লাশ দখলের রাজনীতির অবসান হবে কবে?

দেশ এক উদ্ভট সময়ের মধ্য দিয়ে চলছে। নদী দখল, মাঠ দখলের মতো চলছে লাশ দখলেরও প্রতিযোগিতা। তাই তো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে গিয়ে প্রতিপক্ষের হামলায় কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্রের সেবকদের (?) গুলিতে যদি কেউ মারা যান, তার লাশের সঙ্গে সঙ্গে তার রাজনৈতিক পরিচিতি নিয়ে শুরু হয়ে যায় টানাটানি। অবশ্য তিনি যদি কোনো হোমরা-চোমরা ব্যক্তি হন, এই সুযোগটা থাকে না, অপেক্ষাকৃত গরীব এবং কম পরিচিত হলেই টানাটানিটা লাগে বেশি। 
নারায়ণগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির সংঘর্ষে নিহত শাওন। ছবি: সংগৃহীত

দেশ এক উদ্ভট সময়ের মধ্য দিয়ে চলছে। নদী দখল, মাঠ দখলের মতো চলছে লাশ দখলেরও প্রতিযোগিতা। তাই তো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে গিয়ে প্রতিপক্ষের হামলায় কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্রের সেবকদের (?) গুলিতে যদি কেউ মারা যান, তার লাশের সঙ্গে সঙ্গে তার রাজনৈতিক পরিচিতি নিয়ে শুরু হয়ে যায় টানাটানি। অবশ্য তিনি যদি কোনো হোমরা-চোমরা ব্যক্তি হন, এই সুযোগটা থাকে না, অপেক্ষাকৃত গরীব এবং কম পরিচিত হলেই টানাটানিটা লাগে বেশি। 

দীর্ঘদিন ধরে এমনটিই চলে আসছে এ দেশে। আর এই লাশ নিয়ে টানাটানির খেলায় বোধগম্য কারণেই দেশের দু-তিনটা বড় রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে সরকারি দলই এগিয়ে থাকে। এই দলগুলোর কাছে জীবিত কর্মীদের তেমন মূল্য না থাকলেও রাজনৈতিক সংঘাতে মৃত বা লাশ হয়ে যাওয়া মানুষদের কদর অনেক বেশি। কারণ কখনো কখনো মৃতরা, বিশেষ করে রাজনৈতিক সংঘাতে মৃত যারা, জন-উত্তেজনায় যে শক্তির যোগান দিতে পারে, জীবিতরা তা পারে না। সে কারণেই লাশ নিয়ে টানাটানি বাঁধে, লাশের পোস্টমর্টেমের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তার পারিবারিক উত্তরাধিকারের ঠিকুজি বের করা। একবার কোনোভাবে লাশকে দখলে নিতে পারলে আর তাকে নিজেদের বলে প্রমাণ করতে পারলে যেমন সহজ হয় জন-উত্তেজনা সৃষ্টি করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা, তেমনি সহজ হয় নিজেদের অপকর্মজাত জনরোষে জল ঢালা। অবশ্য বুর্জোয়া রাজনীতিতে, বিশেষ করে যেখানে কর্তৃত্ববাদী সরকার ক্ষমতায় আসীন, এই প্র্যাকটিস যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশে এই ধারারই সর্বশেষ সংযোজন নারায়ণগঞ্জের বিএনপিকর্মী শাওন।

শাওন মিছিলে ছিল। শুধু ছিলই না, পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত ছবি থেকে যা দেখা যায়, একেবারে সামনের সারিতে ছিল। তারপরও তার রাজনৈতিক পরিচয় ছিনতাই করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। জানা যায়, ঘটনার দিন রাতের বেলা সরকার সমর্থিত দলের লোকজন শাওনকে তাদের দলের লোক বলে দাবি করে তার বাড়ির সামনে গিয়ে জড়ো হয়। উদ্দেশ্য- প্রতিপক্ষ বিএনপি যাতে শাওনের লাশের দখল নিতে না পারে, অনেকটা যেন চর দখলের মতো অবস্থা। পরদিন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বললেন, 'শাওন সরকারি দলের স্থানীয় এক নেতার ভাতিজা'। অন্য একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী দাবি করলেন, 'শাওন ছিল যুবলীগের একজন কর্মী'। এই দাবি আর পাল্টা দাবির মধ্যে স্থানীয় পুলিশ বলছে, এ লাশ যুবদলের কারও নয়, এ লাশ এক গ্যারেজ কর্মীর। এরইমধ্যে খবর বেরিয়েছে ডিবির একজন কর্মকর্তা ঘটনার সময় চায়নিজ রাইফেল দিয়ে গুলি চালিয়েছেন, যদিও তার নামে কোনো রাইফেলই ইস্যু করা ছিল না। পত্রিকায় তার ছবিও ছাপা হয়েছে। প্রশ্ন হলো- রাইফেল ইস্যু করা না থাকলেও এই কর্মকর্তা রাইফেল পেলেন কোথায়? এসব প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে লাশের রাজনৈতিক পরিচয়টাই মনে হয় মুখ্য হয়ে উঠেছে। আর আড়ালে পড়ে যাচ্ছে একজন জলজ্যান্ত মানুষের লাশ হওয়ার ঘটনা।

তথ্যমন্ত্রীর কথাকে যদি সত্যি বলেই মেনে নেওয়া হয় যে, নিহত শাওন একজন আওয়ামী লীগ নেতার ভাতিজা, তাহলেও তো প্রশ্ন থেকেই যায়, এক দলের নেতার ভাতিজা হলেই কেউ অন্য দল করতে পারে না বা পারবে না- এমন কথা সংবিধানের কোথাও কি লেখা আছে? যদি না থাকে তাহলে এই 'ভাতিজা' প্রশ্নটিই বা আসবে কেন?

বাংলাদেশ একটা ছোট্ট দেশ। এই দেশে এমন অনেক পরিবার আছে- যে পরিবারের এক ভাই আওয়ামী লীগ করে, অন্য ভাই বিএনপি বা অন্য কোনো দল করে। তাতে অপরাধের তো কিছু নেই! এমনও শোনা যায়- সরকারি দলের এক উঁচু পর্যায়ের নেতার ছেলে নাকি ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে হলি আর্টিজান অপারেশনে অংশ নিয়েছিল। তাতে কী হয়েছে? পুত্রের কর্মের দায় পুত্র বহন করবে, আর পিতার দায় পিতা। এ দেশে এমন অনেকে আছেন, যার পিতা বিএনপি বা অন্য কোনো বিরোধীদল করে, আর ছেলে করে আওয়ামী লীগ। এই বাস্তবতায় তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্য যে রাজনৈতিক বালখিল্যতার পরিচায়ক, তা তো বলাই বাহুল্য। আরেক মন্ত্রী, যিনি বলেছেন শাওন যুবলীগ করতো, সেটিও হাস্যকর বই আর কিছু নয়। কারণ, পত্রিকায় প্রকাশিত ছবি থেকে স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে শাওন বিএনপির মিছিলের একেবারে সামনের সারিতে। যুবলীগের একজন কর্মী বিএনপির মিছিলের পুরোভাগে আসে কেমন করে? আর যদি সে যুবলীগের কর্মী হয়েও থাকে, তাহলে তাকে গুলিটাই বা করল কে? সার্বিক বিবেচনায় শাওনকে যুবলীগের কর্মী বলে প্রতিষ্ঠিত করার এই যে প্রয়াস, তা নিতান্তই হাস্যকর আর রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের পরিচায়ক নয় কি?

এবার আসা যাক পুলিশের কথায়। পুলিশের কাজ শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা, কোনো মৃত ব্যক্তির রাজনৈতিক পরিচয়ের সার্টিফিকেট বিতরণ করা নয়। মানি, শান্তিশৃঙ্খলা বজার রাখার স্বার্থে পুলিশ প্রয়োজনে গুলি চালাতে পারে। তবে তারও একটা প্রটোকল আছে। তাকে সেই প্রটোকল আর বিধিবিধান মেনেই গুলি চালাতে হবে। এর বাইরে গেলে পুলিশকেও জবাবদিহি করতে হয়। কিন্তু নারায়ণগঞ্জে যা ঘটেছে তাতে প্রটোকল মানার কোনো বালাই-ই ছিল না। একজন পুলিশ কর্মকর্তা- যিনি কি না গোয়েন্দা বিভাগে কর্মরত, তিনি কীভাবে প্রত্যক্ষ অপারেশনে অংশ নেন, তা-ও আবার অন্যের অস্ত্র নিয়ে? সর্বোপরি, শাওন যুবদল করতো না যুবলীগ করতো তা পুলিশের বিবেচনার বিষয় নয়। অথচ পুলিশ শাওন প্রসঙ্গে সরকারি দলের দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করতেই যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে যে, শাওন যুবদলের কেউ নয়।

কিন্তু কেন- কেন এমনটি হয় বা হচ্ছে? কারণ অনেক। একটা দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং প্রতিষ্ঠানসমূহ যখন ভেঙে পড়ে, জীবিত মানুষের মূল্য তখন কমে যায়, বেড়ে যায় লাশের মূল্য। সে কারণেই কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী জীবিত মানুষের প্রতি আস্থা হারিয়ে আশ্রয় খুঁজে লাশের কাছে, লাশকে তারা ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা ক্ষমতায় টিকে থাকার শেষ অবলম্বন হিসেবে আঁকড়ে ধরে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যে কারণটি কাজ করে তা হলো- শাসকগোষ্ঠী এ কথা ভালোভাবেই জানে যে লাশ যদি একবার জেগে উঠে তাকে দমিয়ে রাখার ক্ষমতা কারও নেই। এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ ঊনসত্তরের আসাদ কিংবা নব্বইয়ের ডা. মিলন। আসাদের লাশ কাঁপিয়ে দিয়েছিল লৌহমানব আইয়ুবের সিংহাসন, আর ডা. মিলনের লাশ ক্ষমতাচ্যুত করেছিল স্বৈরশাসক এরশাদকে।

যুগে যুগে এমনই হয়, এমনই হয়ে থাকে। তাই শাসকগোষ্ঠী লাশকে ভয় পায় জীবিতদের চেয়েও বেশি। ভয় পায় বলেই তাকে নিজের দখলে নিতে চায়, যাতে এরা অন্যের দখলে গিয়ে জনরোষের বিস্ফোরণ না ঘটাতে পারে। কিন্তু ইতিহাস বলে- জীবিত মানুষ পরাভব মানলেও লাশেরা কারও পরাভব মানে না। তাই লাশ দখলের রাজনীতিও খুব দীর্ঘস্থায়ী হয় না। বাংলাদেশেও হয়নি, হবেও না। কিন্তু প্রশ্ন হলো- এর অবসানই বা হবে কবে?

মোশতাক আহমেদ: সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা

[email protected]

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments