'দেশের জন্য কিছু করতে চাওয়ার ভীষণ তাগিদ থেকে এটা হয়েছে'
ফিজিও মাঠে নামতে কড়া বারণ করেছিলেন, কোচও দিয়েছিলেন সতর্কবার্তা। তামিম ইকবালকে ওই অবস্থায় নেমে যেতে উজ্জীবিত করেছিলেন কেবল অধিনায়ক মাশরাফি মর্তুজা। সেই উদ্দীপনা পেয়ে অন্য জগতেই চলে যান তিনি। তাকে পেয়ে বসে দেশের জন্য কিছু একটা করে দেখানোর আবেগ। তার বীরত্বের প্রশংসা চারিদিকে তবু রোববার দুবাইয়ের হোটেল ইন্টারকন্টিনেটালের রেস্টুরেন্টে বিমর্ষ মন নিয়েই তামিম শুনিয়েছেন সেদিনের গল্প।
দুই হাতে এই নিয়ে মোট সাতবার চোটে পড়লেন। আঙুল গুনে নিজেই তা জানাচ্ছিলেন। কণ্ঠে তখন আরও বড় কিছু করতে না পারার খেদ। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর থেকে দারুণ ছন্দে থাকায় এশিয়া কাপ নিয়ে ব্যক্তিগত লক্ষ্য ছিল। কিছুই আর হচ্ছে না আপাতত। মন দমে যাওয়া তাই স্বাভাবিকই। মাত্র ৪ বলে ২ রানের ইনিংসেই যে দলের জয়ে বড় অবদান রেখে ফেলেছেন। নিবেদনের এই নজিরও তাকে নিয়ে গেছে ঘোরের মধ্যে।
জীবনে বহুবার হিরো হয়েছেন এবারের হিরোইজমটা ভিন্নমাত্রার। এটা কেমন উপভোগ করছেন?
তামিম: সত্যি কথা আমি মোটেও উপভোগ করছি না। আমি অসম্ভব হতাশ। ১০ বছরের ক্যারিয়ারে মনে হয় না আমি এত বেশি আর হতাশ হয়েছি। প্রথম হলো যে, আমি খুব ভাল অবস্থায় ছিলাম। সবারই আকাঙ্ক্ষা থাকে, আমারও সেরকম ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ইনজুরির কারণে বেরিয়ে যেতে হচ্ছে। যেটা আমার জন্য খুব দুঃখনজক। কাল রাত থেকে আমার মন টন আসলেই অসম্ভব খারাপ।
যে জিনিস কাল হয়েছে। আমার মনে হচ্ছিল যে আমি আর অংশ থাকছি না (এশিয়া কাপের)। আমি তো আর কিছু করতে পারব না। কাজেই যতটুক করা সম্ভব আমার জন্য আমি ঠিক ততটুকুই করেছি। এক বলের কারণে জুটি হয়েছে এসব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। কিন্তু দিনশেষে আমি হৃদয়ভাঙা মানুষ।
হাসপাতাল থেকে ফিরে দলের কি অবস্থা দেখেছিলেন?
তামিম: আমি হাসপাতালে যখন ছিলাম তখন ভাল জমেছিল মিঠুন আর মুশফিকের জুটি। আমি আসার পর দুই-তিনটা উইকেট পড়ে গেল বাংলাদেশের। তখন ফিজিওকে জানানোর দরকার ছিল (ফ্র্যাকচারের কথা) । তখন মাশরাফি ভাই আমাকে বলল, ‘মুশফিক থাকলে ব্যাটিংয়ে যাস’। আমি প্রথমে মনে করেছি ফাজলামি করছে আমার সঙ্গে। তারপর আরও এক-দুইবার যখন বলল চিন্তা করলাম, যদি শেষ ওভার থাকে, আর আমি যদি স্ট্রাইকে না থাকি তাহলে আমি যেতেই পারি। আমি ওখানে গিয়া দাঁড়ায়ে থাকব, আমাকে কিছু করতে হবে না। তখনও শেষ ওভারের আরও ২০ ওভার বাকি ছিল। ভেরি আনলাইকলি সিনারি। কারণ আমাদের অনেক উইকেটও পড়ে গিয়েছিল। এরকম খেলতে খেলতে রুবেলরা যখন খেলে গেল তখন আর তিন ওভার আছে। তখন বলছি ঠিকাছে
রুবেল ব্যাটিং করার সময়ই আমি প্যাডআপ করে ফেলেছি। তখন পর্যন্ত কথা ছিল যে মুশফিক যদি স্ট্রাইকে থাকে আমি যাব। ফিজিও বলছিল আমি দৌঁড়াতেও পারব না। ফিজিও কোনভাবে অনুমতি দিচ্ছিল না মাঠে যাওয়ার জন্য। এক পর্যায়ে আসলে এটা ব্যক্তির উপর এসে যায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য।
এরকম যাওয়ার চিন্তা কার ছিল?
তামিম: প্রথমে আইডিয়া ছিল মাশরাফি ভাইয়ের। উনি যেভাবে আমাকে বলছিলেন, ওটাতেও আমি অনেক উজ্জীবিত হয়েছি। উনি আমার গ্লাভস কেটে দিলেন, আমার গার্ড (অবডমিনাল গার্ড) পরিয়ে দিলেন (হাসি) , প্যাড মুমিনুল পরিয়ে দিয়েছে। ইতিহাসের প্রথমবারের মতো বোধহয় একটা প্লেয়ার আরেকটা প্লেয়ারের গার্ড পরিয়ে দিয়েছে যেটা সম্ভব না পরানো। তখন আমার কাছে মনে হয়েছে যে আমি পারব। কোচ এসে বলেছে, যে তোমার যাওয়ার দরকার নেই। আমি বললাম, না আমি এক বল খেলে নিতে পারব। সে তখন বলছে যে বুঝে নাও, এটা তোমার সিদ্ধান্ত।
আমার কাছে মনে হয়েছে ওই ১০-১৫ সেকেন্ডের জন্য যে ফ্রেম অফ মাইন্ডে ছিলাম। আমার কাছে মনে হয় দুনিয়ার যে বোলারই থাকুক। আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করতাম ওই বলটা খেলার।
ওভারের শেষ বলগুলোতে যদি মুশফিক সিঙ্গেল বের না করতে পারতেন...?
তামিম: মাঠে যাওয়ার আগে তো কথা ছিল আমি এক বলও খেলব না। আমি দৌড়াবও না। ফ্র্যাকচার হলে দেখবেন নড়াচড়া করা যায় না, হাতটা স্থির রাখতে হয় তাই দৌড়ানও রিস্কি ছিল। যখন মাঠে চলে গেছি তখন আর কোন কিছু চিন্তা করিনি। যেমন আজকে হাইলাইটস দেখলাম, দেখবেন আমি হাতটা পেছনে রেখে ব্যাট করেছি। ঠিক খেলার সময় হাতটা এমনিতে সামনে এসে যায়। যদি বলটা মিস হতো তাহলে...এসব জিনিস আসলে চিন্তা করছিলাম না। আসলে বললাম না ওই যে ১৫-২০ সেকেন্ডের জন্য আলাদা একটা ফ্রেম অব মাইন্ড তৈরি হয়ে যায়। আমার মাইন্ডসেটটা একটু অন্য লেভেলের ছিল। আমি জানি না কেন। খুব আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমার কাছে মনে হয়েছে এশিয়া কাপে এটাই আমার শেষ বল। এটা যদি দলকে ১০ রানও আনত...আমি কখনো আশা করিনি ৩০-৩২ রান আসবে, কেউই করেনি। মুশফিক অবিশ্বাস্য কিছু শট খেলেছে। ওই পরিস্থিতিতে মুশফিকের কথা চিন্তা করেন। সে জানত সব বলই তাকে খেলতে হবে। ওইরকম পরিস্থিতিতে ৩২ রান শতরানের সমান। আমি চিন্তা করছিলাম যদি দুই রান, তিন রান বা ছয় রানও আসে, তাও অনেক কারণ ওই ছয় রান তো ওদের করতে হবে।
মনোযোগ রাখতে পেরেছিলেন?
তামিম: এটা খুব আবেগী সময় ছিল। দেশের জন্য কিছু করতে চাওয়ার ভীষণ তাগিদ থেকে এটা হয়েছে। ওইরকম আবেগই বেরিয়ে এসেছে। আমি জানি যে সবাই আমার কাছে ফিফটি বা সেঞ্চুরি চায় কিন্তু ওই একটা বল... (চেহারায় তন্ময় ভাব)
ক্রিজে গিয়ে মুশফিককে কি বলছিলেন
তামিম: আমি ওকে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করেছিলাম। বলছিলাম যে কিপ গোয়িং, কিপ গোয়িং...আমি এটাই বলার চেষ্টা করছিলাম সব বলে মারার দরকার নাই। বুদ্ধি করে মার। কারণ সব বলে মারতে গেলে তাড়াতাড়ি আউট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকত। দেখবেন সে সব ক্রিকেটিং শট খেলেছে উইথ গ্রেট মাইন্ড সেট।
মুশফিক আপনাকে দেখে কি বলেছিলেন?
তামিম: ও বুঝেই নাই যে আমি এক হাতে ব্যাটিং করছি। ও কাল আমাকে বলছে, ‘আমি বুঝি নাই তুই এক হাতে ব্যাট করেছিস’, আমি মনে করেছিলাম দুই মনে হয় এক হাতের সাপোর্ট নিয়ে...আমার হাতে যখন বল লাগে সবচেয়ে আগে তো ও দেখছে। দেখে তো ও ভয় পেয়ে গেছিল। ও বুঝতে পারেনি আমার হাতের অবস্থা এরকম যে নামাইতেই পারব না।
শ্রীলঙ্কানরা তো হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল?
তামিম: আসলে তখনই সব মোমেন্টাম আমাদের পক্ষে এসে গেছে। এটা বিপুলভাবে উজ্জীবিত করে দেয় গোটা দলকে। যদি দেখে প্রথম দুই উইকেট যদি আর্লি পড়তও তাতেও তাদের ২৩০ তাড়া করতে হতো। কিন্তু ২৬০ এটা ভিন্ন কিছু দিয়েছে।
ক্রিকেটে এরকম বীরত্ব দেখানোর উদাহরণ আরও আছে, সেসব ভেবে নেমেছিলেন?
তামিম: এখন যেভাবে করে মানুষ এপ্রিশিয়েট করতেছে, অনেক রকম ভাবছে। আমার মাথায় কিছুই ছিল না। আমি কোন পরিকল্পনা করিনি। এমন না যে এটা করলে আমার অনেক নাম হবে ইত্যাদি। যেটা বললাম এটা হৃদয় থেকে এসেছে আর কিছু না। দেশের জন্য আমি কিছু একটা করতে চেয়েছি।
মুশফিকের ব্যাটিং কেমন লাগল?
তামিম: আমি ওর ব্যাটিংই দেখিনি। এমনকি ও যখন ছয়-চার মারছিল, আমি ক্রিযে ছিলাম যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন কোন বলে কি হয়েছে আমি বলতে পারব না। আমি আসলে তখন ভিন্ন জগতে চলে গেছি। আমার খালি একটাই মনে হচ্ছিল পাঁচটা বল হওয়ার পর দৌড়ে আমাকে ওই প্রান্তে যেতে হবে।
Comments