আরও এক শেষ বলের আক্ষেপ
আলোর ঝলকানি দিয়ে শুরু। মাঝে প্রতিকূলতায় কাবু হয়ে ডুবে মরার দশা। মরতে মরতে ভেসে উঠেই আবার বেঁচে থাকার জয়গান। শেষটায় এসে তবু ঘিরে থাকবে আক্ষেপ, হাহাকার, না পাওয়ার যন্ত্রণা। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের গল্পটা হয়ে গেছে যেন এমনই।
চাইলে কেবল এই ফাইনাল ম্যাচেই গোটা টুর্নামেন্টের ছবি আঁকতে পারেন। কিংবা সব টুর্নামেন্ট মিলিয়ে আগের পাঁচ ফাইনাল খেলার সঙ্গেও সবটা খাপে খাপে মিলিয়ে নিতে পারেন। মিরপুর থেকে কলম্বো, কলম্বো থেকে দুবাই। দিনশেষে গল্পটা একই। এশিয়া কাপের ফাইনালে একদম শেষ বলে গিয়ে ভারতের কাছে ৩ উইকেটে হেরে গেছে বাংলাদেশ। টানা দ্বিতীয়বার এবং সব মিলিয়ে সপ্তমবার এশিয়া সেরা হলো ভারত।
শেষ চার আসরের মধ্যে তিনবার এশিয়া কাপের ফাইনালে উঠে বাংলাদেশের জেতা হলো না একবারও। শেষ বলে গিয়ে এশিয়া কাপ না জেতার যন্ত্রণায় পুড়তে হলো দুইবার।
শুক্রবার দুবাই আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে এশিয়া কাপের ফাইনালে বাংলাদেশ নেমেছিল আন্ডারডগ হিসেবেই। দলের সেরা দুই তারকা সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবাল ছাড়া ফাইনাল খেলাই হয়ত অনেক বড়। তবে তুমুল লড়াই করে শেষ বল পর্যন্ত আশাটা জাগিয়ে রেখেছিল মাশরাফি মর্তুজার দলই।
শেষ দুই ওভারে দরকার মাত্র ৯ রান। হাতে ৪ উইকেট। ম্যাচ ভারতের দিকেই হেলে। মোস্তাফিজ প্রথম বলেই ফেরালেন ভুবনেশ্বর কুমারকে। কিছুটা আশা ফের জেগে উঠল। শেষ ওভারে দরকার ৬ রান। বল করতে এলেন মাহমুদউল্লাহ। প্রথম ৫ বল থেকে এল ৫ রান। শেষ বলে দরকার ১। কোনরকম লেগ বাই বানিয়ে ভারকে চ্যাম্পিয়ন করে দিলেন কেদার যাদব।
লিটন দাসের নায়োকোচিত সেঞ্চুরি, মেহেদী হাসান মিরাজের সঙ্গে তার দুর্দান্ত ওপেনিং জুটির পর হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়া ইনিংস করতে পারে মাত্র ২২২ রান। যার ১২১ রানই লিটনের। মিরাজ করেছনে ৩২, সৌম্য সরকারের ব্যাট থেকে এসেছে ৩৩। বাকি আটজনের ইনিংস টেলিফোন ডিজিট। সব মিলিয়ে তারা করেছেন মাত্র ২৯। এই রান নিয়ে বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটিং লাইনআপকে টলানোর সাহস!
ইনিংস বিরতিতেই ম্যাচের ভাগ্য অনেকের কাছে হয়ে উঠেছিল পরিস্কার। তবু বিক্ষত শরীর নিয়ে বারবার ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয় দেখানো মাশরাফিরা ভেবেছিলেন ভিন্ন। রুবেল হোসেন, মোস্তাফিজুর রহমান আর আধিনায়ক নিজে জান বাজি রেখে বল করলেন। কাঁপিয়ে দিলেন ভারতের ব্যাটিং। শেষটাই গিয়ে আর হলো না। আপনি ভাগ্যকে দুষতে পারেন, ভিলেন বানাতে পারেন নির্দিষ্ট কোন ঘটনাকে। কিন্তু খেলাটা এমনই। মাঝে মাঝে হয়ত খুব নির্মম।
ফাইনাল যেমনটা হওয়ার কথা হয়েছে ঠিক তেমনই। নিরপেক্ষ দর্শকরা পেয়েছেন বিনোদনের খোরাক। কিন্তু স্নায়ুর উপর দিয়ে ফের ঝড় বয়ে গেছে দুদলের। ভারতীয়রা উল্লাস করেছেন ভরপুর, ফের কান্না সঙ্গী হয়েছে লাল সবুজের সমর্থকদের।
ম্যাচের শুরু থেকেই চমকের পর চমক। উত্থান পতনের খেলা চলেছে।‘কালকেও এমন কাউকে দেখতে পারেন যে কখনো ওপেন করেইনি’। ম্যাচের আগের দিন মজার ছলে কথাগুলো বলছিলেন মাশরাফি মর্তুজা। তবে পরে সিরিয়াস হয়েই বলেছিলেন, ‘এই টুর্নামেন্টে উলটাপালটা করলেই সাকসেস আসছে, গৎবাঁধা নিয়মে কিছু হচ্ছে না’। তখনই আভাস মিলেছিল কিছু একটা চমক আসছে।
সেই চমক এল শুরুতেই। যিনি কোনদিন ঘরোয়া ক্রিকেটেও ওপেন করতে নামেননি সেই মেহেদী হাসান মিরাজকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো ওপেনিংয়ে। আগের পাঁচ ম্যাচে উদ্বোধনী জুটি থেকে আসেনি ১৬ রানের বেশি। এদিন এলো ১২০! চোখ কপালে তোলার মতই ঘটনা বটে। ভারতের বিপক্ষে উদ্বোধনী জুটিতে এটা এমনকি সর্বোচ্চ। মিরাজকে নিয়ে লিটন ভেঙ্গে দেন ২০১৫ সালে মিরপুরে তামিম ইকবাল ও সৌম্য সরকারের ১০২ রানের রেকর্ড।
জুটিতে লিটনই ছিলেন অগ্রনী। চোখ ধাঁধানো সব শটে মাত করেছেন গ্যালারি। প্রেস বক্সে বসা ভারতীয়-পাকিস্তানি সাংবাদিকরাও লিটনের শটে ওহ্! আহ্! করে উঠেছেন বার কয়েক। চেহেলকে লং অন আর ডিপ স্কয়ার দিয়ে উড়িয়ে ছক্কা মেরেছেন দাপটের সঙ্গে। সুইপ করে দারুণ সব চার মেরেছে। ডাউন দ্য উইকেটে এগিয়ে এসে সোজা ব্যাটে পাঠিয়েছেন সীমানার বাইরে। শূণ্যে রানে স্লিপে তার কঠিন ক্যাচ পড়েছিল। ৫২ রানে তার সহজ ক্যাচ ফেলে দিয়েছিলেন চেহেল। এই দুই খুতের পর লিটনের ইনিংসের বাকিটা মরুর শহরে যেন ফুল ফুটানোর মতো। চাইলে বারবার হাইলাইটস দেখে চোখের তৃপ্তি নেওয়া যায়। দল হারলেও তাই ম্যাচ সেরা হয়েছেন লিটন দাসই।
তার ওই দাপুটে শুরুর পর একসময় যারা মনে করেছিলেন আনায়াসে তিনশো ছাড়িয়ে যাবে বাংলাদেশের ইনিংস। আরেকবার চোখ কপালে উঠতে দেরি হয়নি। বিনা উইকেটে ১২০ থেকে হুট করে দল পরিণত হয় ৫ উইকেটে ১৫০ রানে।
পুরো টুর্নামেন্টে যে দুজন টানছিলেন দলকে সেই মুশফিকুর রহিম আর মাহমুদউল্লাহ ফিরেছেন সবচেয়ে দৃষ্টিকটুভাবে। ভুতুড়ে রান আউটে ইনফর্ম মিঠুন, এলবডব্লিউর ফাঁদে পড়ে শেষ হয় ইমরুলের ইনিংস।
সাতে নামা সৌম্য তবু টিকে ছিলেন। অধিনায়ক মাশরাফি পারতেন তাকে সঙ্গ দিতে। প্রায় আট ওভার আগেই উচ্চবিলাসী শটে লড়াই থামিয়ে ফেরেন দলনেতা। ৯ বল আগেই তাই শেষ হয় বাংলাদেশের ইনিংস।
উইকেটের বিচারে মামুলি লক্ষ্যে মেরে টেরেই শুরু পেয়েছিল ভারত। শেখর ধাওয়ানকে ফিরিয়ে প্রথম কামড় দেন নাজমুল ইসলাম অপু। রাইডুকে ছাঁটেন মাশরাফি। তবু রোহিত ছিলেন বলে বাংলাদেশের সম্ভাবনা দেখেনি। ৪৮ রানে ভারত অধিনায়ককে রুবেল ফেরাতেই নড়েচড়ে বসা শুরু।
বাকিটা সমান তালে এগিয়েছে। মোস্তাফিজ তার তূন থেকে কাটার বের করে চেপে ধরেছেন, রুবেল দেখিয়েছেন পেসার ঝাঁজ।আগের ম্যাচের মতো স্পিনটা ভাল করতে পারেননি মিরাজ। তবু একদম শেষ বলের আগে বোঝা যায়নি হারছে কে! ভাঙাচোরা দল নিয়ে এটাই তো অর্জন মাশরাফিদের। আবার পেছনে যখন ছয় ফাইনাল হারার পরিসংখ্যান জমা। খচখচানিটে নিশ্চিতাবে বাড়ছে কয়েকগুণ ।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
বাংলাদেশ: ২২২/১০ (৪৮.৩ ( লিটন ১২১, মিরাজ ৩২, ইমরুল ২, মুশফিক ৫, মিঠুন ২, মাহমুদউল্লাহ ৪, সৌম্য ৩৩ , মাশরাফি ৭, নাজমুল ৭ , মোস্তাফিজ ২, রুবেল ০ ; ভুবনেশ্বর ০/৩৩, বোমরাহ ১/৩৯ , চেহেল ১/৩১, কুলদীপ ৩/৪৫, জাদেজা ০/৩১, কেদার ২/৪১ )
ভারত: ২২৩/৭ (৫০) ( রোহিত ৪৮, ধাওয়ান ১৫, রাইডু ২, কার্তিক ৩৭, ধোনি ৩৬, কেদার ২৩* , জাদেজা ২৩, ভুবনেশ্বর ২১, কুলদীপ ৫* ; মিরাজ ০/২৭, মোস্তাফিজ ২/৩৮, নাজমুল ১/৫৬, মাশরাফি ১/৩৫, রুবেল ২/২৬, মাহমুদউল্লাহ ১/২৮)
ফল: ভারত ৩ উইকেটে জয়ী।
ম্যান অব দ্যা ম্যাচ: লিটন দাস।
Comments