‘গুজব’ হেলমেটের আড়ালে

প্রখ্যাত সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদ লিখেছিলেন, সত্যবাবু মারা গেছেন। না, সত্যবাবু মারা যাননি। মারা যে যাননি, তার প্রমাণ শিশু-কিশোরদের জেগে ওঠা। বাঙালির বহু বছরের প্রচলিত আন্দোলন-সংগ্রাম নয়, ভিন্ন ধারার একটি প্রতিবাদ। আমরা তা না বুঝে, নিছক আন্দোলন হিসেবে দেখেছি। প্রতিবাদের স্বতন্ত্র মাধুর্য উপলব্ধি করার যে সক্ষমতা, তা আমরা হারিয়েছি।
হেলমেট পরা একদল যুবক রোববার সায়েন্স ল্যাব এলাকায় সাংবাদিকদের ওপর হামলার সময় ফ্রিল্যান্স ফটো জার্নালিস্ট রাহাত করিমের মাথায় লোহার পাইপ দিয়ে আঘাত করে। ছবি: ইবনুল আসিফ জাওয়াদ

প্রখ্যাত সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদ লিখেছিলেন, সত্যবাবু মারা গেছেন। না, সত্যবাবু মারা যাননি। মারা যে যাননি, তার প্রমাণ শিশু-কিশোরদের জেগে ওঠা। বাঙালির বহু বছরের প্রচলিত আন্দোলন-সংগ্রাম নয়, ভিন্ন ধারার একটি প্রতিবাদ। আমরা তা না বুঝে, নিছক আন্দোলন হিসেবে দেখেছি। প্রতিবাদের স্বতন্ত্র মাধুর্য উপলব্ধি করার যে সক্ষমতা, তা আমরা হারিয়েছি।

চোখে আঙ্গুল দিয়ে শিশুরা তা দৃশ্যমান করে গেছে।

বুদ্ধিদীপ্ত- অভিনব, সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা পন্থা অনুসরণ করেছে শিশুরা। যা দেখে বড়রা প্রথমে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছেন। একটু সময় নিয়ে চিরায়ত চালাকির পথ বেছে নিয়েছেন। যোগ্যতা দিয়ে প্রতিবাদ মোকাবিলার সামর্থ্য না থাকায়, ‘গুজব’ ‘তৃতীয় পক্ষ’ এবং ‘লাঠি-রড-চাপাতি- হেলমেট বাহিনী’র সংশ্লিষ্টতা এনেছেন বড়রা।

বাঙালির সব আন্দোলনের অনুষঙ্গ ছিল গুজব। গুজব কখনও আন্দোলনকে বেগবান করেছে। কখনও গুজবে আন্দোলন পথ হারিয়েছে।

‘গুজব’ বায়বীয়। শোনা যায়, দেখা যায় না। গুজবকে ভিত্তি দেওয়ার জন্যেই ‘তৃতীয় পক্ষ’ আসে বা আনা হয়। শিশুদের এই প্রতিবাদে ‘তৃতীয় পক্ষ’র আগমনের কথা বারবার বলা হয়েছে। মাথায় হেলমেট, হাতে রড-লাঠি- কিরিচ-চাপাতিধারী আরেকটি পক্ষ দেখা গেছে।

৪ আগস্ট ধানমন্ডি-জিগাতলা এলাকায় ‘গুজব’র বিষয় ছিল ৪ জন ছাত্র নিহত হয়েছে, ৪ জন ছাত্রীকে আটকে রেখে নিপীড়ন করা হয়েছে। একজন ছাত্রের চোখ তুলে ফেলা হয়েছে। তথ্যের সত্যতা ছিল না, কিন্তু সত্যের চেয়ে বড় শক্তি নিয়ে ছড়িয়েছে মূলত ফেসবুকের মাধ্যমে। বিশ্লেষণের কাঠগড়ায় মূলধারার গণমাধ্যমও।

ফেসবুকে ‘গুজব’ ছড়িয়ে দেওয়া হলো, মূলধারার গণমাধ্যম কী করল? সত্যটা কেন গণমাধ্যম জানাল না, কেন তাৎক্ষণিকভাবে জানাল না? ফেসবুকেও অসংখ্য মানুষের এমন প্রশ্ন ছিল।

এক্ষেত্রে পুরনো কথাটিই আবার নতুন করে আসছে, মূলধারার গণমাধ্যম যদি সঠিক সংবাদ না দেয় বা দিতে না পারে, মানুষ বিকল্প সন্ধান করে। ‘গুজব’ রটনাকারীরা সেই বিকল্প পথে ওৎ পেতে থাকে। খবরের জন্যে উদগ্রীব মানুষ ‘গুজব’ বিশ্বাস করতে শুরু করে। সত্যটা যতক্ষণ মানুষের সামনে না আসে, গুজবের অবসান হয় না। ‘হত্যা- নিপীড়ন’র অংশটি ছিল ‘গুজব’। রড- লাঠিধারী যুবকদের উপস্থিতি, প্রতিবাদকারী ও সংবাদকর্মীদের মারধরের ঘটনা ঘটেছিল- যা ‘গুজব’ ছিল না। লক্ষণীয়, পুরো বিষয়টিকে ‘গুজব’ হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছিল। তথ্য আংশিক জানালে বা সত্য গোপনের চেষ্টায় ‘গুজব’ই লাভবান হয়। এক্ষেত্রে তেমনই হয়েছিল। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল  ‘তৃতীয় পক্ষ’ গুজব ছড়িয়ে শিশুদের ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ অফিস আক্রমণ করিয়েছে। দৃশ্যমান ছিল হেলমেটধারীরা রড- লাঠি দিয়ে শিশুদের পেটাচ্ছিল। সংবাদকর্মীরা সেই সংবাদ সংগ্রহ ও ছবি তুলতে গেলে তারা বাধা দিচ্ছিল। হেলমেটধারী রড- লাঠি বাহিনী আর পুলিশের ছিল সহাবস্থান। মিরপুর- জিগাতলা-ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়- বসুন্ধরা এলাকা, সর্বত্র তা দৃশ্যমান ছিল। স্থির এবং ভিডিও চিত্র আছে।

প্রশ্ন আসছে ‘গুজব’ যদি ‘তৃতীয় পক্ষ’ ছড়িয়ে থাকে, হেলমেটধারীরা কোন পক্ষ?

এদের দৃশ্যমান অবস্থান গণমাধ্যম কতটা তথ্য- প্রমাণ এবং সাহসিকতার সঙ্গে উপস্থাপন করল বা করতে পারল, তার উপর গুজবের বিস্তৃতি নির্ভর করে। স্বীকার করে নিতে হবে যে, গণমাধ্যমের এক্ষেত্রে দুর্বলতা ছিল। ছিল বলেই গুজব এত সময় নিয়ে মানুষের মনে থাকতে পেরেছে। ফেসবুকে ‘গুজব’র পাশাপাশি, রড- লাঠি বাহিনীর তাণ্ডবের স্থির- ভিডিও চিত্র তাৎক্ষণিকভাবে মানুষ জেনেছে। গণমাধ্যম তাৎক্ষণিকভাবে প্রকৃত সত্যটা মানুষকে জানাতে পারেনি।

গণমাধ্যমের এই দুর্বলতার কারণ কী?

কারণও অজানা নয়।

যে কোনো কারণেই হোক তথ্য-প্রবাহ গতিশীল না থাকলে, বাধাপ্রাপ্ত হলে - গুজব রটানো সহজ হয়। গুজবের ভিত্তি দুর্বল করার একমাত্র উপায়, সঠিক তথ্য- প্রবাহের সরব উপস্থিতি।

পৃথিবীর সব দেশে, সব কালে, সব সমাজের জন্যে সব সময় তা প্রযোজ্য হতে দেখা গেছে। এখনও এর বিকল্প কিছু আবিষ্কার হয়নি।

৪ আগস্ট বিকেলে মিরপুরে পুলিশ আক্রমণ করল শিশু-কিশোরদের। পুলিশের আগে লাঠি হাতে একদল হেলমেটবাহিনী। শিশু-কিশোরদের পুলিশ পিটিয়েছে ফুটওভার ব্রিজে আটকে নিয়ে। পুলিশের সঙ্গের হেলমেটবাহিনী পিটিয়েছে রাস্তায়। সেদিন কিন্তু কোনো ‘গুজব’ ছড়ানোর বিষয় সামনে আসেনি। শিশু- কিশোরদের মারধর করা এই হেলমেটবাহিনী কারা?

কে তাদের পরিচিতি নিশ্চিত করবে? কার করার কথা? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন পুলিশের সঙ্গে কী তাদের থাকার কথা ছিল? লাঠিধারী যুবকরা পুলিশের সঙ্গে কেন, তার চেয়ে বড় বিষয় ‘পুলিশ-লাঠি বাহিনী’ যখন একাকার হয়ে যায় তখন নানাবিধ বিভ্রান্তি তৈরি হয়।

মিরপুরের মতো একই রকম হেলমেট বাহিনীর দেখা মিলল ৫ আগস্ট ধানমন্ডি- জিগাতলায়।

দলে দলে যুবক, হাতে লাঠি-চাপাতি-রড। তারা শিশু কিশোরদের আঘাত করছে, আঘাত করছে দায়িত্ব পালনরত সংবাদকর্মীদের। পুলিশ কখনো দর্শক, কখনো এদের সহযোগী। ‘জিগাতলায় শিক্ষার্থীদের উপর আক্রমণ হয়েছে’- এর চেয়ে খুব বেশি তথ্য জানাচ্ছে না বা জানাতে পারছে না গণমাধ্যম। তখন ফেসবুক লাইভে বলা হচ্ছে ‘মারা গেছে, নিপীড়ন’ হয়েছে! শিশু- কিশোররা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে।

যদি অন্য বাস্তবতা নাও থাকে, ইচ্ছে করলেই গণমাধ্যম তাৎক্ষণিকভাবে যে কোনো সংবাদ জানাতে পারে না। তথ্য যাচাইয়ের জন্যে সময় লাগে। অনুকূল পরিবেশ বিরাজমান থাকলে খুব বেশি সময় না নিয়ে তা করা যায়। অনুকূল পরিবেশের সবচেয়ে বড় অন্তরায় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল হেলমেট বাহিনী। পুলিশ কেন তাদের সঙ্গে নিয়ে গণমাধ্যমের জন্যে পরিবেশ প্রতিকূল করে তুলল? কেন হেলমেট বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলো না?

গণমাধ্যম যে প্রশ্ন তোলে, নীতি-নির্ধারকরা যদি সেই প্রশ্নের জবাব জনগণকে জানানোটা দায়িত্ব মনে করতেন, তবে  ‘গুজব’ এবং হেলমেটবাহিনীর দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পেত না। বাস্তবে নীতি- নির্ধারকরা গণমাধ্যমের উত্থাপিত প্রশ্নকে গুরুত্বই দিতে চান না।

হেলমেটের আড়ালে যারা মুখ ঢেকে তাণ্ডব চালাল, লাঠি-রড-চাপাতি-পিস্তল তারা লুকাতে পারেনি। সত্যের শক্তি এত বেশি যে, হেলমেটের আড়ালে তা লুকানো যায় না।

লুকানো মুখের পরিচিতি অজানা নয়, জানা অসম্ভব নয়।

কিন্তু সেদিকে আমাদের মনোযোগ নেই।

পুলিশ হেলমেট বাহিনীর কাউকে ধরল না, মামলা হলো না তাদের বিরুদ্ধে। পুলিশ ধরল শিক্ষার্থীদের। হাতকড়া পরিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধে থানায় নিলো। ধরল আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী- মানবতার পক্ষে সোচ্চার প্রতিবাদী শহিদুল আলমকে। পুলিশ ধরে রিমান্ডে নিলো, রক্ত ঝরাল। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ শিক্ষার্থীকেও রিমান্ডে নিলো। স্কুল শিক্ষার্থীদের শিল্পাঞ্চল থানা ঘেরাও করে সহপাঠীদের ছাড়িয়ে আনতে হলো।

‘গুজব’ নিয়ে হইচই করলাম, হেলমেট বাহিনী বিষয়ে নীরব থাকলাম। মুখের মতো ‘গুজব’ও তারা হেলমেটের আড়ালে রাখতে সক্ষম হলো।

বলছেন, সাংবাদিকদের কারা পিটিয়ে রক্তাক্ত করল, তালিকা দেন। তালিকা দেওয়া সাংবাদিকদের কাজ? তারপরও বলছি কোটা আন্দোলনের সময় হাতুড়ি বাহিনীর তালিকা কিন্তু ছবিসহ প্রকাশ করা হয়েছিল।

নীতি-নির্ধারকরা নির্বিকার থেকেছেন, ব্যবস্থা নেননি। এবারও হয়তো গণমাধ্যম আরও জানবে, জানাবেও। মূল কাজ যাদের তারা কি তা করবেন?

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

6h ago