শুধু ‘উত্তীর্ণ’-দের পরীক্ষার সুযোগ দেওয়া সংবিধান পরিপন্থী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের ক্রমাগতভাবে বিস্মিত করেই চলেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মানুষের কাছে বিস্ময় ছিল, অন্যায়-অন্যায্যতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধে সাহসী ভূমিকার কারণে।
du
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটের প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ায় সেই পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ। ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের ক্রমাগতভাবে বিস্মিত করেই চলেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মানুষের কাছে বিস্ময় ছিল, অন্যায়-অন্যায্যতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধে সাহসী ভূমিকার কারণে।

এখন বিস্মিত করছে ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষাবিষয়ক কর্মকাণ্ড দিয়ে। ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করলে, হিসাব মেলানো বেশ কঠিন। মাথা এলোমেলো হয়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা আছে। আসুন বিষয়টি একটু দেখে নেই-

১. ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা হয়েছে ১২ অক্টোবর শুক্রবার সকাল ১০টায়। প্রশ্নপত্রের উত্তরসহ ফাঁসের প্রমাণ পাওয়া যায় ৯টা ১৭ মিনিটে, পরীক্ষা শুরুর ৪৩ মিনিট আগে। পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। প্রশ্নফাঁসের প্রমাণসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ ও দাবির প্রেক্ষিতে ১৩ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে। সেদিনই গ্রেপ্তারকৃত ছয়জনের নামে মামলা হয়।

তদন্ত কমিটি ১৫ অক্টোবর উপাচার্যের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। তদন্তে প্রশ্নফাঁসের প্রমাণ পাওয়া যায়।

১৫ অক্টোবর সকালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায়, ‘ঘ’ ইউনিটের ফল প্রকাশ করা হবে ১৬ অক্টোবর। সেদিনই দুপুরে আবার জানায়, ১৬ অক্টোবর ফল প্রকাশ করা হবে না। গণমাধ্যমে সংবাদটি ছড়িয়ে পড়ে এভাবে যে ‘ঘ ইউনিটের ফল প্রকাশ স্থগিত’।

তারপর ১৬ অক্টোবরেই তড়িঘড়ি করে ফল প্রকাশ করে দিয়ে উপাচার্য বিদেশে চলে যান। ফল প্রকাশ করতে গিয়ে উপাচার্য বলেন, “আমরা এখন অনেক এগিয়েছি, এখন কিন্তু অনেক কাছে নিয়ে আসছি। এখন তো বলা হচ্ছে যে, কী জানি শুনলাম ৯টা ১৭, ৯টা ১৮, এরকম শুনলাম (পরীক্ষা শুরুর ঘণ্টা খানেক আগে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে)। আগে কখনও কখনও শুনতাম দুইদিন-একদিন আগে। ক্রমান্বয়ে ক্লোজ করে যাচ্ছি কিন্তু। আমরা এখন এমন জায়গায় আসছি, যে রেহাই পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।” (বিডিনিউজ২৪.কম, ১৭ অক্টোবর ২০১৮)

বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ফল প্রকাশ করা হয়েছে।

তদন্ত কমিটির প্রধান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ ১৭ অক্টোবর দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনকে বলেন, “প্রশ্ন ফাঁস আর ডিজিটাল জালিয়াতি যাই বলি না কেন, পরীক্ষা শুরুর আগেই আমাদের হাতে কিছু উত্তর চলে এসেছে। সত্য প্রকাশ হবেই। ধামাচাপা দিয়ে কোনো লাভ হবে না। আমি চাই পুরো ব্যাপারটিই প্রকাশিত হোক।”

২০১৭ সালেও প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ উঠেছিল, আন্দোলন হয়েছিল। উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেছিলেন, পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার তিন ঘণ্টা পরে প্রশ্নফাঁসের প্রমাণ পাওয়া যাওয়ায়, অভিযোগ গ্রহণযোগ্য নয়।

প্রশ্ন এক: তদন্ত কমিটি প্রধানের এই বক্তব্যের পরও বলা যায় যে, তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী ফল প্রকাশ করা হয়েছে?

প্রশ্ন দুই: একটি ভর্তি পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে দেশের প্রধানতম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সিদ্ধান্তহীনতা কেন?

প্রশ্ন তিন: এর মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কোন ঘাটতির প্রকাশ পায়, সক্ষমতার না নৈতিকতার?

প্রশ্ন চার: গত বছর তিন ঘণ্টা পরে, এবার ৪৩ মিনিট আগে প্রশ্নফাঁসের প্রমাণ পেয়েছেন উপাচার্য। তুলনামূলক বিবেচনায় এটাকে কী উপাচার্যের ‘সাফল্য’ হিসেবে দেখব?

২. এখানেই শেষ নয়, পরের পদক্ষেপ আরও চমকপ্রদ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ‘উত্তীর্ণদের’ পুনরায় পরীক্ষা নেওয়া হবে। ‘ঘ’ ইউনিটে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৮ হাজার ৪৪০ জন। পরীক্ষায় মোট অংশ নেওয়ার কথা ছিল ৯৫ হাজার ৩৪১ জনের। অংশ নিয়েছেন ৭০ হাজার ৪৪০ জন। পাশ নম্বর ৪৮ না পাওয়ায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি ৫১ হাজার ৯৭৬ জন।

এই প্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আইন, সংবিধান এবং প্রচলিত রীতিনীতি লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ এসেছে।

ক. যারা উত্তীর্ণ হয়েছেন তাদের কেউ কেউ ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সুবিধা পেয়েছেন। অন্য ইউনিটের পরীক্ষায় যে শিক্ষার্থী পাস নম্বরই পাননি, ‘ঘ’ ইউনিটের পরীক্ষায় তিনি প্রথম হয়েছেন।

খ. যদি প্রশ্ন ফাঁস না হতো তবে ‘উত্তীর্ণদের’ অনেকেই হয়ত উত্তীর্ণ হতেন না। ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পেলে অনুত্তীর্ণদের অনেকে হয়ত উত্তীর্ণ হতেন। অর্থাৎ ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের পরীক্ষায় ‘উত্তীর্ণ বা অনুত্তীর্ণ’ কোনো বিবেচনার বিষয় হতে পারে না। ‘উত্তীর্ণদের’ আরেকবার পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দিয়ে ‘অনুত্তীর্ণদের’ বঞ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

এখানেই প্রশ্ন আসছে, আইন এবং সংবিধান অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এমন উদ্যোগ নিতে পারেন কিনা?

৩. দেখে নেওয়া যাক, এক্ষেত্রে সংবিধানে কী লেখা আছে। সংবিধানের ‘মৌলিক অধিকার’ অংশে ‘আইনের দৃষ্টিতে সমতা’র ২৭ অনুচ্ছেদে লেখা আছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’

সংবিধানের ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি’ অংশে ‘সুযোগের সমতা’র ১৯(২) ধারায় লেখা আছে, ‘মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করিবার জন্য, নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করিবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধাদান নিশ্চিত করিবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’

বিষয়টি নিয়ে কথা হচ্ছিল সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। আইন, রীতিনীতি এবং সংবিধান পরিপন্থি। এক্ষেত্রে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের ২০১৬ সালের একটি রায়ের পর্যবেক্ষণ অনুধাবনযোগ্য। মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের সুযোগ নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল ৪৪ জনের বিরুদ্ধে। সমগ্র ভারতের ছয় লাখ শিক্ষার্থীর পরীক্ষা বাতিলের নির্দেশনা দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্ট এবং ছয় লাখ শিক্ষার্থীর ভর্তি পরীক্ষা পুনরায় নিতে হয়েছিল।”

৪. একটি প্রশ্নের অবসান না ঘটিয়ে আরও প্রশ্নের জন্ম দিলে পরিত্রাণ মিলবে না। সত্তর হাজার শিক্ষার্থীর পরীক্ষা নেওয়া নিশ্চয়ই কষ্টসাধ্য, কিন্তু অসম্ভব নয়।

আরও উল্লেখ্য যে, মোট উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই সুযোগ পেয়েছেন মেধা-যোগ্যতায়। প্রশ্নফাঁসের সুযোগে উত্তীর্ণ হওয়ার সংখ্যা কম। সেক্ষেত্রে প্রশ্নফাঁসের সুযোগ ছাড়া যারা ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন, তাদেরও পুনরায় পরীক্ষা দিতে হবে। তাদের জন্যে বিষয়টি অত্যন্ত বেদনাদায়ক। প্রশ্নফাঁস হয়েছে এটা যেহেতু সত্যি, কে সেই প্রশ্ন পেয়েছেন কে পাননি, তা যেহেতু সুনির্দিষ্ট করে সনাক্ত করা সম্ভব নয়, ফলে আবার পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

সবচেয়ে বড় কথা প্রশ্নফাঁসের দায় শিক্ষার্থীদের নয়, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের।

সেই দায় স্বীকার করে নিয়ে, পুনরায় পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ সবাইকে দিতে হবে। কাউকে কাউকে নয়। একজনকেও যদি বঞ্চিত করা হয়, আরও জটিলতা বাড়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে। বঞ্চিতদের পক্ষ থেকে কেউ আদালতে গেলে, ‘ঘ’ ইউনিটের পরীক্ষা আইনি জটিলতায় আটকে যেতে পারে। তা নিশ্চয়ই কারোরই কাম্য নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে থেকে আইন ও সংবিধানের আলোকে, বিচক্ষণতা-সুবিবেচনা প্রত্যাশিত।

Comments

The Daily Star  | English

Abu sayed’s death in police firing: Cops’ FIR runs counter to known facts

Video footage shows police shooting at Begum Rokeya University student Abu Sayed, who posed no physical threat to the law enforcers, during the quota reform protest near the campus on July 16. He died soon afterwards.

9h ago