রোমাঞ্চকর ম্যাচ জিতে টিকে রইল বাংলাদেশ
জিততে হলে শেষ ওভারে আফগানিস্তানের দরকার ছিল ৮ রান। হাতে চার উইকেট আর স্বীকৃত ব্যাটসম্যান থাকায় কাজটা কঠিন ছিল না। মোস্তাফিজের প্রথম বলে এলো দুই রান। পরের বলেই পান রশিদ খানের উইকেট। তৃতীয় বলে লেগ বাই থেকে এক রান, চতুর্থ বলে কাটারে পরাস্ত গুলবদিন নাইব। পঞ্চম বলে কোনমতে লেগ বাই থেকে এলো আরও এক। শেষ বলের সমীকরণ দাঁড়াল জিততে হলে শেনওয়ারিকে মারতে হবে বাউন্ডারি। মোস্তাফিজের দারুণ বলে আবারও পরাস্ত হলেন তিনি। এবার স্নায়ু পরীক্ষায় জিতল বাংলাদেশ। জেতালেন কাটার মাস্টার মোস্তাফিজুর রহমান। শেষ ওভার আর শেষ বলে হারের ক্ষত থেকে বেরিয়ে আসার কিছুটা যেন উপশম।
রোববার আবুধাবির শেখ জায়েদ ক্রিকেট স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের করা ২৪৯ রানের জবাবে ২৪৬ রানে থেমেছে আফগানিস্তান। বিদায় নিয়েছে এশিয়া কাপ থেকেও। ৩ রানে ম্যাচ জিতে তাই ফাইনালে যাওয়ার আশা টিকে থাকল বাংলাদেশের। দিনের অপর ম্যাচে ভারতের কাছে ৯ উইকেটে পাকিস্তান হেরে যাওয়ায় ২৬ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান-বাংলাদেশ ম্যাচটা কার্যত পরিণত হয়েছে সেমিফাইনালে।
শেষ ওভারে মোস্তাফিজ নায়ক হলেও এই ম্যাচে বাংলাদেশের মূল নায়ক আসলে মাহমুদউল্লাহ। দলের বিপদে ৭৪ রানের অসামান্য ইনিংস খেলেছেন। বোলিংয়ে আফগানদের বিপদজনক জুটি ভেঙে দিয়েছেন। মাশরাফির বলে আসগর আফগানের দুরন্ত ক্যাচ, এরকম বারবার দলকে খেলায় ফিরিয়েছেন তিনি। পার্শ্ব নায়ক নিশ্চিত ভাবেই ইমরুল কায়েস। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে চার শহর ঘুরে এসে দলে যোগ দিয়েই বিরূপ অবস্থায় করেছেন অর্ধশতক। শেষ পর্যন্ত টিকে দেখিয়েছেন চূড়ান্ত নিবেদন।
আবুধাবির পিচে সবগুলো ম্যাচেই পরে ব্যাট করা ছিল বেশ কষ্টের। এই টুর্নামেন্টে কখনো পরে ব্যাট করেনি আফগানিস্তান। মন্থর হয়ে আসা উইকেটে ২৫০ রানের লক্ষ্য তাই বড়সড়োই। তবে শুরুর আঘাত সামলে ঠিকই ম্যাচটা কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিল তারা।
আফগান ইনিংসে আঘাত হানতে বেশি দেরি করেনি বাংলাদেশ। পঞ্চম ওভারে বল হাতে পেয়েই ইহসানুল্লাহকে ফেরান মোস্তাফিজ। আগের ওভারেই অবশ্যই পড়তে পারত উইকেট। অভিষিক্ত নাজমুল অপুর বলে শর্ট থার্ড ম্যানে সহজ ক্যাচ উঠেছিল শাহজাদের। পেছন দিকে অনেকখানি দৌড়েও গিয়ে ছেড়ে দেন মিঠুন।
অষ্টম ওভারে আফগানদের দ্বিতীয় উইকেট পড়ে সাকিবের দুর্দান্ত ফিল্ডিংয়ে। অপুর বলে মিড অনে খেলেছিলেন শেহজাদ। ক্ষিপ্র গতিতে বল ধরে সরাসরি থ্রোতে রহমত শাহকে ফেরান তিনি।
৯ রানে জীবন পাওয়া শাহজাদ টিকে ছিলেন গলার কাটা হয়ে। ছন্দে থাকা হাসমতুল্লাহ শাহিদির জমেও যাচ্ছিলেন। ব্যাটিংয়ের হিরো মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ বল হাতে এসেই কাবু করেন তাকে। মাহমুদউল্লাহর ভেতরে ঢোকা বলে কাট করতে গিয়েই স্টাম্প গেছে তার।
কিন্তু চতুর্থ উইকেটে ফের শঙ্কার মেঘ। শাহিদির সঙ্গে দারুণ জুটি গড়ে তুলেন অধিনায়ক আসগর আফগান। ম্যাচ কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছিলেন তারা। নতুন স্পেলে ফিরে অধিনায়ক মাশরাফিই আনেন ব্রেক থ্রো। টানা দুই ওভারে আসগর আর শহিদিকে ফেরান বাংলাদেশ অধিনায়ক। এরপর মোহাম্মদ নবি ও সামিউল্লাহ শেনওয়ারি বেশ কিছু বাউন্ডারি মারায় জয়ের খুব কাছে চলে এসেছিল আফগানরা। কিন্তু শেষ ওভারে মোস্তাফিজের জাদুতে স্বস্তির জয় পায় বাংলাদেশ।
এর আগে বাংলাদেশের ইনিংসে উত্থান-পতন-উত্থানের খেলা। শুরুর বিপর্যয়ের পর লিটন-মুশফিকের জুটি। এরপর অদ্ভুতুড়ে আত্মাহুতির মিছিল। মনে হচ্ছিল আরেকটি ঘোর অমানিশাই অপেক্ষায় সামনে। আচমকা ডাকে দেশ থেকে উড়া আশা ইমরুল কায়েস আর মাহমুদউল্লাহর সামনে তখন বিশাল চাপ সরানোর চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জে তারা কেবল উতরালেনই না, গড়ে ফেললেন ১২৮ রানের রেকর্ড জুটি। ওয়ানডেতে ৬ষ্ট উইকেটে এটিই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ জুটি।
বাঁচা-মরার ম্যাচ। এমনিতেই চাপ ভীষণ। তারমধ্যে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে খুলনা-ঢাকা-দুবাই হয়ে আবুধাবি খেলতে আসা ইমরুলের অন্তর্ভুক্তি নিয়েও ছিল প্রশ্ন। ক্যারিয়ারে এই প্রথম নামতে হয়েছে ছয় নম্বরে। ইমরুলের জন্য বেশ কয়েকটি ব্যাপারই ছিল একেবারে নতুন।
অপরদিনে মাহমুদউল্লাহর জন্য এমন পরিস্থিতি নতুন না। দলের চরম বিপর্যয়ে বারবার হাল ধরার নজির আছে তার। এই দুজন মিলে গেলেন এক বিন্দুতে।
২১তম ওভারে ৮৭ রানে ৫ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর জুটি বেধেছিলেন। ৪৭ তম ওভারে মাহমুদউল্লাহর আউটে ভেঙেছে তা। তারমধ্যে যোগ মহামূল্যবান ১২৮ রান। ৮১ বলে ৭৪ রানের ইনিংসে মাহমুদউল্লাহ শুরু থেকেই ছিলেন স্বচ্ছন্দ। বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের যম বনে যাওয়া রশিদ খান আর মুজিব-উর রহমানকে খেললেন অনায়াসে। রশিদকে তো স্লগ সুইপ করে দুবার বাউন্ডারির বাইরে উড়িয়ে পাঠিয়েছেন। কিছুটা সময় নিয়ে খেললেও স্পিনের বিপক্ষে ইমরুলও ছিলেন সাবলীল। শেষ দিকে আফতাব আলমের বলে উড়াতে গিয়ে মাহমুদউল্লাহ ফিরলেও ১৫তম ফিফটি করে ৮৯ বলে ৭২ রানে অপরাজিত থেকে যান ইমরুল।
ওপেনিং জুটি নিয়ে প্রশ্ন উঠার পর সৌম্য সরকার আর ইমরুল কায়েসকে উড়িয়ে আনা হয়। একাদশে জায়গাও পান ইমরুল। কিন্তু এদিন আগের জুটিই নামে ওপেন করতে। পরিবর্তন আসে ব্যাটিং অর্ডারেও। তবে আবার ব্যর্থ হয়েছেন নাজমুল হোসেন শান্ত। টানা তৃতীয় ম্যাচে দুই অঙ্কে যাওয়ার আগে ফেরেন তিনি। আফতাব আলমকে অকারণ উড়াতে চাওয়ায় আকাশে তুলে দিয়ে নষ্ট করেছেন আরেকটি সুযোগ।
তবে লিটন নেমেছিলেন ভিন্ন চিন্তা নিয়ে। শুরু থেকেই ছিলেন স্বচ্ছন্দে। মারার বল পেলে মারছিলেন, ভালো বলে সমীহ। আগের সর্বোচ্চ ৩৬ রান টপকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন ফিফটির দিকেই। মুশফিকের সঙ্গে তার জুটিও বেশ জমে উঠেছিল। রশিদ খান বোলিংয়ে আসতেই চোখ ধাঁধানো ইনসাইড আউট শটে বাউন্ডারিতে পাঠিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন ৪১ রানে। অথচ তখনই হঠাৎ কি যেন গোলমাল লাগল তার মাথায়। এই শটের প্রসংসা ফুরনোরও সুযোগ দেননি। ঠিক পরের বলেই স্লগ সুইপ করতে আবার বাউন্ডারি পাওয়ার নেশায় তুলে দেন লোপ্পা ক্যাচ।
সর্বনাশের ষোলআনা হয়েছে পরের কয়েক মিনিটে। রশিদের ওই ওভারেই ক্রিজে এসে ভূতুড়ে দৌড়ে রান আউট সাকিব। রশিদের পরের ওভারে আরেকটি স্থম্ভিত করে দেওয়া দৃশ্য। রশিদের গুগলি স্কয়ার লেগে আস্তে করে ঠেলে রান নিতে ইতিস্তত করেছিলেন ইমরুল। তা দেখেই দৌড়ে মুশফিক চলে আসেন আরেক পাশে। ইমরুল মত বদলানোয় তার ফেরার পথ ছিল না আর। ওদিকে মোহাম্মদ নবীর বল ঠিকঠাক ধরে স্টাম্প ভাঙ্গতে পারেননি রশিদ। তার পা নাকি হাতে লেগে স্টাম্প ভাঙেছে বোঝা না গেলেও আম্পায়ার শন জর্জের সিদ্ধান্তে শেষ হয় মুশফিকের ৩৩ রানের ইনিংস।
৮৭ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে বিপর্যয়ে থাকা দলকে তখনই টেনে তুলার দায়িত্ব তখন মাহমুদউল্লাহ ও ইমরুল কায়েসের। যা তারা পালন করেছে পুরোপুরি। দলকে পাইয়ে দিয়েছেন জেতার মতো পুঁজি।
সংক্ষিপ্ত স্কোর :
বাংলাদেশ: ২৪৯/৭ (৫০ ওভার) (লিটন ৪১, শান্ত ৬, মিঠুন ১, মুশফিক ৩৩, সাকিব ০, ইমরুল ৭২*, মাহমুদউল্লাহ ৭৪, মাশরাফি ১০, মিরাজ ৫*; আফতাব ৩/৫৪, মুজিব ১/৩৫, গুলবাদিন ০/৫৮, নবী ০/৪৪, রশিদ ১/৪৬, শেনওয়ারি ০/৯)।
আফগানিস্তান: ২৪৬/৭ (৫০ ওভার) (শাহজাদ ৫৩, ইহসানুল্লাহ ৮, রহমত ১, হাসমতুল্লাহ ৭১, আসগর ৩৯, নবী ৩৮ শেনওয়ারি ২৩*, রশিদ ৫, গুলবাদিন ০; মাশরাফি ২/৬২, অপু ০/২৯, মোস্তাফিজ ২/৪৪, মিরাজ ০/৩৬, সাকিব ১/৫৫, মাহমুদউল্লাহ ১/১৭)।
ফল: বাংলাদেশ ৩ রানে জয়ী।
ম্যান অব দ্য ম্যাচ : মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ।
Comments