বাংলাদেশের টিম স্পিরিটের ঝাঁজে উড়ে গেল শ্রীলঙ্কা

শুরুর বিপর্যয়ের পর তামিম ইকবালের চোটে পড়া, ভীষণ চাপে মুশফিকুর রহিম আর মোহাম্মদ মিঠুনের দৃঢ়তা। মুশফিকের দারুণ সেঞ্চুরি আর কব্জিতে চিড় নিয়েও দলের প্রয়োজনে তামিমের বিস্ময়কর নিবেদন। পরে লড়াইয়ের পূজি পেয়ে শরীরী ভাষায় আগুন ঝরানো বোলিং-ফিল্ডিংয়ে শ্রীলঙ্কাকে ধসিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ।
ছবি: এএফপি

শুরুর বিপর্যয়ের পর তামিম ইকবালের চোটে পড়া, ভীষণ চাপে মুশফিকুর রহিম আর মোহাম্মদ মিঠুনের দৃঢ়তা। মুশফিকের দারুণ সেঞ্চুরি আর কব্জিতে চিড় নিয়েও দলের প্রয়োজনে তামিমের বিস্ময়কর নিবেদন। পরে লড়াইয়ের পূজি পেয়ে শরীরী ভাষায় আগুন ঝরানো বোলিং-ফিল্ডিংয়ে শ্রীলঙ্কাকে ধসিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ।

শনিবার দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের করা ২৬১ রানের জবাবে লঙ্কানরা গুটিয়ে গেছে  ১২৪ রানে।  ১৩৭ রানের বিশাল ব্যবধানে  জিতে তাই এশিয়া কাপের দারুণ শুরু পেয়েছে বাংলাদেশ। এতে ‘বি’ গ্রুপে নিজেদের প্রথম ম্যাচ জিতে পরের রাউন্ডে উঠার পথেও অনেকখানিই এগিয়ে গেল মাশরাফি মর্তুজার দল।

৩২ রানে শ্রীলঙ্কার তৃতীয় উইকেট পড়ার পর প্রেসবক্সের ডায়নিংয়ে পাকিস্তানি সাংবাদিকরা নিজেদের মধ্যে আলাপে বলছিলেন, ‘বেঙ্গল টাইগার রয়ার’, অদূরে বসে এই ম্যাচ নিয়ে গল্প করছিলেন লঙ্কান সাবেক ক্রিকেটার কুমার সাঙ্গাকারা আর আফগানিস্তান কোচ ফিল সিমন্স। সিমন্সের মতে বাংলাদেশ আসলে মোমেন্টাম পেয়ে গেছে আগেই। আর সেই মোমেন্টাম এনে দিয়েছে তামিমের ওই সাহসী নেমে পড়ার সিদ্ধান্ত, ভীষণ চাপে মুশফিকের বীরত্ব। তাদের সঙ্গে দ্বিমতের উপায় কার?  

শেষ উইকেটে মহামূল্যবান ৩২ রান। ওই ৩২ রান তখন যেন ১০০ রানের চেয়েও বেশি জ্বালানি দিল। তার থেকে তেজ নিয়ে বোলিং-ফিল্ডিংয়ে তেতে উঠার রসদ জোগাড় বাংলাদেশের। ক্রিকেট ম্যাচ কেবলই ব্যাট-বলের খেলা নয়। খেলাটি মনস্তাত্ত্বিকও। মানসিকভাবে এগিয়ে থাকলে অনেক সীমাবদ্ধতাই জেতা যায়। সেটা দেখা গেল আরও একবার। আসলে মোমেন্টাম পেয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশের ছিল এগিয়ে যাওয়ারই পথ। সেখানে মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মত বিশেষ কিছু করতে পারেনি লঙ্কানরা।  

অথচ ম্যাচের শুরুতে জমেছিল শঙ্কার কালোমেঘ। লাসিথ মালিঙ্গার রাজসিক প্রত্যাবর্তনে প্রথম ওভারেই ১ রানে ২ উইকেট নেই। পরের ওভারে চোটে পড়ে নেই তামিমও। আর কি থাকে বাকি। টেনেটুনে দুশো পারই তখন  সূদুরের পথ। দৃঢ় মনোবল আর সর্বোচ্চ নিবেদন নিয়ে নামা মুশফিকুর রহিম-মোহাম্মদ  মিঠুন হয়ত ভেবেছিলেন ভিন্ন। শুরুর অস্বস্তি কাটিয়ে ধীরে ধীরে মেঘ সরিয়ে জ্বেলেছেন আলো। তাদের জমাট জুটিতেই মূল ভীত।

ম্যাচের আগের দিন টস জেতা নিয়ে অনেক ভাবনায় ছিলেন অধিনায়ক। ভাগ্য তাকে নিরাশ করেনি। টস জিতে কাঙ্খিত ব্যাটিং নেওয়ারই সুযোগ পেয়েছেন । কিন্তু শুরুটা হয় ভয়াবহ। মালিঙ্গার প্রথম ওভারে রানের খাতা খোলার আগেই ফেরেন লিটন দাস ও সাকিব আল হাসান। ৪ বল খেলে খোঁচে মেরে স্লিপে ক্যাচ দেন লিটন। পরের বলেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মালিঙ্গাকে রাজসিক প্রত্যাবর্তন করিয়ে ক্যারিয়ারের পঞ্চমবারের মতো গোল্ডেন ডাক পান সাকিব।

১ রানে দুই উইকেট হারিয়ে ধুঁকতে থাকা দলের উপর খাড়ার গা হয়ে আসে তামিমের চোট। দ্বিতীয় ওভারে সুরাঙ্গা লাকমালের বলে বা হাতের কব্জিতে চোট পান তামিম। যেতে হয় হাসপাতাল। ফেরার কোন সম্ভাবনা না থাকলেও পরে বিস্ময়কর ওই ফেরা। যার গল্প হয়ত অনেকদিন করবেন ভক্ত সমর্থকরা।  

৩ রানে টপ অর্ডারে তিন ব্যাটসম্যান খুইয়ে দিশেহারা বাংলাদেশ দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়ায় মুশফিকুর রহিম আর মোহাম্মদ মিঠুনের জুটিতে।

শুরুতে নড়বড়ে ছিলেন দুজনেই। ১ রানে মালিঙ্গার বলে ক্যাচ দিয়ে বাঁচেন মিঠুন। ১০ রানে থিসিরা পেরেরার বলে জীবন পান মুশফিকও। তবে এরপরই তারা খেলেছেন অনায়াসে। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ৫২ বলে প্রথম ফিফটি তুলে নেন মিঠুন। মুশফিকের ফিফটি আসে ৬৬ বলে। ১৪২ বলে ১৩১ রানের জুটিতে তখন আশার বেলুন উড়তে শুরু করেছে। আপিলা আপনসো আর দিলরুয়ান পেরেরাকে দারুণ দুই ছক্কায় মিঠুন দেখাচ্ছিলেন আরও বড় কিছুর ইঙ্গিত। মিঠুনের সেই উচ্চবিলাস আক্রমণে ফিরে থামান মালিঙ্গাই । অফ স্টাম্পের বাইরের লেন্থ বল আড়াআড়ি খেলতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দেন আকাশে।

এরপর আবারও বিপর্যয়। ছয়ে নেমে হতাশ করেন মাহমুদউল্লাহ। আপনসোকে ক্যাচ দিয়ে ফেরার আগে করতে পেরেছেন ১ রান। খানিকপর  মালিঙ্গার লেগ স্টাম্পের উপরের বলে বাজে শট উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন মোসাদ্দেক। কিছুক্ষণ  মুশফিককে সঙ্গ দেয়ার চেষ্টা করেছেন মেহেদী হাসান মিরাজ। জুটিতে ৩৩ রান আসার পর লাকমালকে ক্যাচ দিয়ে থামেন তিনি। বাকি পথটা মূলত একাই টেনেছেন ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’ মুশফিক। ১৪৪ বলের ইনিংসে ১১ চারের সঙ্গে মেরেছেন চারটি ছক্কা। রান বাড়াতে খেলেছেন সব বাহারি শট। সবচেয়ে দেখার মতো ছিল চোয়ালবদ্ধ নিবেদন। চরম বিপর্যয়েও হার না মানার মানসিকতা। মুশফিক আরও একবার চিনিয়েছেন নিজের জাত।

দুবাইরের ব্যাটিং উইকেটে ২৬২ রান তবু তাড়া করার মতই স্কোর ছিল। প্রথম ওভারে উড়ন্ত শুরুর পর ২২ রানে প্রথম ধাক্কা খায় শ্রীলঙ্কা। মোস্তাফিজের বলে প্রথমে কুশল মেন্ডিসের এলবডব্লিওর আবেদনে সাড়া দেননি আম্পায়ার। রিভিউ নিয়ে ফল পান মাশরাফি। তখনও  চোখ রাঙাচ্ছিলেন উপুল থারাঙ্গা। মাশরাফিকে প্রথম ওভারেই ছয়-চার দিয়ে তার শুরু। শোধ তুলতে দেরি করেননি বাংলাদেশ অধিনায়ক। মাশরাফির বলে কাট করতে গিয়ে গেছে তার স্টাম্প। চার রান পরই ধনঞ্জয়া ডি সিলভাকে এলবডব্লিও করে আবার আঘাত মাশরাফির। ৩২ রানে লঙ্কানদের পড়ে যায় ৩ উইকেট। আক্রমণে এসে দ্বিতীয় ওভারেই সাফল্য পান মেহেদী হাসান মিরাজ। কুশল পেরেরা তার বল বুঝতে না পেরে হয়েছেন কুপোকাত। ৩৮ রানে ৪।  ৫৭ রানে সহজ ক্যাচ তুলে দিয়ে বেঁচে গিয়েছিলেন দাসুন শানাকা। তাতে খুব ক্ষতি হয়নি। ৩ রান পরই রান আউটে শেষ হয় তার ইনিংস।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর থেকেই ওয়ানডেতে ছন্দে বল করতে থাকা মেহেদী হাসান মিরাজ এবারও ছিলেন কিপটে। তার বলে রান নেওয়ার তাড়ায় হাঁসফাঁস করতে করতে উইকেট ছুড়ে দেন থিসিরা পেরেরা।  

লঙ্কানদের জেতার আশা তখনই প্রায় নিভু নিভু। বাকিটা সময় ছড়ি ঘুরিয়ে একের পর এক উইকেট তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ। ৬৯ রানে ৭ উইকেট পড়ার পর ম্যাচের উত্তেজনাও প্রায় শেষ। দিলরুয়ান পেরেরা আর সুরাঙ্গা লাকমাল মিলে ব্যবধান কমিয়েছেন। আক্রমণে ফিরে টেল এন্ডারদের ম্যাচ লম্বা করার চেষ্টা পণ্ড করেন মোস্তাফিজ।

শেষ দুই উইকেট ভাগাভাগি করেছে খেলা ম্যাচের ইতি টেনেছেন মোসাদ্দেক ও সাকিব।  

 

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

বাংলাদেশ: ২৬১/১০  (৪৯.৩) (তামিম ২*, লিটন ০, সাকিব ০, মুশফিক ১৪৪, মিঠুন ৬৩, মাহমুদউল্লাহ ১, মোসাদ্দেক ১, মিরাজ ১৫, মাশরাফি ১১, রুবেল ২, মোস্তাফিজ ১০; মালিঙ্গা ৪/২৩, লাকমাল ১/৪৬, আপনসো ১/৫৫, পেরেরা ১/৫১, দিলরুয়ান ০/২৫, ডি সিলভা ২/৩৮, শানাকা ০/১৯)

শ্রীলঙ্কা:  ১২৪/১০    (থারাঙ্গা ২৭, মেন্ডিস ০, পেরেরা ১১, ডি সিলভা ০, ম্যাথুস ১৬, শানাকা ৭, থিসারা ৬, দিলরুয়ান ২৯, লাকমাল ২০, আপনসো ৪ , মালিঙ্গা ৩  ;  মাশরাফি ২/২৫,  মোস্তাফিজ ২/২০  , মিরাজ ২/২১, সাকিব ১/৩১, রুবেল ১/১৮, মোসাদ্দেক ১/৮ )

ফল: বাংলাদেশ ১৩৭  রানে জয়ী।

ম্যান অব দ্য ম্যাচ: মুশফিকুর রহিম।

 

 

 

 

Comments

The Daily Star  | English

Dhaka, Delhi ties should be based on equity: Prof Yunus

Chief Adviser Prof Muhammad Yunus today said they need to maintain good relations with India but that should be based on equity and fairness

43m ago