ছাত্রদের বিরুদ্ধে মামলা, হামলাকারীদের নয়

নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় সাংবাদিকদের ওপর ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের হামলা চালানোর অভিযোগ থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেনি পুলিশ। আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকায় সহিংসতায় গত কয়েক দিনে যতগুলো মামলা হয়েছে তার সবগুলোতেই শিক্ষার্থীদেরকেই আসামি করা হয়েছে।
সোমবার পুলিশ ও লাঠিধারী যুবকদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় আটক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের গতকাল হাতকড়া ও দড়ি বেঁধে আদালতে নিয়ে যায় পুলিশ। ছবি: পলাশ খান

নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় সাংবাদিকদের ওপর ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের হামলা চালানোর অভিযোগ থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেনি পুলিশ। আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকায় সহিংসতায় গত কয়েক দিনে যতগুলো মামলা হয়েছে তার সবগুলোতেই শিক্ষার্থীদেরকেই আসামি করা হয়েছে।

আন্দোলনে হামলা ও সহিংসতা নিয়ে গতকাল পর্যন্ত রাজধানীর ১৬টি থানায় ২৯টি মামলা হয়েছে। মামলাগুলোর অভিযোগে বলা হয়েছে, হামলাকারীরা অজ্ঞাত পরিচয় শিক্ষার্থী। তাদের অনেকের গায়েই স্কুল ও কলেজের ইউনিফর্ম ছিল। মামলার নথিতে আসামিদের সম্পর্কে আরও বলা হয়েছে, কিছু অজ্ঞাত পরিচয় যুবক ২৯ জুলাই বাস চাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলনে ঢুকে পড়ে সহিংস পরিস্থিতি তৈরি করে।

আন্দোলনকে কেন্দ্র করে হওয়া কয়েকটি মামলার নথি পড়েছেন এই প্রতিবেদক। এ নিয়ে পুলিশের সঙ্গেও কথা হয়েছে। আওয়ামী লীগ বা এর অঙ্গ সংগঠনের কোনো নেতা-কর্মীকে কেন আসামি করা হয়নি জিজ্ঞাসা করা হলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত না পাওয়া পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দলের কারও বিরুদ্ধে মামলা করার মতো সাহস আছে কোনো অফিসারের?’

পুলিশের ওপর আক্রমণ, সরকারি সম্পদের ক্ষতিসাধন ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়ার অভিযোগে মোট ২৭টি মামলা করা হয়েছে। এই মামলাগুলোয় কয়েক হাজার শিক্ষার্থী ও তরুণকে আসামি করা হয়েছে। আর ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগের সভাপতির দলীয় কার্যালয়ে হামলার অভিযোগে দলটির একজন নেতা বাদী হয়ে দুটি মামলা করেছেন।

গত ২৯ জুলাই থেকে শুরু হওয়া এই আন্দোলন প্রথম কয়েকদিন শান্তিপূর্ণ থাকলেও ২ আগস্ট থেকে রাস্তায় আক্রমণের শিকার হয়েছে শিক্ষার্থীরা। গত শনিবার ধানমন্ডির জিগাতলা এলাকায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের ব্যাপক সংঘাত হয়। শুধুমাত্র সেখানেই সেদিন শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়। হামলা থেকে রেহাই পায়নি পথচারীরাও। শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে হেলমেট পরা ব্যক্তিরা গুলিও চালায় সেদিন। এর পর দিন সায়েন্স ল্যাব এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষোভকারী ও সাংবাদিকদের ওপর পুলিশের সঙ্গে লাঠি, রামদা ও লোহার রড নিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালায়। এছাড়াও আন্দোলন চলাকালে মিরপুর, উত্তরা, রামপুরা ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হয়। প্রায় সব ক্ষেত্রেই হামলাকারীদের মাথায় ছিল হেলমেট।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে গত ৪ আগস্ট জিগাতলায় শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে লাইসেন্স ও যানবাহন নিয়ন্ত্রণের কাজ করছিল। এর মধ্যেই ছাত্রলীগ তাদের ওপর চড়াও হয়। হামলাকারীরা পথচারী থেকে শুরু করে যারাই তাদের ছবি বা ভিডিও করার চেষ্টা করেছে তাদেরকেই নির্বিচারে পিটিয়েছে, মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়েছে, ক্যামেরা ভেঙেছে।

পুলিশের হাতে আটক শিক্ষার্থীদের ছাড়াতে গতকাল তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার সামনে ভিড় করেন অভিভাবকরা। পরে মুচলেকা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মুক্তি দেওয়া হয়। ছবি: আমরান হোসেন

সারাদিনের হামলায় সেখানে অন্তত ১৫০ জন আহত হন। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। এছাড়াও আছে পথচারী, সাংবাদিক ও ক্ষমতাসীন দলের কর্মী। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২০ জনের জখম গুরুতর। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, অন্তত ছয় জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে।

সেদিন দুপুর দেড়টার দিকে শিক্ষার্থীরা গাড়ির লাইসেন্স যাচাই করার সময়ই সংঘর্ষ শুরু হয়। স্কুল ইউনিফর্মে থাকা অন্তত পাঁচ জনকে পেটায় হামলাকারীরা। এছাড়াও ছাত্রদল ও শিবির কর্মী সন্দেহে বেশ কয়েকজনের ওপর হামলা চালায় তারা। সায়েন্স ল্যাব মোড়ে সমবেত হওয়া শিক্ষার্থীদের কাছে হামলার খবর গেলে নির্মাণাধীন একটি ভবন থেকে লাঠি আর পাথর নিয়ে জিগাতলার দিকে যাওয়া শুরু করে শিক্ষার্থীরা। ছাত্রলীগের দিক থেকেও পাথরে জবাব আসে। ছাত্রদের সংখ্যা বাড়তে থাকলে একত্রিত হয়ে তারা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের ধাওয়া দিয়ে ধানমন্ডি ৩-এ তাদের দলীয় কার্যালয় পর্যন্ত নিয়ে যায়। এক পর্যায়ে কার্যালয়ে পাথর ছোড়া হলে জানালার কাচ ভাঙে।

বিরতিহীনভাবে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চললেও পুলিশের দেখা মেলেনি। মূল সড়কের পাশের গলিগুলোতে ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যাওয়া ছাত্রদের এসময় খুঁজে খুঁজে পেটানো হয়।

দুপুর আড়াইটার দিকে সাঁজোয়া যান নিয়ে প্রায় ৪০ জন পুলিশ সদস্য ঘটনাস্থলে আসে। তারাও সরকারি দলের কর্মীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেয়।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে প্রথম হামলা হয় গত ২ আগস্ট। সেদিন মিরপুরে পুলিশের সঙ্গে লাঠি নিয়ে একদল যুবক ছাত্রদের পেটায়। সেখানেও হামলাকারীদের অনেকেই ছিলেন হেলমেট পরা।

২৯টি মামলায় অন্তত ৪১ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ২২ জন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। মামলাগুলোর মধ্যে পাঁচটি হয়েছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে। এসব মামলায় ছয় জন গ্রেপ্তার হওয়ার কথা গতকাল জানিয়েছেন ডিএমপির উপ-কমিশনার (গণমাধ্যম) মো. মাসুদুর রহমান।

টানা ১০ দিন আন্দোলন চলার পর গতকাল মঙ্গলবার থেকে রাজধানীর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। এদিন কোথাও সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভের খবর পাওয়া যায়নি। রাস্তায় বাস চলাচল শুরু হলেও সংখ্যায় কম ছিল।

সোমবার আন্দোলন থেকে ৩৭ জন ছাত্রকে আটক করেছিল পুলিশ। গতকাল তাদেরকে অভিভাবকদের কাছে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ রাশেদুজ্জামান বলেন, মুচলেকা নিয়ে অভিভাবকদের জিম্মায় দেওয়া হয়েছে ছাত্রদের। অন্যদিকে ছাত্রলীগের সোপর্দ করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থীকে নয় ঘণ্টা আটকে রাখার পর শাহবাগ থানা থেকে ছাড়া হয়। ছাত্রলীগের অভিযোগ ছিল, তারা ফেসবুকে গুজব ছড়িয়েছিলেন। আটকদের একজন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সদস্য। অন্য দুজন কোনো ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নন।

Comments

The Daily Star  | English

How Islami Bank was taken over ‘at gunpoint’

Islami Bank, the largest private bank by deposits in 2017, was a lucrative target for Sheikh Hasina’s cronies when an influential business group with her blessing occupied it by force – a “perfect robbery” in Bangladesh’s banking history.

8h ago