আমেরিকা কি সত্যিই রোহিঙ্গাদের নেবে

মানবিক কারণে লাখো রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়ার পর থেকেই যে আলোচনাটি সবচেয়ে বেশি সামনে এসেছে তা হলো, মিয়ানমারের এই সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর প্রত্যাবাসন।

মানবিক কারণে লাখো রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়ার পর থেকেই যে আলোচনাটি সবচেয়ে বেশি সামনে এসেছে তা হলো, মিয়ানমারের এই সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর প্রত্যাবাসন।

বাস্তবতা হলো, যে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী তাদের ওপর জাতিগত নিপীড়ন চালিয়ে দেশ ছাড়া করেছে, সেই দেশ যদি তাদের না নেয় বা যদি তারা নিজের ভূমিতে ফিরতে না পারে, তাহলে তারা কোথায় থাকবে? বাংলাদেশের মতো ছোট্ট আয়তনের এবং সীমিত সম্পদের দেশে কি তারা অনন্তকাল থাকবে?

আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠী যতই সহায়তা দিক না কেন, দশ লাখের বেশি মানুষকে কক্সবাজার বা ভাসানচরে বছরের পর বছর ধরে বসবাসের সুযোগ দেওয়াটা মানবিক দৃষ্টিতে যতই প্রশংসার কাজ হোক না কেন, এটি যে বাস্তবতসম্মত নয়, সেটি মিয়ানমার যেমন জানে, তেমনি মানবাধিকার নিয়ে সোচ্চার বিশ্বের অন্যান্য দেশও বোঝে। বাংলাদেশ তো বোঝেই। কারণ রোহিঙ্গা সংকটে সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী বাংলাদেশ। যে সংকটের জন্য বাংলাদেশ কোনোভাবেই দায়ী নয়।

নানা ফোরাম থেকে অনেক দিন ধরেই এই দাবি তোলা হচ্ছিলো যে, রোহিঙ্গাদের তৃতীয় কোনো দেশ যদি আশ্রয় দেয়; যাদের বিশাল ভূমি রয়েছে, সম্পদ রয়েছে— তাহলে বাংলাদেশের ঘাড় থেকে এই রাষ্ট্রহীন জাতির বোঝাটি নেমে যেতো। সেই আলোচনায় এবার আশার সংবাদ শুনিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢলের ৫ বছর পূর্তিতে গত ২৫ আগস্ট এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন বলেছেন, মিয়ানমারে নির্যাতিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের 'বড় সংখ্যক'কে তারা আশ্রয় দেবেন। একই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে জাপানও।

একইদিন ঢাকায় ফরেইন সার্ভিস একাডেমিতে এক আলোচনায় জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বলেছেন, 'রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার পাশাপাশি তৃতীয় দেশে স্থানান্তরের বিষয়টিও বিবেচনা করা দরকার। তৃতীয় দেশে শরণার্থীদের স্থানান্তর একটি স্থায়ী সমাধান। এটা শরণার্থীদের চাপ আন্তর্জাতিকভাবে ভাগাভাগি করার সুযোগ।'

আর যেসব দেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে তাদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, আন্তর্জাতিক ও সমন্বিত মানবিক সাড়াদানের অপরিহার্য একটি উপাদান হিসাবে তারা বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের দেশগুলো থেকে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর কার্যক্রম উল্লেখযোগ্য হারে বাড়াতে কাজ করছেন, যাতে রোহিঙ্গারা যুক্তরাষ্ট্রে তাদের জীবন খুঁজে নিতে পারে। যদিও কতজন রোহিঙ্গাকে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় দেওয়া হবে, তা বিবৃতিতে স্পষ্ট করেননি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

প্রসঙ্গত, মিয়ানমারে দমন-পীড়নের শিকার হয়ে মিয়ানমারের মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে শরণার্থী হয়ে আসার ঘটনা নতুন নয়। তবে সবশেষ ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানের মুখে বাংলাদেশ সীমান্তে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। কয়েক মাসেই এই সংখ্যা ৭ লাখ ছাড়িয়ে যায়। আগে থেকেই এখানে অবস্থান করা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে নতুন এই সংখ্যা যুক্ত হওয়ায় এখন ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে উদ্বাস্তু জীবন কাটাচ্ছে। তাদের ফেরত নিতে মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হলেও ৫ বছরেও প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি।

যে কারণে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন ইস্যুতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিবৃতি দিলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানাজন এ নিয়ে রসিকতাও করছেন— যার পেছনে আছে মানুষের সন্দেহ ও অবিশ্বাস। কারণ প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান শেষ পর্যন্ত কতজনকে তাদের দেশে আশ্রয় দেবে; এই প্রক্রিয়া কবে শুরু হবে; কতদিন নাগাদ প্রক্রিয়া শেষ হবে— তা নিয়ে জনমনে সংশয় রয়েছে।

বিষয়টি যদি শেষ পর্যন্ত প্রতীকী হয় যে, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান মিলে ২০ হাজার বা ৫০ হাজার রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিলো, তাতে বাংলাদেশের ওপরে এই জনগোষ্ঠীর বিশাল চাপ ততটা কমবে না। আবার মিয়ানমারের যে রাষ্ট্র কাঠামো এবং সে দেশে নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারও যখন ক্ষমতায় থাকে, তখনও তারা যেহেতু মূলত সেনা নিয়ন্ত্রিত থাকে এবং রোহিঙ্গাদের ওপর মূল নির্যাতনটা চালায় সেনাবাহিনীর সদস্যরাই— ফলে কোনোদিন এই ১০ থেকে ১২ লাখ রোহিঙ্গা যে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারবে, সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ।

মিয়ানমারের সঙ্গে যেহেতু রাশিয়া ও চীনের মতো শক্তিশালী রাষ্ট্রের সখ্যতা রয়েছে এবং মিয়ানমারে যেহেতু চীনের বিশাল বিনিয়োগ আছে— ফলে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোও যদি চাপ দেয়, সেই চাপ আমলে না নিলেও যে মিয়ানমারের খুব বেশি অসুবিধা হয় না, তা এরইমধ্যে প্রমাণিত।

রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা চললেও এবং শেষ পর্যন্ত এই মামলায় মিয়ানমারকে দোষী সাব্যস্ত করে যদি রায় দেওয়া হয়, তারপরেও তারা বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে, সেই সম্ভাবনাও কম। তারচেয়েও বড় কথা, আন্তর্জাতিক চাপে মিয়ানমার যদি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয় এবং রোহিঙ্গারা যদি নিজ দেশে ফিরে যেতেও পারে, তারপরও সেখানে তাদের জীবনের নিরাপত্তা কতটুকু থাকবে— সেটিও বিরাট প্রশ্ন।

বাংলাদেশ নিজেই যেখানে বিপুল জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ, সেখানে কীভাবে আরেকটি দেশের লাখো মানুষকে বছরের পর বছর ধরে আশ্রয় দেবে? প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত খোদ যুক্তরাষ্ট্রে একটি অনুষ্ঠানে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, 'বাংলাদেশের অর্থনীতি ধ্বংস করে দিতে চায় মিয়ানমার'।

আরও যে প্রশ্নটি সামনে আসছে তা হলো, যদি আন্তর্জাতিক বিশ্ব বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা বন্ধ করে দেয় বা কমিয়ে দেয়, তখন কী হবে? বাংলাদেশ কি একা প্রায় ১২ লাখ মানুষকে খাওয়াবে? প্রশ্নটা এ কারণে যে, বাংলাদেশে ৫ দিনের সফর শেষে গত ২৫ মে রাজধানী ঢাকার একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার প্রধান ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি বলেছেন, 'ইউক্রেন ও আফগানিস্তানের পরিস্থিতির কারণে রোহিঙ্গাদের সাহায্য নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি। দাতাদের উচিত হবে না এই সহায়তা কমানো।'

এসব বিবেচনায় নিয়েই তৃতীয় কোনো দেশে এই রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসনই উপযুক্ত সমাধান— যে সম্ভাবনায় কিছুটা হলেও আলো জ্বেলেছে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান। কিন্তু এরকম তৃতীয় দেশের সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। ইউরোপের সম্পদশালী এবং বড় আয়তনের দেশগুলোর পাশাপাশি মালয়েশিয়া এবং সৌদি আরবের মতো দেশগুলোও যদি বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয় এবং একটি সহজ ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাদের পুনর্বাসিত করতে পারে, তাহলে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে বাংলাদেশ। সুতরাং বাংলাদেশ সরকারকেই এই দেন-দরবারটা আরও বেশি করে করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোকে মিয়ানমারের ওপর আরও বেশি চাপ প্রয়োগ করতে হবে।

যদিও রোহিঙ্গাদের ধর্মীয় পরিচয় এবং এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র-চীন-রাশিয়া-ভারতের পারস্পরিক কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের বিষয়টিও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ একটি রাষ্ট্র বা তার সামরিক বাহিনী একটি জাতিগোষ্ঠীকে পরিকল্পিতভাবে নিধন করার উদ্দেশ্যে তাদের ওপরে গণহত্যা ও ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটিয়ে দেশ ছাড়া করে দিল, অথচ সেই দেশটির বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ তার মিত্ররা এমন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারলো না বা নিলো না, যাতে মিয়ানমার বাধ্য হয় বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে। প্রশ্ন হলো, মুসলিম না হয়ে রোহিঙ্গারা যদি বৌদ্ধ হতো, তাহলে এই ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় বন্ধু চীনের ভূমিকা কী হতো? রোহিঙ্গাদের ধর্মীয় পরিচয় যদি খ্রিষ্টান হতো, তাহলে ইউরোপ-আমেরিকার শক্তিশালী দেশ তো বটেই, মিয়ানমারের আরেক বন্ধু রাশিয়ার ভূমিকা কী হতো? রোহিঙ্গাদের অধিকাংশ যদি হিন্দু হতো, তাহলে মিয়ানমারের সবচেয়ে নিকটতম শক্তিশালী প্রতিবেশী ভারত কী করত?

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আসিয়ানের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মিয়ানমার আসিয়ানের সদস্য; কিন্তু রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো কিংবা তৃতীয় কোনো দেশে পুনর্বাসনের ইস্যুতে এখন পর্যন্ত আসিয়ানের ভূমিকা চোখে পড়ার মতো নয়। ফলে প্রশ্ন উঠতে পারে, তারাও এই সংকটের সমাধান চায় কি না বা এই সংকট সমাধানের মুরদ তাদের আছে কি না?

এসব কারণেই রোহিঙ্গা সংকট বছরের পর বছর ধরে ঝুলে আছে এবং সংকট সমাধানে শক্তিশালী দেশগুলো নানারকম প্রতিশ্রুতি দিলেও আখেরে পরিস্থিতির সেরকম কোনো উন্নতি হয় না। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সেই প্রক্রিয়াটি শুরু হওয়ার আগে এ নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments