কোটা বিষয়ে তিন বিশিষ্টজন
কোটা সংস্কারের দাবি, জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর কোটা বাতিলের ঘোষণা। তারপর আদালত প্রসঙ্গসহ ঘটেছে বহু ঘটনা। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির মূল্যায়ন প্রতিবেদনের ভিত্তিতে মন্ত্রিসভায় কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত এবং পরিপত্র জারি। কোটার দাবিতে আন্দোলনে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা। সফল আন্দোলন করতে পারলে, কোটা সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন তিন বিশিষ্টজন।
‘অনুন্নত জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা মৌলিক অধিকার’
সৈয়দ আবুল মকসুদ, লেখক-গবেষক-সমাজকর্মী
একটি দাবির প্রেক্ষিতে সরকার সব ধরনের কোটা বাতিল করেছে। কিন্তু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী, নারী এবং অনুন্নত জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা মৌলিক এবং সাংবিধানিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। ফলে কোটা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তটি অপ্রত্যাশিত এবং সাংবিধানিক অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করে। কিছু কোটা রাখা জরুরি ছিল। সব সময় আমরা সেকথা বলেছি।
কোটা চাইলে আন্দোলন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী ‘আউট অব ইমোশন’ থেকে একথা বলেছেন। তবে তার কাছ থেকে এ ধরণের মন্তব্য অনাকাঙ্ক্ষিত। বক্তব্যটি খুবই ক্ষতিকর।
প্রতিটি দাবির ক্ষেত্রে যৌক্তিকতা এবং আন্দোলনের ক্ষেত্রে কারণ প্রয়োজন। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো মেনে নিতে পারার মানসিকতা। কিন্তু, আমরা স্বাধীন জাতি হিসেবে এখনও পরিপক্বতার পরিচয় দিতে পারছি না। এ কারণেই এই অসন্তোষের কারণগুলো ঘটছে।
দেশে মূলধারায় শিক্ষিত লাখ লাখ লোকই বেকার। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী, নারী এবং অনুন্নত জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা না রাখলে তো দেশই পিছিয়ে পড়বে। এটা তাদের জন্য দয়া দেখানোর মতো কোনো ব্যাপার নয়। সংবিধান-স্বীকৃত অধিকার। ফলে তাদের জন্য কোনো কোটা না রাখাটা হবে খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের জন্য ৫ শতাংশ কোটা রাখতেই হবে। সব কোটা বাতিল করে দেওয়ায় তো সমাজে ন্যায্যতার ঘাটতি তৈরি হলো।
‘এটিও একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, প্রধানমন্ত্রী সে পথেই হাঁটছেন’
অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য
কোটা বাতিল বর্তমান সরকারের একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। সমগ্র ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে আগেই কোটা বাতিলের ব্যাপারে ঘোষণা দিয়েছিলেন। এবার তার বাস্তবায়ন দেখা গেলো।
প্রধানমন্ত্রী গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন। তাই কোটা সংস্কারের যৌক্তিক আন্দোলনকে আমলে নিয়ে তিনি যেমন কোটা বাতিলের কথা বলেছেন। আবার এও বলেছেন, যারা কোটা চাইছে তারাও যেন একটি সফল আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। এটিও একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া- প্রধানমন্ত্রী সে পথেই হাঁটছেন।
‘আন্দোলন ছিল কোটা সংস্কারের, বাতিলের নয়’
আনু মুহাম্মদ, অধ্যাপক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
কোটা সংস্কারের মতো একটি ন্যায্য দাবি নিয়ে শুরু থেকেই সরকারের অযৌক্তিক পদক্ষেপের বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করা আসলেই কঠিন। আন্দোলনটা ছিল কোটা সংস্কারের। কোটা বাতিলের কোনো আন্দোলন ও দাবি কেউ করেনি। আন্দোলনকারীরা বারবার বলেছে, আমরা কোটা বাতিল চাই না, সংস্কার চাই। এমনকি, সংস্কার কিভাবে করা উচিত সেটি নিয়ে অনেক বিশেষজ্ঞ এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ সুপারিশও করেছেন। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের পক্ষ থেকেও সুপারিশ এসেছে যে এটা কমানো উচিত, সংস্কার করা উচিত।
তারপরেও কোটা বাতিল করার ব্যাপারটি কেনো আসলো! সংসদে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যটি রাগের বহিঃপ্রকাশ ছিল। কিন্তু সেটিকেই একটা সিদ্ধান্ত হিসেবে নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ কমিটি কী বিবেচনায় কোটা বাতিল করল, এর কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা পাইনি।
কোটা শুধু বাতিলই করা হয় নাই। এবার অন্যদেরকেও আহ্বান জানানো হয়েছে কোটার জন্য আন্দোলন করার। এর ফলে সমাজে একটি অপরিণামদর্শী পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। কোটা নিয়ে সরকারের অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার কারণে এটা টেকসই কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এর ফলে সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব-সংঘাত তৈরি হবে।
সফল আন্দোলন করতে পারলে কোটা সুবিধার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হবে, প্রধানমন্ত্রীর এ ধরণের কথা অযৌক্তিক। তিনি তো আন্দোলনের আহ্বান জানাতে পারেন না। প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারি কমিটির উচিত, যে ব্যাপারে আন্দোলন হয়েছে তার যৌক্তিকতা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিচার-বিশ্লেষণ করে সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া।
বেশ কয়েক মাসের তীব্র আন্দোলনের মধ্যে অনেকগুলো সমাধানও পাওয়া গেছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, নারী ও মুক্তিযোদ্ধা সব মিলিয়ে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কোটা রাখার সিদ্ধান্ত হলে তা গ্রহণযোগ্য হতো। জনগণের মধ্য থেকে যদি কোনো দাবি উত্থাপিত হয়, সরকার তার কোনো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে না গিয়ে তো রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারে না। সরকার সেটাকে যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। রাগের বহিঃপ্রকাশ একবার দেখালেও সেটিকে মাসের পর মাস টেনে আনতে পারে না এবং সেটি প্রশাসনিক পদক্ষেপও হতে পারে না। একদিকে আন্দোলনকারীদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন চালানো ও তাদের আটক করা হয়েছে। অন্যদিকে, এ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সমাজের মধ্যে একটি দ্বন্দ্ব-সংঘাত ঘটানোর চেষ্টা চলছে। কোনোভাবেই এটা ব্যাখ্যা করা যায় না।
Comments