলো। বক্তব্যে যা পাওয়া গেল এবং পরবর্তীতে তিনি যে ব্যাখ্যা দিলেন তা তুলে দিচ্ছি, ‘আমার বক্তব্যে আমার বিভাগীয় সাবেক ছাত্র ও পরবর্তী সময়ে সহকর্মী মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ফাহমিদুল হকের উপর ১৬ জুলাই শহীদ মিনারে সংঘটিত হেনস্তার (যখন তানজীমকে অত্যন্ত অশিষ্টভাবে আঙ্গুল তুলে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে তিনি কেন মুক্তিযুদ্ধে যাননি) প্রসঙ্গ টেনে প্রশ্ন করেছিলাম যে, মুক্তিযুদ্ধে যোগদান কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করার মাপকাঠি হতে পারে কি না?’

অধ্যাপক আকমল আরও বলেছেন, ‘বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমি বলেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধ একটি মহান ঘটনা আমাদের জাতির জীবনে। এটা নিয়ে যেভাবে অবস্থান নেওয়া হয়, বক্তব্য দেওয়া হয়, তাতে মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা করা হয়। আমার প্রশ্ন আমাদের প্রধানমন্ত্রী কি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন? তার পিতা যার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরি হয়েছিল তিনি কি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন? তাহলে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের মাধ্যমে যদি বিচার করা হয় কে অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে তা হলে তা হবে অত্যন্ত একটি নেতিবাচক ধারণা।’

শিক্ষক সমিতি তাদের প্রতিবাদলিপিতে অধ্যাপক আকমল হোসেনের বক্তব্যের ‘যিনি এই আন্দোলনের যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, যার মাধ্যমে তৈরি হয়েছিল’ এই লাইনটি বাদ দিয়ে উদ্ধৃত করেছেন। লাইনটি বাদ না দিলে বক্তব্যের ব্যাখ্যা শিক্ষক সমিতি যেভাবে দিয়েছেন, আদৌ সেভাবে দেওয়া যায় কি না, সেটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কিন্তু অধ্যাপক আকমল হোসেনের বক্তব্যকে কি ‘দেশদ্রোহিতার সামিল’ বলা যায়?

বক্তব্যের খণ্ডিত অংশ নিয়ে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করার নজির রাজনীতিবিদদের ভেতরে আছে। সারা পৃথিবীতেই কমবেশি আছে। ভারতে গত নির্বাচনের আগে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী নরেন্দ্র মোদিকে ‘চা ওয়ালা’ বলেছিলেন।মূল বক্তব্য কটাক্ষপূর্ণ ছিল না। কিন্তু বক্তব্যের আগে- পরের অংশ বাদ দিয়ে মোদি এবং বিজেপি এটাকে কটাক্ষপূর্ণ  ‘গরিববিরোধী মানসিকতা’ হিসেবে প্রচার করে সুবিধা নিয়েছিলেন। মোদি আবেগমিশ্রিত কান্নাজড়িত কণ্ঠে লাখ জনতার সামনে বলেছিলেন ‘আমি চা ওয়ালা, এটা কি আমার অপরাধ!’

আমাদের দেশেও এমন নজীর আছে। কিন্তু শিক্ষকরা- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি আরেকজন শিক্ষকের বক্তব্য খণ্ডিতভাবে উদ্ধৃত করে, এমন কঠিন ভাষায় কথা বলছেন!   কোনো রাজনীতিবিদ নন, শিক্ষকরা এমনটা করছেন!

অধ্যাপক আকমল হোসেনের মূল বক্তব্য বা পরবর্তী ব্যাখ্যা, শিক্ষক সমিতি বিবেচনায় নেয়নি। কঠিন ভাষায় প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।

৩. ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা নিপীড়িত-নির্যাতিত হচ্ছেন। আহত রক্তাক্ত শিক্ষার্থীদের হাসপাতালে দেখতে যাননি শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দ বা প্রক্টরিয়াল বডির কেউ। ছাত্রী নিপীড়ন, শিক্ষক লাঞ্ছনার বিরুদ্ধেও তারা নীরব থেকেছেন। আহত শিক্ষার্থীদের হাসপাতালে চিকিৎসা না দেওয়া, আহত শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার-রিমান্ডে নেওয়া বিষয়েও শিক্ষক সমিতির কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ভিসির বাড়ি ভাঙার পর তারা একবার সোচ্চার হয়েছিলেন।প্রধানমন্ত্রীর মনোভাব বুঝে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে সংহতিও প্রকাশ করেছিলেন।

বাড়ি ভাঙার তদন্ত না করে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর দায় চাপিয়ে গ্রেপ্তার নিয়ে তারা সরব নন। এমনকি পুলিশ কেন তদন্ত করছে না, বা তিন মাসে তদন্তের অগ্রগতি কতটা, তা নিয়েও কোনো বক্তব্য নেই শিক্ষক সমিতির। মাঝরাতে ছাত্রীদের হল থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনাতেও নীরব ছিল শিক্ষক সমিতি। ভিসি শিক্ষার্থীদের জঙ্গি বলেছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হাতুড়ি পেটা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষককে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত ও তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলা করা নিয়েও শিক্ষক সমিতি তাদের প্রতিবাদলিপিতে কিছু উল্লেখ করেনি।

৪. একজন প্রবীণ শিক্ষকের বক্তব্য আংশিক ব্যবহার করে, যারা শিক্ষার্থীদের নিপীড়ন থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছেন সেই সব সহকর্মী শিক্ষকদের ‘অতিপ্রতিক্রিয়াশীল’ ‘মুক্তিযুদ্ধবিরোধী’ ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতার সামিল’ বলে অবশেষে ‘সচেতন’ শিক্ষকরা নীরবতা ভেঙে সরব হয়ে কী বার্তা দিলেন সমাজকে? শিক্ষার্থীরা এর থেকে কী শিক্ষা নেবেন? দয়া করে বিষয়টি কি একবার ভেবে দেখবেন শিক্ষক নেতারা, শিক্ষক সমিতি?

Comments

The Daily Star  | English
NCP will not accept delay in Teesta master plan

Won’t accept any implementation delay: Nahid

National Citizen Party Convener Nahid Islam yesterday said his party would not accept any delay or political maneuver over implementing the Teesta master plan.

4h ago