সৌদি সাংবাদিক জামালকে নিয়ে আশঙ্কাই সত্য হলো কি?
বিশ্বসাংবাদিকতায় সৃষ্টি হলো আরেকটি কলঙ্কিত অধ্যায়। সেই অধ্যায়ের রচয়িতা হিসেবে উঠে আসছে সৌদি সরকারের নাম। অভিযোগ উঠেছে- বিশ্বের বিবেকবান মানুষগুলোর দিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে তারা দিনে-দুপুরে একজন স্বনামধন্য সাংবাদিককে রীতিমতো ‘হাওয়া’ করে দিয়েছে। সেই সাংবাদিকের নাম জামাল খাশোগি। তার ‘নিখোঁজ’ হওয়ার খবরটি প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে যে আশঙ্কা করা হয়েছিলো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে অবশেষে তাই সত্য হলো কি?
গত ২ অক্টোবর তুরস্কের ইস্তান্বুল শহরে সৌদি আরবের কনসুলেট অফিসে ঢুকে ছিলেন আরব নিউজ-খ্যাত সাংবাদিক ও কলাম লেখক জামাল। ১৯৫৮ সালের ১৩ অক্টোবর মদিনায় জন্ম নেওয়া জামাল ছিলেন অল আরব নিউজ চ্যানেলের সাবেক মহাব্যবস্থাপক এবং প্রধান সম্পাদক। প্রগতিশীলদের প্লাটফর্ম ‘আল ওয়াতান’ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বেশ সুনাম অর্জন করেন তিনি।
তবে সৌদি সরকারের সমালোচনা করে কিছু লেখা প্রকাশ করায় ক্ষমতাসীনদের রোসানলে পড়েন তিনি। পরিস্থিতি এমনি প্রতিকূল হয়ে যে ‘সৌদি ভিশন ২০৩০’-এর একজন সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও তাকে দেশ থেকে পালাতে হয় ২০১৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। এরপর থেকে তিনি স্বেচ্ছানির্বাসনে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে।
জামালের প্রেমিকা জানান, তাদের আসন্ন বিয়ের কাগজপত্র নিয়ে ইস্তান্বুলের সৌদি কনসুলেটে যান তারা দুজন। জামাল অফিসের ভেতরে ঢুকলে তিনি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন। এরপর থেকেই তার আর খোঁজ মিলছে না।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো গতকাল (৬ অক্টোবর) জানায়, “তুরস্ক কর্তৃপক্ষ মনে করছে ‘বেঁচে নেই’ জামাল। তাকে কনসুলেটের ভেতরেই হত্যা করা হয়েছে। তারপর সরিয়ে নেওয়া হয়েছে তার মরদেহ।” দুজন তুর্কি সূত্রের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমগুলো বিশ্ববাসীকে দেয় এই দুঃসংবাদ। তবে সৌদি কনসুলেটের ভাষ্য জামালের হত্যার অভিযোগটি মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।
জামালের ‘নিখোঁজ’ হওয়ার ঘটনাটি তদন্ত করতে গতকালকেই ইস্তান্বুল এসে পৌঁছায় সৌদি তদন্তদল। একইদিনে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে কনসুল জেনারেল বলেন, সৌদি সরকার ‘নিখোঁজ’ সাংবাদিককে খুঁজে বের করতে সদা প্রস্তুত রয়েছে। এছাড়াও, তুরস্কের ইংরেজি দৈনিক হুরিয়াত ডেইলি নিউজ জানায়, তুরস্কও এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে।
ইস্তান্বুলের প্রধান কৌসুলির কার্যালয় থেকে গতকাল এক বার্তায় বলা হয়, তাদের তদন্তে “কনসুলেটে জামালের আটক” থাকার বিষয়টির ওপর গুরুত্বারোপ করা হবে। এদিকে, গত ৫ অক্টোবর ব্লুমবার্গে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বলেন, “সার্বভৌম কনসুলেটে কোনো দেশের প্রবেশাধিকার নেই। তবুও আমরা তাদেরকে অনুসন্ধানের কাজে সহযোগিতা করবো। আমাদের লুকানোর কিছু নেই। তাই কনসুলেটে এসে অনুসন্ধানকারীদল যা খুশি তা করতে পারবে।”
তিনি জানান, জামাল কনসুলেটে ঢোকার কিছুক্ষণ পরেই সেখান থেকে চলে যান। যুবরাজ বলেন, “জামাল যদি সৌদিতে যেতো তাহলে আমি তা জানতাম।” তিনি এখন ‘নিখোঁজ’ জামালকে ‘খুঁজে’ বের করার ওপরই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। তবে আঙ্কারা বলছে, কনসুলেট থেকে জামালের বের হওয়ার কোনো প্রমাণ তাদের হাতে নেই।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জামালের ‘নিখোঁজ’ বা ‘নিহত’ হওয়ার ঘটনায় সৌদি আরবের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক নেমে যাবে আরও এক ধাপ। কেননা, সৌদি আরবের মিশর ও কাতার পলিসির কারণে তুরস্কের সঙ্গে দেশটির বেশ মনোমালিন্য চলছে। এছাড়াও, ২০১৬ সালে তুরস্কে ব্যর্থ সামরিক অভ্যূত্থানের পর দেশটিতে ব্যাপক ধড়পাকড়ের জন্যে সালমান সমালোচনা করেন তুরস্কের এরদোয়ান সরকারের।
জামালকে দীর্ঘদিন থেকে চেনেন বিবিসি’র একজন সাবেক সাংবাদিক বিল ল গত ৪ অক্টোবর সংবাদমাধ্যম আল জাজিরায় এক মতামত কলামে লিখেন, “তিনি (জামাল) একজন ভালো মানুষ এবং চমৎকার সাংবাদিক। তিনি সমালোচনা করেন যুক্তি দিয়ে। তার মতামতগুলোয় রয়েছে জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ। এগুলো সৌদি যুবরাজের শোনা উচিত ছিলো।”
এখন পরিস্থিতি যেদিকেই যাক না কেনো, মানবাধিকারকর্মীরা জামালের ঘটনাটিকে বিরুদ্ধ মতের ওপর ক্ষমতাসীনদের দমননীতির ন্যাক্কারজনক উদাহরণ হিসেবে দেখছেন। বিশেষ করে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ক্ষমতাসীনদের গদি পাকাপোক্ত করার জন্যে ভিন্নমতকে চিরতরে বন্ধ করে দেওয়ার ভুল চর্চাটিকেই জামাল যেন তুলে ধরলেন তার জীবন দিয়ে- এমন অভিমত সংবাদকর্মীদেরও।
Comments