হাতে লাঠি মাথায় হেলমেট ‘ছাত্রলীগের’ হামলা শিক্ষার্থীদের ওপর

​শনিবার দুপুর দেড়টায় ধানমন্ডির ৩ নম্বর সড়কে এক দিকে স্কুল-কলেজের হাজার হাজার শিক্ষার্থী অন্যদিকে ছাত্রলীগসহ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের একদল নেতাকর্মী। অনেকের হাতে লাঠি-ইট-পাথর। দুদিক থেকেই চড়াও হওয়ার চেষ্টা। বাতাসে ছাত্র হত্যা ও ছাত্রী নিপীড়নের গুজবে উত্তেজনা চরমে উঠলে রাস্তার ডিভাইডারের ওপরের বেড়া ভেঙে লাঠি তুলে নেয় ছাত্ররা। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয় চারপাশ।
জিগাতলায় ছাত্রলীগের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের সময় চোখে আঘাত লাগে এক ছাত্রের। শার্টজুড়ে তার ছোপ ছোপ রক্ত। ছবি: আমরান হোসেন

শনিবার দুপুর দেড়টায় ধানমন্ডির ৩ নম্বর সড়কে এক দিকে স্কুল-কলেজের হাজার হাজার শিক্ষার্থী অন্যদিকে ছাত্রলীগসহ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের একদল নেতাকর্মী। অনেকের হাতে লাঠি-ইট-পাথর। দুদিক থেকেই চড়াও হওয়ার চেষ্টা। বাতাসে ছাত্র হত্যা ও ছাত্রী নিপীড়নের গুজবে উত্তেজনা চরমে উঠলে রাস্তার ডিভাইডারের ওপরের বেড়া ভেঙে লাঠি তুলে নেয় ছাত্ররা। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয় চারপাশ।

এর পরই শুরু হয় হামলা। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে চলে হামলা-সংঘর্ষ।

ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সীমান্ত স্কয়ারের দিক থেকে পাথর ছুড়তে ছুড়তে ছাত্রদের দিকে এগিয়ে যায়। আক্রমণকারীদের মাঝখানে থাকা লাল শার্ট ও হেলমেট পরিহিত এক যুবক তখন পিস্তল হাতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গুলির শব্দ। একবার, দুবার, তিনবার… আরও বেশ কয়েক বার।

প্রাণপণে ছুটছে তখন ছাত্ররা। বৃষ্টির মতো তখন তাদের দিকে উড়ে আসছে পাথর। তাদের মধ্যেই অপেক্ষাকৃত লম্বা একটি ছেলে রাস্তায় পড়ে যায়। সে তার চোখ চেপে ধরে। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন ছাত্র ছুটে এসে রিকশায় তুলে নেয় তাকে। ছেলেটি তখন কাঁদছিল। তাদেরকে বলে, 'আমাকে নিয়ে চিন্তা করিস না। কিছু হয় নাই আমার। তোরা ঠেকা। নাহলে ছাত্রলীগের সঙ্গে পারা যাবে না।'

কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে ঘিরে ছাত্রদের মুহুর্মুহু করতালি। একজন চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে, ধর.. ধর..।

মুহূর্তেই বদলে যায় অবস্থা। হামলাকারীদের দিকে পাথর নিয়ে পাল্টা প্রতিরোধ। পিছু হটতে বাধ্য হয় হেলমেট পরা অস্ত্রধারী যুবকরা।

গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ধানমন্ডিতে যা ঘটেছে এটি তার একটি খণ্ডচিত্র। সড়কে গাড়িচাপায় ছাত্র নিহত হওয়ার প্রতিবাদে শনিবারও শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে জিগাতলায় লাইসেন্স ও যানবাহন নিয়ন্ত্রণের কাজ করছিল। এর মধ্যেই ছাত্রলীগ তাদের ওপর চড়াও হয়েছে।

হামলাকারীরা পথচারী থেকে শুরু করে যারাই তাদের ছবি বা ভিডিও করার চেষ্টা করেছে তাদেরকেই নির্বিচারে পিটিয়েছে, মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়েছে, ক্যামেরা ভেঙেছে।

আট-নয় জন ঘিরে ধরে এক নারী চিকিৎসককে মাথায় ও পায়ে আঘাত করে তারা। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হামলা ঠেকানোর চেষ্টা করেন। পালিয়ে গিয়ে রক্ষা পান তিনি।

সারাদিনের হামলায় সেখানে অন্তত ১৫০ জন আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। এছাড়াও আছে পথচারী, সাংবাদিক ও ক্ষমতাসীন দলের কর্মী। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২০ জনের জখম গুরুতর। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, অন্তত ছয় জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে।

জিগাতলায় পিলখানা ফটকের সামনে শনিবার দুপুর ২টার দিকে ছাত্রলীগের হামলার মুখে ছুটছে ছাত্ররা। ছবি: প্রবীর দাশ

দুপুর দেড়টার দিকে শিক্ষার্থীরা গাড়ির লাইসেন্স যাচাই করার সময়ই সংঘর্ষ শুরু হয়। স্কুল ইউনিফর্মে থাকা অন্তত পাঁচ জনকে পেটায় হামলাকারীরা। এছাড়াও ছাত্রদল ও শিবির কর্মী সন্দেহে বেশ কয়েকজনের ওপর হামলা চালায় তারা। আহতদের হাসপাতালে পাঠিয়ে সায়েন্স ল্যাব মোড়ে সমবেত হওয়া শিক্ষার্থীদের হামলার খবর দেয় তারা। কিছুক্ষণের মধ্যেই নির্মাণাধীন একটি ভবন থেকে লাঠি আর পাথর নিয়ে জিগাতলার দিকে যাওয়া শুরু করে তারা। ছাত্রলীগের দিক থেকেও পাথরে জবাব আসে। ছাত্রদের সংখ্যা বাড়তে থাকলে একত্রিত হয়ে তারা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের ধাওয়া করে ধানমন্ডি ৩-এ তাদের দলীয় সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয় পর্যন্ত নিয়ে যায়। এক পর্যায়ে কার্যালয়ে পাথর ছোড়া হলে জানালার কাচ ভাঙে।

বিরতিহীনভাবে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চললেও পুলিশের দেখা মেলেনি। সড়কের পাশের গলিগুলোতে ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যাওয়া ছাত্রদের এসময় খুঁজে খুঁজে পেটানো হয়।

দুপুর আড়াইটার দিকে সাঁজোয়া যান নিয়ে প্রায় ৪০ জন পুলিশ সদস্য ঘটনাস্থলে আসে। তারাও সরকারি দলের কর্মীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেয়। প্রায় আধা ঘণ্টার মধ্যে গণমাধ্যম কর্মীরা ওই এলাকায় ভিড় করার পর নিরস্ত হয় পুলিশ। তবে ছাত্রদের সঙ্গে যখন সাংবাদিক ও পথচারীদেরকে পেটানো হচ্ছিল তখন আরও বেশি নীরব ভূমিকা নেয় পুলিশ।

বিকেল ৩টার দিকে পিলখানা গেট থেকে বিজিবি সদস্যরা বের হয়ে এসে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন ও শিক্ষার্থীদের মাঝখানে অবস্থান নেয়। তবে দুদিক থেকেই ইট-পাটকেলের মুখে ১৫ মিনিটের মধ্যে তারা চলে যায়।

দুপুর আড়াইটার দিকে শিক্ষার্থীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে জিগাতলার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আবার তাদের ধাওয়া দেয়। এসময় সাত-আটটি গুলির শব্দ শুনতে পান ডেইলি স্টারের দুজন ফটো সাংবাদিক।

৪টার দিকে শিক্ষার্থীরা আবার হামলাকারীদের ধাওয়া দিয়ে জিগাতলার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে পাল্টা ধাওয়া করা হয়। এভাবেই ৬টা পর্যন্ত ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলতে থাকে। এর সঙ্গেই চলে উপস্থিত লোকজনের ওপর ক্ষমতাসীন দলের লোকদের হামলা।

ক্ষমতাসীন দলের লোকজন পাঁচ-ছয় জন ছাত্রকে তাদের দলীয় কার্যালয়ে নিয়ে গিয়ে দেখায় সেখানে কেউ আটকা নেই। প্রায় ৩০ মিনিট পর তারা বেরিয়ে এসে সীমান্ত স্কয়ারের কাছে গণমাধ্যম কর্মী ও শিক্ষার্থীদেরকে ব্রিফ করে। ব্রিফিংয়ের সময় ছাত্ররা হামলার বিচার দাবি করলে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রব্বানি বলেন, তারা ঘটনাটি নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে দেখবেন।

সন্ধ্যার পর থেকে ভুতুড়ে রূপ নেয় ধানমন্ডি ৩ এলাকা। রাস্তাজুড়ে তখন ছড়ানো ছিটানো গাছের ডাল, ইট, পাথর আর লাঠি।

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

6h ago