হে পুরুষ, দৃষ্টি নত করুন

আমাদের এই সময়ের পুরুষদের অন্যতম দুঃখ নারী, নারীর পোশাক—এসব নিয়ে। আমার মুখে দাড়ি থাকায় অনেকে ভাবেন, আমার কাছে এসব দুঃখের কথা বলা যায়।

সেদিন রিকশায় এক মেয়ে বন্ধুর সঙ্গে যাচ্ছি, সে গলাবন্ধ ফতুয়া আর প্যান্ট পরা ছিল। মাঝপথে বন্ধুটা কিছু কিনতে রিকশা থেকে নেমে দোকানে যেতেই রিকশাওয়ালা খানিকটা নালিশের সুরে বললেন, 'এইটা কী পোশাক পরছে!'

এমন সময়গুলোতে আমার বাজিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে বেশ। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, 'কী সমস্যা এতে, এই পোশাকে?' বললেন, 'না, এই যে শরীর দেখা যায়।' আমি বললাম, 'আপনি তাকাচ্ছেন কেন? না তাকালেই পারেন। তাহলেই তো ক্যাচাল মিটে যায়।'

আমি প্রায় সময়ই মানুষের এসব প্রশ্নের মুখে পড়ি। তখন বলি, দেখেন, আল্লাহ কিন্তু আগে ছেলের চোখ আর লজ্জ্বাস্থানের হেফাজতের কথা বলেছেন। তারপর মেয়েদের পোশাক নিয়ে বলেছেন। প্রথম দায়িত্ব আপনার, না তাকানো। আপনি না তাকালেই ঝামেলা মিটে যায়। তারপর নারীদের ঠিক করতে দিন তারা পোশাকের জন্য, কাজের জন্য আল্লাহর কাছে কী জবাব দেবে, নাকি দেবে না।

একটা মেয়ে যদি কিছু না পরেও বের হয়, সেসময়েও পুরুষকে অধিকার দেওয়া হয়নি ওই নারীর দিকে তাকানোর। কারণ, আল্লাহ জানেন, ঝামেলাটা প্রথমত কোথায়। তাই প্রথমেই ছেলেদেরকে নিজেদের চোখ সামলে রাখতে বলেছেন। আর চোখ সামলে গেলেই বাকি সব সামলে শেষ। নারীও যেকোনো ঝামেলা থেকে বাঁচবেন।

তবুও আমাদের পুরুষরা জন্মসূত্রে পাওয়া ক্ষমতা বলে ভেবেই নেন, নারীর সবকিছুতেই তারা অধিকারী। সেই অধিকার বলে তারা নারীতে কর্তৃত্ব করবে, বল খাটাবে; নারীর আচরণ, চিন্তা নির্ধারণ করে দেবে। কিন্তু আদতে কি তাই?

ইসলাম নিয়ে কিছুটা পড়াশোনার সুযোগ হয়েছে। সেই সুযোগ থেকে কিছু আলাপ করাই যায়। প্রথমত, স্বামী ও স্ত্রীর ক্ষেত্রে কোরআনে বলা আছে, নারীরা পুরুষদের জন্য পোশাক আর পুরুষরা নারীদের জন্য পোশাক। তুলনাটি থেকে দেখা যায়, একটা সমতার ব্যাপার আছে, একটা সহযাত্রার ব্যাপার আছে। সমমর্যাদা ও সম্মানের ব্যাপার আছে। অর্থাৎ, পরিবার জীবনে নারী আপনার সমান মর্যাদা রাখেন। সেই মর্যাদার খাতিরে আপনি, আপনার পারিবারিক সব কাজে ২ জন মিলে সিদ্ধান্ত নেবেন। ২ জন মিলে বোঝাপড়া করবেন, পরিকল্পনা করবেন জীবন যাপনের।

তারপর আসে নারীর মৌলিক অধিকারের বিষয়, তার শিক্ষার বিষয়, ন্যায্যতা পাওয়ার বিষয়। এসব অধিকার দেওয়ার জন্য আদতে পুরুষ কেউ নয়। এটা সমাজ তাকে দেবে, রাষ্ট্র তাকে দেবে। একজন নারী পড়াশোনা করবেন, সেটা কোনো পুরুষ নির্ধারণে না। একজন নারী তার অধিকারগুলো বুঝে পাবেন, কোনো পুরুষের নির্ধারণে না। একজন নারী তার জীবনে ন্যায্যতা পাবেন, কোনো পুরুষের নির্ধারণে না। তিনি এগুলো পাবেন তার জন্মগত অধিকারে।

এবার আসে নারীর কর্তৃত্বের আলাপে। সমাজে নারীর কর্তৃত্ব নারীত্বের সব জায়গায়। সেখানে পুরুষের কোনো অধিকারই নেই। রাসুল (সা.) তার স্ত্রীদের সঙ্গে নারীত্বের যাবতীয় আলাপ করে গেছেন, জানিয়ে গেছেন। সেগুলো কোনো পুরুষকে জানাননি। অথচ, আমাদের পুরুষরা এসব ক্ষেত্রেও নিজেদের কর্তৃত্ব দেখাতে চান।

নারীর ভরণপোষণের দায়িত্ব কী পুরুষের? অবশ্যই তা নয়। বরং এখানে কাজ বণ্টিত। কেউ বাইরে কাজ করবে, কেউ ঘরে কাজ করবে। বাইরে কাজ করবে পুরুষ, ঘরে নারী। কোনো ঘরে এর বিপরীত হতে পারে। রাসুল (সা.) এমন একজন নারীকে বিয়ে করেছিলেন, যিনি তাকে খাইয়েছেন, পরিয়েছেন। নবুয়াত প্রাপ্তির চরম মুহূর্তগুলোয় ঘরে-বাইরে দুটোই সামলেছেন একলা হাতে। এখানে পুরুষ নারীর ভরণপোষোণ দিচ্ছে না। বরং তিনি তার ভাগের কাজটি করছেন। এই কাজের জন্য তিনি নিজেকে ক্ষমতাবান ভেবে নিলে, নিজেকে নিয়ে বেশি ভাবছেন বলেই বলবে ধর্ম।

আমাদের পুরুষরা ভেবে নেন, নারীর শিক্ষার অধিকার, তার ন্যায্যতা পাওয়ার অধিকার, তার চলাফেরার অধিকার, সবই ঠিক করে দেবেন তারা। অথচ ধর্মের মূল জায়গায় দেখলে এমন কিছু পাওয়াই যায় না। বরং, নারীর অধিকার নিয়ে রাসুল (সা.) যা বলেছেন তা হচ্ছে, নিজের মেয়ের বিয়ে দেওয়া পর্যন্ত বা মৃত্যু পর্যন্ত দেখভাল করে জান্নাত পাওয়া সম্ভব।  তাকে অধিকার দিতে হবে সবটুকু। একটা ছেলে যতটুকু পায়, ততটুকুই।

কন্টকাকীর্ণ পথ নিয়ে এমন হাদিস রয়েছে, যেখানে একজন নারী একা পথ চলবেন। নারীর চলাফেরার অধিকার আপনি কেমন করে নিজের হাতে নেন, যেখানে হাদিসেই আছে এমন। নারীর চলাফেরার অধিকার সেখানে দেওয়াই আছে। আর বলা আছে, এক সময় পুরুষ যখন ভালো আচরণের অধিকারী হবে, তখন নারীর নিরাপত্তায় কোনো সমস্যাই থাকবে না।

আমার কাছে মনে হয়, আপনি ধর্ম ঠিকঠাক মানতে চাইলে কারো ওপর কর্তৃত্ব খাটাতে পারবেন না। বরং আপনি হয়ে উঠবেন একজন সমমানুষ, যিনি তার পাশের মানুষের ওপর প্রবল কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠেন না। বরং সহমর্মী হয়ে থাকেন।

সম্প্রতি পোশাক নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। নরসিংদীর রেলস্টেশন কাণ্ডের পর হাইকোর্টের একটি মন্তব্য। সেই মন্তব্যের পক্ষ নিয়ে কিছু মানুষের অভিনন্দন জানানো। তারপর টিএসসিতে সেই অভিনন্দন জানানো মানুষের আলাপের সমালোচনা করে কিছু মানুষের আবারও জমায়েত। এই জমায়েতে কয়েকজন নারী তাদের পছন্দের পোশাক পরেছেন। ফেসবুক জুড়ে এখন চলছে এই নারীদের ব্যঙ্গ করার মহড়া।

অথচ, আলাপটা শুরুতেই থেমে যেতে পারত। কোনো পুরুষ কি আদতে কোনো নারীর পোশাক নির্ধারণ করে দেওয়ার অধিকার আদৌ রাখেন? রাখলে, কেন রাখেন? কে দিয়েছে তাকে এই অধিকার? কেউ না। ধর্ম পোশাকের একটা নির্দিষ্ট ধরন বলে দিয়েছে। কোনো নারী যদি তা না পরে, সেই দায়ভার নারীর একান্ত, কোনো পুরুষের না। বদলে পুরুষ এই অধিকারটুকু নিজে নিয়ে তা চাপিয়েও দিচ্ছেন নারীর উপর। আর তার এই চাপানো পোশাকে কোনো নারী না থাকলে, সেই নারীর কপালে জুটছে নানা রটনা। শুনতে হচ্ছে গালি, নানা অভিধা—কত কী।

হে ধর্মপ্রাণ ভাইয়েরা, আপনারা নিজেদের চোখের দায়টুকু নারীকে না দিয়ে নিজেই নিতে শেখেন। তাতেই অর্ধেক ঝামেলা মিটে যাবে। আর অন্যের ওপর খবরদারি করা ছেড়ে দিয়ে নিজের পাপের ভারটুকু নিজে নিন। তখন নারীর পোশাকে আর কোনো সমস্যাই মনে হবে না।

তবু যদি আলাপ করতেই হয়, তাহলে আলাপ করতে পারেন পোশাকের ইতিহাস নিয়ে, এই অঞ্চলের পোশাকের ইতিহাস নিয়ে, বিবর্তন নিয়ে, পোশাকের রাজনীতি নিয়ে, পোশাক কীভাবে আমাদেরকে নানাভাবে সামাজিক আকৃতি দেয় ও দিয়েছে সেই বিষয় নিয়ে। পোশাক কীভাবে হয়ে ওঠে সৌন্দর্য আর অসুন্দরের প্রতীক, তা নিয়ে। তাতেও যদি মন ভরে!

 

মীর হুযাইফা আল মামদূহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। সেই সঙ্গে তিনি কাওমি মাদ্রাসা বোর্ড থেকে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেছেন। তিনি 'ভারতবর্ষের মাদ্রাসা' বইয়ের লেখক।

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Chattogram’s garment factories fear fallout from US tariffs

Owners of Chattogram-based readymade garment factories, many of which do business with buyers in the United States, are worried about a US tariff hike to 35 percent set to take effect on August 1.

11h ago