একাই পথ হাঁটলেন মুক্তিযোদ্ধা রমা চৌধুরী

রমা চৌধুরী (১৯৩৬-২০১৮)

যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চল রে-- গানের এই কথাকে নিজের জীবনের চলার পথের আদর্শ ধরে নিয়ে হেঁটেছেন জননী সাহসিকা রমা চৌধুরী। হয়তো খুব কষ্ট বুকে নিয়ে, সমাজের মানুষগুলোর প্রতি গোপন অভিমান নিয়ে, জীবনের প্রতি একধরণের বিতৃষ্ণা নিয়ে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। কখনও কারো কাছে তিনি প্রকাশ করেননি তাঁর জীবনের দুঃখ, যন্ত্রণার কথা। সত্যি কথা বলতে বেঁচে থাকতে এ সমাজ তাঁকে যে সম্মান দেয়নি, মৃত্যুর পর আজ সবাই আমরা তাঁর কথা বলছি, তাঁকে সম্মান জানাচ্ছি। অথচ এই জন্মে জীবনে তিনি শুধু কষ্টই করে গেলেন।

ষাটের দশকের শুরুতে একজন বাঙালি নারীর পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি লাভ করা খুব সাধারণ কোন ঘটনা ছিল না। তিনি ছিলেন দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম নারী, যিনি এমএ পাস করেছিলেন। পাস করে রমা চৌধুরী বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষকতা পেশাকে। সেই সময়েই নারী স্বাধীনতার, নারীর নিজের পায়ে দাঁড়ানোর প্রতীক ছিলেন তিনি।

শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। এই যুদ্ধই বদলে দিল সেইসময়ের উজ্জ্বল তরুণী, তিন সন্তানের মা রমা চৌধুরীর জীবন। যুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন বাবার বাড়ি চট্টগ্রামের বোয়ালখালি থানার পোপাদিয়া গ্রামে। সঙ্গে ছিলেন মা আর ছোট তিন সন্তান। স্বামী চলে গিয়েছিলেন ভারতে। এরপরের ইতিহাস খুব বেদনাবহ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের বাড়িতে চড়াও হয়ে তাকে নিগৃহীত করে, অপমান করে। তারা রমা চৌধুরীকে তার সন্তান ও মায়ের সামনে তাঁকে চরমভাবে লাঞ্ছিত করে। শুধু নির্যাতন করেই ক্ষান্ত হয়নি। পাকিস্তানি বাহিনী তাদের বাড়িঘর পুরো জ্বালিয়ে দিয়েছিল। যাতে কোনভাবেই এই পরিবারটি বেঁচে না থাকে।

এরপরের ইতিহাস আরও কষ্টের, আরও বেদনার। নিজের সম্ভ্রম হারানোর ভয়ংকর ঘটনাকে আড়াল করে তিনি তিন শিশু সন্তান ও মাকে নিয়ে পথে পথে ঘুরেছেন, জঙ্গলে রাত্রি কাটিয়েছেন। সেসময় তিনি পাননি কোনো আশ্রয়, কোনো সহযোগিতা ও ভালোবাসা। যুদ্ধ থেমে গেলেও গেলে রমা চৌধুরীর জীবনের যুদ্ধ থামেনি। বরং তা বেড়েছে শতগুণ। এই সমাজ তাকে সহজভাবে গ্রহণ করেনি। চরম নিগ্রহ ও দারিদ্র্য তাঁকে এবং তাঁর পরিবারকে তছনছ করে দেয়। সাগর, টগর, টুনু পরপর তিন সন্তানকে হারিয়ে তিনি পাথর হয়ে পড়েন।

কিন্তু জীবনতো থেমে থাকেনা। বেঁচে থাকার জন্য শুরু করেন লেখালেখি। ‘একাত্তরের জননী’সহ ১৮টি বই লিখেছেন তিনি। বই লিখেছেন শুধু নয়, জীবিকার প্রয়োজনে এই বই ফেরি করে বেড়িয়েছেন পথে হেঁটে হেঁটে। ২০১৭ সাল সাল পর্যন্ত শারীরিক কষ্ট ও রোগব্যাধিকে অগ্রাহ্য করে তিনি বই ফেরি করে সংসার চালিয়েছেন। তাঁর যে ছেলেটি বেঁচে আছে, তাকে মানুষ করার চেষ্টা করেছেন। ২/৩ জন ছাড়া কেউ তাঁর পাশে ছিল না এই পুরোটা সময়। তিনি একাই পাড়ি দিয়েছেন দুর্গম পথ। পরে যখন বিভিন্ন দিক থেকে তাঁকে সহযোগিতার কথা বলা হয়েছিল, তিনি তা ফিরিয়ে দিয়েছেন। বোধকরি দুঃসময়ে তাঁর পাশে যে কেউ ছিল না, এই অভিমান তাঁর বুকে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল।

‘জননী সাহসিকা’ বলে খ্যাত রমা চৌধুরী শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধা নন। তিনি একজন মা। আর তাই তিন তিনটি সন্তান হারানোর ব্যথা তাঁকে ভেতরে ভেতরে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। এই সমাজের ভালবাসা না পেয়ে তাঁর সন্তানগুলো সব হারিয়ে গেছে। এই কথা উনি কখনো ভুলেননি। সেজন্য যতো কষ্টই হোক তিনি মাথা নত করেননি কখনো, হাত পাতেননি কারো কাছে। উনি খালি পায়ে হাঁটতেন। ৩০ বছর উনি খালি পায়ে হেঁটেছেন। মা বলতেন, যে মাটিতে আমার বাচ্চারা ঘুমিয়ে আছে, সে মাটির উপর দিয়ে আমি জুতো পায়ে হাঁটি কেমন করে?

জননী সাহসিকা কারো কাছে দয়া ভিক্ষা করেননি ঠিকই, কিন্তু আমরা, এই রাষ্ট্র কী করেছি তাঁর জন্য? যে দেশের স্বাধীনতার জন্য তিনি চরম অপমানের শিকার হলেন, সন্তান, ঘর-বাড়ি সব হারালেন, সেই দেশ তাঁকে কী দিয়েছে? নিতান্ত অবহেলা, অনাদর, অপমান? যে সম্মানে তাঁকে সম্মানিত করা উচিৎ ছিল, আমরা কি পেরেছি তাঁকে সেই সম্মান দিতে? না দেইনি। এজন্য রাষ্ট্রের লজ্জিত হওয়া উচিত। আমাদের লজ্জিত হওয়া উচিত।

১৯৭১ এ যে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন এই অসম সাহসী নারী, সেই যুদ্ধ তাঁর শেষ হল ৭৯ বছর বয়সে এসে। ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ তে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বেশ কিছুদিন ধরেই বিভিন্ন ধরণের শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন। এই শরীর আর কত চাপ সহ্য করবে। তাই ছেলেদের সঙ্গে মিলে গেলেন জীবনের সব পাওয়া-না পাওয়াকে অগ্রাহ্য করে। শুধু বেঁচে থাকলো তাঁর একমাত্র ছেলে গওহর চৌধুরী। আমরা কি পারি না রমা চৌধুরীর মতো এইসব অকুতোভয় মানুষের জীবদ্দশায় তাঁদের পাশে এসে দাঁড়াতে?

লেখক: যোগাযোগকর্মী

Comments

The Daily Star  | English

Election possible a week before Ramadan next year: Yunus tells Tarique

He said it will be possible if preparations completed, sufficient progress made in reforms and judicial matters

1h ago