ডিবি পরিচয়ে অপকর্মকারী কারা?

পূর্বাচল থেকে গুলিবিদ্ধ তিন যুবকের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। পরিচয়ও মিলেছে তিন যুবকের। কারা, কেন, কী কারণে তাদের গুলি করে হত্যা করল, কিছুই জানা যায়নি। পুলিশ কোনো ক্লু পাচ্ছে না।
কক্সবাজারে ২০১৭ সালের ২৫ অক্টোবর মুক্তিপণ হিসেবে আদায় করা ১৭ লাখ টাকাসহ গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) এই সদস্যরা সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েছিল। ছবি: সংগৃহীত

পূর্বাচল থেকে গুলিবিদ্ধ তিন যুবকের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। পরিচয়ও মিলেছে তিন যুবকের। কারা, কেন, কী কারণে তাদের গুলি করে হত্যা করল, কিছুই জানা যায়নি। পুলিশ কোনো ক্লু পাচ্ছে না।

ক্লু নিয়ে সামনে এলেন নিহতদের পরিবার। পরিবার সূত্রে জানা গেল, ১২ সেপ্টেম্বর রাতে পাটুরিয়া ফেরিঘাট থেকে যুবকদের তুলে নেওয়া হয়েছিল। ডিবির জ্যাকেট পরা পাঁচ-ছয় জন তাদের তুলে নিয়েছিল। তুলে নেওয়ার সময় তারা মানিকগঞ্জের ডিবি বলে পরিচয় দিয়েছিল। সন্ধান করতে গিয়ে পরিবারের সদস্যরা ফেরিঘাটের প্রত্যক্ষদর্শীদের থেকে এসব তথ্য জেনেছেন। পূর্বাচলে তাদেরই লাশ পাওয়া গেছে ১৪ সেপ্টেম্বর।

পুরনো কিছু প্রশ্ন আবার নতুন করে সামনে এসেছে। রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য গোয়েন্দা পুলিশ ডিবি কেন মানুষকে তুলে নিবে, কেনই বা হত্যা করবে? এটা তো বিশ্বাসযোগ্য কোনো কথা হতে পারে না। তাহলে ডিবি পরিচয়ে কারা মানুষকে তুলে নিচ্ছে, হত্যা করছে?

এই প্রশ্নটি ডিবি পুলিশের ভেতরে আসছে কি না, নিশ্চিত নই। তবে সংবাদকর্মী থেকে সাধারণ জনমানুষের ভেতরে ‘প্রশ্ন- আতঙ্ক’ বড়ভাবে কাজ করছে।

নানা কারণে আমরা তো পুরনো ঘটনাগুলো মনে রাখতে পারি না। মনে করার জন্যে ‘ডিবি’ লিখে যদি একটু গুগলের আশ্রয় নেন, তবে অসংখ্য সংবাদের সন্ধান পাবেন। তার কয়েকটি শিরোনাম-

‘ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়ার পর ৫ জন নিখোঁজ’

‘ডিবি পরিচয়ে এক নারীকে তুলে নিয়ে এক লাখ টাকা চাঁদা দাবি’

‘চাঁদা দাবি, চট্টগ্রামে ৮ ডিবি পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা’

‘ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া ব্যবসায়ীর লাশ উদ্ধার’

‘ডিবি পরিচয়ে টাকা ছিনতাইয়ের চেষ্টা, এসআইসহ ৬ পুলিশ সদস্য প্রত্যাহার’

এমন আরও বহু শিরোনাম তুলে ধরা যায়, দেওয়া যায় বিস্তারিত বিবরণ। তা দিয়ে লেখার পরিধি বাড়ানোর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এসব সংবাদ সত্য, না অসত্য? ডিবির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার জন্যে বিশেষ কোনো মহল, এসব অপকর্ম করছে কি না?

প্রশ্নগুলোর উত্তরের সন্ধান করা ডিবিরই দায়িত্ব। সংবাদগুলো অসত্য হলে তা দেশের মানুষকে জানানো দরকার। বিশেষ কোনো মহল এসব করে থাকলে, তাদের সন্ধান- ধরাও ডিবিরই দায়িত্ব। এই কাজ ডিবি করছে কি না? যত জোর দিয়ে করা প্রত্যাশিত তা করছে কি না?

একেবারে করছে না, তা বলা যাবে না। বেশ কিছু ‘ভুয়া ডিবি’ বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি। ‘ভুয়া ডিবি’ গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাবও। যারা ডিবি পরিচয় দিয়ে চাঁদাবাজি ছিনতাই করেছে বা করার চেষ্টা করেছে।

তবে ডিবির বিরুদ্ধে যত বড় অভিযোগ, রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা পুলিশের ভাবমূর্তি জনমনে যে গতিতে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, সেই গতিতে ও আন্তরিকতায় ডিবি পুলিশকে তৎপর হতে দেখা গেছে, তা বলা যাবে বলে মনে হয় না। ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া বা অপহরণের একটি অভিযোগ আসার পরে, কখনো বলা হয়েছে ‘আমরা করিনি’।

কখনো কোনো কিছু না বলে চুপ থাকা হয়েছে।

তিনটি ঘটনা সুনির্দিষ্ট করে উল্লেখ করছি।

ক. কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতাদের ঢাকা মেডিকেলের সামনে থেকে টেনে হেঁচড়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ এসেছিল ডিবির বিরুদ্ধে। কয়েক ঘণ্টা নানা শঙ্কা চলল। তারপর ডিবির পক্ষ থেকে বলা হলো, তুলে আনা হয়নি- তথ্য জানার জন্যে তাদের ডিবি কার্যালয়ে আনা হয়েছিল।

খ. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামসুন্নাহার হলের সামনে থেকে একজন ছাত্রীকে তুলে নিয়ে গেল ডিবি। বিশ্ববিদ্যালয়সহ সর্বত্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল।

গ. নারায়ণগঞ্জ ছাত্রদল সভাপতিকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ এলো ১৫ সেপ্টেম্বর। দুই দিন পর পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হলো ১৭ সেপ্টেম্বর রনিকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করা হয়েছে।

দুইটি ক্ষেত্রে যাদের তুলে নেওয়া হয়েছিল, কয়েক ঘণ্টা পর তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। প্রশ্ন হলো ‘তুলে নেওয়া’র দায় ডিবি নিলো কেন? কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী নেতারা আত্মগোপনে ছিলেন না। তথ্য জানার জন্যে তাদের ডাকা যেতে পারত। সাড়া না দিলে, অন্য ব্যবস্থার কথা নিশ্চয় ভাবা যেত।

শামসুননাহার হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ছাত্রী থাকেন, তাকে জিজ্ঞাসাবাদের তো বহুবিধ পথ ছিল। হল প্রভোস্টের কার্যালয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা যেত। অভিযোগ খুব গুরুতর হলে তাকে নিশ্চয়ই ডিবি কার্যালয়েও নিয়ে যাওয়া যেত। তা না করে সন্ধ্যার পর ক্যাম্পাস থেকে একজন ছাত্রীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার আতঙ্ক ছড়ানোর দায় ডিবি কেন নিলো?

রনিকে যদি ১৭ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করা হয়ে থাকে, তবে ১৫ সেপ্টেম্বর ডিবির বিরুদ্ধে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ এলো কেন? ডিবি কি তা তদন্ত করেছে, করবে?

মানুষের কাছে যখন এসব প্রশ্নের উত্তর থাকে না, তখন সামনে যে সংবাদ আসে - সবই বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়ে যায়। সত্য-অসত্য-গুজব যাই হোক না কেন।

সেই বিশ্বাসযোগ্যতা পোক্ত হয়ে যায়, যখন সুনির্দিষ্ট কিছু সত্যতা মানুষের সামনে আসে। তেমন দুইটি ঘটনা-

ঘটনা এক: ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাতে ধরা পড়লেন ১১ জন ডিবি সদস্য। যারা কাফরুলের একটি ক্লাবে র‍্যাব পরিচয়ে চাঁদাবাজি করে ফিরছিলেন। ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসের এই ঘটনা ফলাও করে গণমাধ্যমে প্রচার হয়েছিল।

ঘটনা দুই: কক্সবাজারের এক ব্যবসায়ীকে জিম্মি করে ১৭ লাখ টাকা আদায় করেছিল ডিবি সদস্যরা। মাইক্রোবাসযোগে ফেরার পথে টাকাসহ ৬ ডিবি সদস্যকে আটক করে সেনা সদস্যরা। এটাও ২০১৭ সালের ঘটনা।

ডিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে এমন সব অভিযোগ আসছে, যা অকল্পনীয়। নারায়ণগঞ্জে ৭ অপহরণ হত্যা র‍্যাব কর্তৃক সংঘটিত, এই সত্য জানার পর মানুষের কাছে কোনো কিছুই যেন আর অবিশ্বাস্য মনে হয় না। তার বিচার চলছে। বলা হয় ‘কাউকে ছাড় দেওয়া’ হচ্ছে না। ডিবি বলবে, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সেই ব্যবস্থা মানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘প্রত্যাহার’ এবং কিছুদিন পর আবার পদায়ন। পুরো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবশ্যই অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। আবার একথাও স্বীকার করতে হবে যে, ডিবি বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্য অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিছু সংখ্যকের দায় পুরো বাহিনী নেবে কি না, নিতে হবে কি না?

শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে শৈথিল্য দৃশ্যমান হলে, কিছু সংখ্যকের দায় পুরো বাহিনীকে বহন করতে হয়।

চাঁদাবাজি- খুন- ইয়াবাসহ মাদক চোরাচালানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে ডিবি- আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

গাইবান্ধার সাঁওতাল পল্লীতে আগুন দেওয়ার অভিযোগ যখন পুলিশের বিরুদ্ধে উঠছে, পুলিশি তদন্তে তার প্রমাণ মিলছে না। একজন বা দুইজন পুলিশ সাঁওতালদের ঘরে আগুন দিচ্ছে, অনেক পুলিশ দাঁড়িয়ে তা দেখছে, আগুন দেওয়ায় সহায়তা করছে-এই ভিডিও চিত্র সামনে আসার পরে কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে ‘প্রত্যাহার’ করা হচ্ছে।

অপহৃত হওয়ার পর যারা ফিরে এসেছেন, কারা তাদের অপহরণ করেছিল, তা অনুসন্ধান করতে দেখা যায়নি।

পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হলো ১২ জন শিক্ষার্থীকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়েছিল ৫ সেপ্টেম্বর। ডিবি তাদের আদালতে হাজির করেছে ৫ দিন পর ১০ সেপ্টেম্বর। ৫ সেপ্টেম্বর যে তাদের তুলে নেওয়া হয়েছিল, তা ডিবি স্বীকার না করে বলেছে ৯ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করেছে। পরিবারের না ডিবির, কার বক্তব্য সত্য? মানুষ ভেবে নিচ্ছেন তার মতো করে।

এমন বাস্তবতায় ডিবি পরিচয়ে তুলে নেওয়া মানুষের লাশ পাওয়া যাওয়ার সংবাদ, মানুষের মনে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া জন্ম দেয়, ডিবি বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী সম্পর্কে মানুষের মনোভাব কেমন হয়, নীতি- নির্ধারকদের জন্যে তা জানাটা কি অতি জরুরি নয়?

Comments

The Daily Star  | English
Gazipur factory fire September 2024

Column by Mahfuz Anam: Business community's voice needed in the interim government

It is necessary for keeping the wheels of growth running and attracting foreign investment in the new Bangladesh.

10h ago