ঈদের আনন্দ কি সবার ঘরে আসে?

ছবি: প্রবীর দাশ/ স্টার

ঈদের আনন্দ কী সবার ঘরে আসে? উত্তর অজানা নয়। ঈদের আনন্দ সবার ঘরে আসে না। আসে কারো কারো ঘরে। আমরা চাই ঈদের আনন্দ আসুক সবার ঘরে। কারণ ঈদের স্পিরিটের ভেতর রয়েছে এক সর্বজনীন আনন্দের আকাঙ্ক্ষা, সর্বজনিন মূল্যবোধ। মূল্যবোধ বিশ্বাসের অংশ।

কিন্তু বিশ্বাসের গোড়ায় গলদ ঢুকেছে। ঈদের সর্বজনিন আনন্দ নিয়ে ব্যক্তি যত না আগ্রহী তার চেয়ে বেশি নিবিষ্ট একান্ত আনন্দে। সামষ্টিক ঈদ আনন্দ আজ ব্যক্তিক ঈদ আনন্দে রূপান্তরিত হয়েছে। এ ব্যক্তি সব ব্যক্তি নয় রয়েছে বিশেষ কিছু ব্যক্তি। আরও পরিষ্কার করে বললে সামর্থ্যবান ব্যক্তি। যাদের কেনার সামর্থ্য রয়েছে হাতে নগদ টাকা রয়েছে। ঈদ উদযাপনকে ঘিরে এটি হলো মোটাদাগে এক বড় ধরনের পরিবর্তন।

ঈদ উৎসব সমাজের ন্যায্যতা ও মানুষের সহমর্মিতাবোধের করুণ চিত্র তুলে ধরছে। অনেকের জন্য ঈদ আনন্দের উৎস না হয়ে বেদনার কারণ হয়ে উঠছে। ঈদের আনন্দের মূল শক্তি নিহিত রয়েছে সবাই মিলে তা কতটা উপভোগ করা যাচ্ছে তার ভেতর। কিন্তু ঈদের আনন্দ আজ লোক দেখানো উৎসবে পরিণত হয়েছে। সেই মূল্যবোধের ওপর পেরেক ঠুকা হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

গত ১৫ বছরে এ নগদজীবী বা ক্যাশবেইজ শ্রেণির বিকাশ ঘটেছে। যারা মূলত আওয়ামী লীগের দীর্ঘ অপশাসনের সুবিধাভোগী। আমলা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা মিলে একটি যোগসাজসের অর্থনীতি গড়ে তুলেছিল। যার প্রভাব গ্রামগঞ্জেও লক্ষ্য করা যায়। গ্রামেও এখন কোটিপতির সন্ধান মেলে। যা গত শতাব্দিতে ছিল অবিশ্বাস্য। এ শ্রেণির অনেকের তেমন জমি-জিরাত নেই কিন্তু ঠিকাদারি, কৃষি, মাছের প্রোজেক্ট, চাকরি-বাকরি এবং মামলা মোক্কদ্দমার তদ্বিরসহ অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে অঢেল টাকার মালিক হয়েছে।

বিভিন্ন উৎসব ও উপলক্ষ ঘিরে নতুনভাবে গজিয়ে উঠা এ শ্রেণি সামাজিক পরিচয় নির্মাণ করতে চেষ্টা করে। অনুগতদের উপহার দেয়, দান-খায়রাত করে, বড় করে ইফতার আয়োজন করে। রোজা ও ঈদ হচ্ছে এ নতুন গজিয়ে উঠা শ্রেণির অর্থ ও ক্ষমতা দেখানোর নতুন ক্ষেত্র। এসব উৎসব ঘিরে বুঝাতে চান তারা কতো বেশি সামর্থ্যবান ও মানুষের প্রতি কতো দরদী। এ টাউট শ্রেণি ঈদের মতো সর্বজনীন উৎসবগুলোকেও কালিমালিপ্ত করছে।

মনে রাখতে হবে, বৈধ এবং অবৈধভাবে অর্জনের অভিব্যক্তি এক নয়। বৈধতার সঙ্গে সততার, নৈতিকতা ও নিয়মানুবর্তীতার সম্পর্ক রয়েছে। এ পথে রাতারাতি বিত্তশালী হওয়া যায় না। আর অবৈধপথ নীতিহীন তৎপরতা। সেখানে আলাদিনের প্রদীপের মতো রাতারাতি বিত্তশালী হওয়া সম্ভব। ক্ষমতাবানদের কাছাকাছি থেকে অনেকে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছে। তারা কেবল মালিক হয়ে বসে থাকছে না টাকার গরম দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। জনগণ অবৈধ টাকা ও অবৈধ ক্ষমতার গরম দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

দুর্নীতিগ্রস্ত ও দুর্বীনিতদের টাকার গরম দেখানো বড় ক্ষেত্র হলো উৎসব। তার মধ্যে ঈদ অন্যতম। ঈদের তারা দানশীল, উদার, উদ্ধারকর্তা হিসেবে হাজির হয়। বিশাল ইফতার পার্টি দেয়, অনুগতদের ঈদ উপহার দেয়, টাকা বিলি করে। তাদের অবৈধ জীবনের বৈধতা আদায়ের এক বড় সুযোগ আসে ঈদের মতো উপলক্ষ্যগুলো ঘিরে। মানুষ হিসেবে এরা অতিনিম্নমানের কিন্তু তারা ভালো মানুষ সাজতে চায়, ভালোমানুষী দেখায়। এ ভালোমানুষী একটি ফাঁদ। জনগণকে ফাঁদে ফেলে আরও বড় সুবিধা নিতে চায়। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান থেকে উপজেলা চেয়ারম্যান এবং উপজেলা থেকে সংসদ সদস্য হতে চায়। এদের অগ্রগতির পথে ছলচাতুরি প্রধানতম অবলম্বন। এসব লোকদের চেনার সময় এসেছে। এরা জনগণকে  কেনার যোগ্য বস্তু বলে মনে করে। মানুষের মানবিক মর্যাদাকে অবমূল্যায়ন করে। ঈদের মতো নিঃষ্কলঙ্ক আনন্দের ওপর ঘিনঘিনে কালো চাদর চাপাতে চান। এগুলো হলো অপশাসন উপজাত এক কলঙ্কতিলক যা সামাজিক সংহতির পথে বড় বাধা।

কিন্তু মজার বিষয় হলো মানুষ এদের বেশ ভালো চেনে। সম্পদে দরিদ্র হলেও মানসিকতায় উদার মানুষ তাদের এড়িয়ে চলে। কারণ তারা বিশ্বাস করে ঈদুল ফিতর সংযমের মহিমায় উদ্ভাসিত এক বিশেষ দিন। ঈদুল ফিতর সংযমী হতে শেখায়, ক্ষুধার বোধ শেখায়, শেখায় পরার্থবোধ। সেই স্পিরিটটুকু বেঁচে আছে বলেই হয়ত আজও সামাজিক সংহতিটুকু ঠিকে আছে।

মানুষ পঙ্কিলতা মাড়িয়ে সবাই মিলে ঈদগাহে যায়। ঈদের নামাজ আদায়, কোলাকুলি ও আনন্দ বিনিময় করে। ঈদের স্পিরিট ধর্মীয় সীমানার বাইরে সামাজিক পরিসরেও উদ্ভাসিত। ঈদের আনন্দের ভেতর রয়েছে এক সাম্যবাদী চেতনা। এ আনন্দ সবার জন্য। ঈদ টুগেদারনেসের বিষয়, যুথবদ্ধতার বিষয়। উৎসবে যুথবদ্ধতা না থাকলে, সম্মিলন না থাকলে প্রাণ থাকে না। সবার সরব উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ যেকোনো উৎসবকে আনন্দঘন করে। ঈদ মানেই একের সঙ্গে অন্যের বুক মেলানোর উপলক্ষ্য। ঈদ মানেই সম্প্রীতির বন্ধন।

কথা হলো, সমষ্টিবোধক নিয়ে জীবনযাপনের শক্তি আমাদের কমেছে। সমাজের নানাস্তরে সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। পারষ্পরিক বিশ্বাস কমেছে, সংশয় বেড়েছে। সামাজের তীব্র ফাটলের মূল অভিঘাত ব্যক্তি সম্পর্কের ওপর পড়ছে। উৎসব আসলে সেই ফাটলের ঝাঁজ পরিষ্কার বুঝা যায়। ঈদ এমন এক উপলক্ষ যা প্রতিবার বুঝিয়ে দেয় সমাজের ক্ষয়-ক্ষরণের গতিপ্রকৃতি।

যাহোক, শহরের ঈদ আর গ্রামের ঈদ কখনই একরকম ছিল না। শহরের ঈদ সবসময় ঝলমলে আর গ্রামের ঈদ কিছুটা মলিন ছিল। শহরের ঈদ হলো সুগন্ধিময় আর গ্রামের ঈদ হৃদ্যতায় ভরপুর। গত শতাব্দির ৮০ ও ৯০ দশকসহ হালজামানায় গ্রামে ঈদ উদযাপনে যেসব পরিবর্তন চোখে পড়ে তা বহুমাত্রিক। এর একটি প্রধানত প্রবণতা হলো ঈদের সমআনন্দের ধারণা এখন প্রদর্শনবাদ বা দোখানোতে পরিণত হয়েছে। ঈদের মর্মবাণীকে উদযাপনে রূপান্তর করা হলো।

ঈদের আনন্দ মানে এখন বেশভূষা, দামী জামাকাপড়, অবৈধ অর্থকড়ি বিলানোর তথাকথিত উদার তৎপরতা। কেবল তাই নয়, সমাজের নিচুস্তরে ক্ষমতাকেন্দ্রিক যে লড়াই তার অভিঘাতও পড়েছে ঈদ উদযাপনে। পাঁচগ্রামের মানুষ যেখানে এক ঈদগাহে নামাজ পড়তেন তা ভেঙে এখন পাঁচটি ঈদগাহ হয়েছে। সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঘিরে মানুষের নিয়ন্ত্রণবাদী মনোভাব প্রবল হয়েছে। ঈদগাহ পরিচালন ও নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রিক যে রাজনীতি তার সঙ্গে রয়েছে জাতীয় রাজনীতির গভীর সম্পর্ক। রাজনীতির বাইরে আর কিছু খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। রাজনীতি সংযুক্তির স্মারক না হয়ে বিযুক্তির উপলক্ষ হয়ে উঠছে।

জাতীয় রাজনীতি নাগরিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে প্রভাবিত  করছে। ঈদগাহকেন্দ্রিক কমিটিগুলোর নিয়ন্ত্রণও বলা যায় যে দল ক্ষমতায় সে দলের হাতে। কেবল নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তারা থেমে থাকে না। নিজেদের পছন্দসই ইমাম নিয়োগ করছে, ঈদের নামাজের জন্য প্রয়োজনীয় এনতেজাম করছে। অর্থাৎ গ্রামীণ পরিসরে ঈদগাহগুলো যে সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে একটি সর্ববজনীন রূপ ছিল সেটাইকেও রাজনৈতিক বাতাবরণের মধ্যে ফেলা হয়েছে। অর্থাৎ ধর্মীয় উৎসব ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর কুলষিত রাজনীতির থাবা পড়েছে। এ কারণে মানুষ স্বস্তি, একাগ্রতা ও শুভ্র মনোভঙ্গি নিয়ে ঈদগাহে নামাজ পড়তে পারছে না।

ধর্মীয় পাবলিক পরিসরগুলো প্রচুর পরিমাণে অস্বস্তি উৎপাদন করছে। এজমালি বন্দোবস্তে যেসব ঈদগাহগুলো চলতো সেগুলো রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণে পড়েছে। আধিপত্যবাদী রাজনৈতিক শক্তির থাবার কারণে এসব ঈদগাহর ওপর সাধারণ মানুষের মালিকানাবোধ কমে এসেছে। রাজনৈতিক উত্তাপহীন স্বস্তিদায়ক নামাজ আদায়ের জন্য তারা গ্রামে বা পাড়ার মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করছে।

এ কারণে যা ঘটছে তা হলো ঈদের উপলক্ষ ঘিরে পাঁচগ্রামের মানুষের এক জায়গায় মিলিত হওয়ার যে সুযোগ ছিল, পারষ্পরিক ভাববিনিময়ের ও সৌহার্দ্যের যে স্পেস তৈরি হয়েছির তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ পাঁচগ্রামের ঈদ এখন ঢুকে পড়ছে একটি গ্রামে বা একটি পাড়ায়। এভাবে ঈদের সম্মিলন বৃহৎ থেকে ক্ষুদ্র পরিসরে সংকুচিত হয়ে পড়েছে।

সম্প্রতি দেশে এক বড়ধরনের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়েছে। গত ১৫ বছর দারুণভাবে জেঁকে বসা ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতন ঘটেছে। পতনের পর সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তিসম্পর্কগুলো দারুণ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। আমাদের সমাজ হলো এক নিবিড়তামূলক সমাজ। এখানে একই পরিবারে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থক থাকেন। পরিবর্তীত পরিস্থিতিতে সেই জায়গাটি ঠুনকো অবস্থার ভেতর পড়েছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী বা সমর্থকদের অবস্থান সমাজে অত্যন্ত নাজুক।

সমাজে রাজনীতিকে ঘিরে অস্থিরতা বাড়ছে। বাড়ছে উৎকণ্ঠা। গুজব, মিথ্যাতথ্য, অপতথ্য ও মিথ্যাপ্রচারণায় সমাজ ছেয়ে গেছে। পারষ্পরিক অবিশ্বাস একটি বড় প্রবণতা হিসেবে দেখা যাচ্ছে। এটি নতুন পরিস্থিতি, নতুন বাস্তবতা। এ অবস্থায় জনগণ ঈদের মতো একটি সম্মিলনীধর্মী উৎসব পালন করতে যাচ্ছি। আসুন, সকলে সকলের পাশে দাঁড়াই, ঈদের আনন্দ সমানভাবে উপভোগ করি।

Comments

The Daily Star  | English

Not satisfied at all, Fakhrul says after meeting Yunus

"The chief adviser said he wants to hold the election between December and June"

2h ago