বিরোধী দলের প্রতি উদার নীতির মাধ্যমে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা থাকতে হবে: আদালতের পর্যবেক্ষণ

বিরোধী দলের প্রতি ক্ষমতাসীনদের উদার নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হয় বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন আদালত। এছাড়াও, বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দকে হত্যা করে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক ফায়দা অর্জন করা মোটেই গণতান্ত্রিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ নয় বলেও মন্তব্য করেছেন আদালত।
Gavel

বিরোধী দলের প্রতি ক্ষমতাসীনদের উদার নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হয় বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন আদালত। এছাড়াও, বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দকে হত্যা করে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক ফায়দা অর্জন করা মোটেই গণতান্ত্রিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ নয় বলেও মন্তব্য করেছেন আদালত।

আজ (১০ অক্টোবর) রাজধানীতে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মামলায় রায় দেওয়ার সময় এই পর্যবেক্ষণ দেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন।

আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ক্ষমতায় যে দলই থাকবেন, বিরোধী দলের প্রতি তাদের উদার নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা থাকতে হবে। বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দকে হত্যা করে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক ফায়দা অর্জন করা মোটেই গণতান্ত্রিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ নয়।”

“সাধারণ জনগণ এ রাজনীতি চায় না। সাধারণ জনগণ চায় যে কোনও রাজনৈতিক দলের সভা সমাবেশে যোগ দিয়ে সেই দলের নীতি আদর্শ ও পরিকল্পনা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান ধারণ করা। আর সেই সভা সমাবেশে আর্জেস গ্রেনেড বিস্ফোরণ করে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সাধারণ জনগণকে হত্যার এ ধারা চালু থাকলে পরবর্তীতে দেশের সাধারণ জনগণ রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়বে।”

পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, “এ আদালত চায় না সিলেটে হযরত শাহজালাল (রহ.) এর দরগা শরীফের ঘটনার, সাবেক অর্থমন্ত্রী এস এম কিবরিয়ার ওপর নৃশংস হামলার, রমনা বটমূলে সংঘটিত বোমা হামলার এবং এ মামলার ঘটনায় তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর নৃশংস বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলার পুনরাবৃত্তি।”

পর্যবেক্ষণের শুরুতে বলা হয়, “১৯৭১ সালে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা অর্জন করে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে রক্ত ও মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে। আইনের শাসন, গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য জাতি একটি সংবিধান প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়। ১৯৭১ এর পরাজিত শক্তি এদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ব্যাহত করার অপচেষ্টা চালাতে থাকে। পরাজিত শক্তি বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে স্বাধীন বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিকে রোধ করে। অগ্রগতির চাকাকে পেছনে ঘোরানোর চেষ্টা চালিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তি ও লাল সবুজ পতাকাকে হেয় প্রতিপন্ন করার অপচেষ্টা চালায়।”

আদালতের মন্তব্য, ‘‘১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট পরাজিত শক্তি ঐক্যবদ্ধভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। বিচার না হওয়ার প্রচেষ্টা চালানো হয়। ইনডেমনিটি বিলের মাধ্যমে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র দেশে শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দীর্ঘ ২৩ বছর ২ মাস পর জাতি ‘জাতির পিতা’ হত্যার দায় থেকে কলঙ্কযুক্ত হয় বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার করার পর চার জাতীয় নেতাকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়। জাতির পিতা ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়। কিন্তু ষড়যন্ত্র থেমে না গিয়ে বহমান থাকে “

“পরবর্তীতে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শনিবার আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার হীন প্রচেষ্টা চালানো হয়। ‘শেখ হাসিনাকে হালকা নাশতা করানো হবে’ এই উদ্ধৃতি দিয়ে দেশীয় জঙ্গি সংগঠনের কতিপয় সদস্য আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের সহায়তায় হামলা করে। তৎকালীন রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের সহায়তায় প্রকাশ্য দিবালোকে ঘটনাস্থল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর সামনে যুদ্ধে ব্যবহৃত স্পেশালাইজড মারণাস্ত্র আর্জেস গ্রেনেড বিস্ফোরণের মাধ্যমে ঘটনা ঘটানো হয়। প্রশ্ন উঠে কেন এই মারণাস্ত্রের ব্যবহার? রাজনীতি মানেই কী বিরোধী দলের ওপর পৈশাচিক আক্রমণ? শুধু আক্রমণই নয়, দলকে নেতৃত্বশূন্য করার ঘৃণ্য অপচেষ্টা। রাজনীতিতে অবশ্যাম্ভাবীভাবে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে শত বিরোধ থাকবে। তাই বলে নেতৃত্বশূন্য করার প্রয়াস চালানো হবে। এটা কাম্য নয়।”

আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, “মোসাম্মৎ উম্মে কুলসুম রেনুকা (পি ডাব্লিউ-১৭৫), নুজহাত অ্যানি (পি ডাব্লিউ-১৭৬), রাশেদা আক্তার রুমা (পি ডাব্লিউ-১৭৭), নীলা চৌধুরী (পি ডাব্লিউ-১৭৮) ঘটনার সময় ঘটনাস্থল থেকে যারা গ্রেনেড হামলায় মারাত্মকভাবে জখম হয়ে দেশে বিদেশে চিকিৎসার পরও এখনও দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন, যাদের চোখে ঘুম নেই, গ্রীষ্ম বা শীত সবসময়েই শরীরের বিভিন্ন অংশে স্প্লিন্টারের তীব্র যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছেন, যাদের পরিবারের সুস্থ সদস্যরাও প্রাণহীনভাবে বেঁচে আছেন।”

“আদালত গভীরভাবে পর্যালোচনা করেছেন (পি ডাব্লিউ-১৯৫) অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন এমপি, (পি ডাব্লিউ-২০১) আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরুল্লাহ, (পি ডাব্লিউ-২০৩) অ্যাডভোকেট সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, (পি ডাব্লিউ-১৫৩) আ ফ ম বাহা উদ্দিন নাসিম এমপি, বাংলাদেশ স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি এ আদালতে দেওয়া সাক্ষ্য, ঘটনাস্থলে যে মারাত্মক ও ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল সে মর্মে বক্তব্য দিয়েছেন। আদালত (পি ডাব্লিউ-১২৭) অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্তের জবানবন্দি পর্যালোচনা করেছেন, যিনি তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রীর কানের চিকিৎসা করেছেন। ঘটনার সময় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ফলে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রীর  ডান কানে গুরুতর জখম হয়। আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে এই নৃশংস ও ন্যক্কারজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব বলে এ আদালত মনে করেন।”

এছাড়াও, “সার্বিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, মূল ঘটনার আগে বিভিন্ন ঘটনাস্থলে এ মামলার আসামিরা অভিন্ন অভিপ্রায়ে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র সভা করে পরিকল্পিতভাবে এ মামলার ঘটনাস্থল ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর সামনে ঘটনার তারিখ ও সময় মারাত্মক সমরাস্ত্র আর্জেস গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ ২৪ জনকে হত্যা ও শতাধিক নেতাকর্মীকে মারাত্মকভাবে জখম করে। এ মর্মে আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রসিকিউশন পক্ষ প্রমাণে সক্ষম হয়েছে। সে প্রেক্ষিতে আসামিদের শাস্তি প্রদান যুক্তিসঙ্গত বলে এ আদালত মনে করে।”

Comments

The Daily Star  | English

One month of interim govt: Yunus navigating thru high hopes

A month ago, as Bangladesh teetered on the brink of chaos after the downfall of Sheikh Hasina, Nobel Laureate Muhammad Yunus returned home to steer the nation through political turbulences.

7h ago