বসকে বসতে দিন!

বঙ্গদেশের মানুষের কোমরের জোর বরাবরই কম। এরা বসতে চায়, বসতে পারলে শুতে চায়! বসা নিয়ে তাই এ জাতির বাড়াবাড়ি বরাবরই। এরা বাসে উঠলে বসতে চাইবেই। ট্রেনে বা লঞ্চে উঠলে শুধু বসতে নয়, শুতেও চাইবে। যে কোন স্থানে পাঁচ মিনিট দাঁড়ালে, পাঁচ ঘণ্টা বসে তা উশুল করতে চাইবে, যে কোন মূল্যে। কোন দিক না তাকিয়ে, শুধু পশ্চাৎদেশ চালান করে জায়গা দখল করতে পারাতে যেন এদের জুড়ি নেই।
বহু বছর ধরে, ঔপনিবেশিক যুগ কাটিয়ে বাঙালিদের মনস্তত্ত্বে দুটো বিষয় ঢুকে গেছে। এক, এরা গোলামী করতে সিদ্ধহস্ত। দুই, এরা অন্যদের গোলাম ভাবতেও পারঙ্গম। সম্প্রতি বাংলাদেশিদের নির্মল আনন্দ করার এক উপলক্ষ এনে দিয়েছে এ দেশের কিছু তরুণী। যারা এ দেশের দরিদ্র আর প্রান্তিক সমাজের প্রতিনিধি। জীবনের অনেক স্বাদ আহ্লাদ থেকে বঞ্চিত এসব মেয়েরা শুধু ফুটবলে নৈপুণ্য দেখিয়ে, দক্ষিণ এশিয়া জয় করেছে। দেশবাসী তাই পেয়েছে ছাদ খোলা বাসে উদযাপনের প্রথম স্বাদ, যা কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা ক্রিকেট দিতে পারেনি। দেশবাসীও তাই, উজাড় করে তাদের বরণ করেছে।
এমন বরণের মাহেদ্রক্ষণে, এক বিষাদের ছোঁয়া লাগে বাঙালির মনে। মিডিয়ার বদৌলতে, দেশবাসী সরাসরি দেখতে পারে, যে, সংবাদ সম্মেলনের সময় সরকারী কর্তাব্যক্তিদের কারণে, চেয়ার ছেড়ে দিতে হলো নারী দলের বরেণ্য কোচকে। তাকে দাঁড়াতে হলো পেছনের সারিতে, নারী দলের অধিনায়কের পাশে। সরাসরি সম্প্রচারে মানুষ এই বিষয়টা দেখল। প্রতিবাদে ভরে গেল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। গণমাধ্যমেও তা নিয়ে খানিকটা সংবাদ করতে দেখা গেলো। যাদের সরাসরি অবদানে, দেশ এত বড় উদযাপনের অভিজ্ঞতা পেল, সেই খেলোয়াড় আর প্রশিক্ষকদের সংবাদ সম্মেলনে চলে যেতে হলো পেছনে, খানিকটা অলক্ষ্যে। এমনকি চেয়ার ছাড়ার সময় হেডকোচ যত দ্রুত মঞ্চ প্রস্থান করে পেছনে চলে গেলেন, তা দেখে মনে হচ্ছিল তিনি আসলে এমনটার জন্যই অপেক্ষা করে ছিলেন। নির্বাহী আর রাজনৈতিক ভিআইপিদের সামনে বসার ধৃষ্টতা দেখানো থেকে তিনি যেন পালিয়ে বাঁচলেন। মূলধারার মিডিয়ায় ও সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত ফটো শুটেও, নারী দল আর তাদের প্রশিক্ষকদের পেছনে ফেলে, কর্তা ব্যক্তিদের সামনে এসে ছবি তুলতে দেখা গেল। তবে, এদেশের প্রেক্ষাপটে, রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের এমন আচরণ অস্বাভাবিক নয়। এখানে, এমনটাই হওয়ার কথা। গুণী লোকের প্রকৃত মূল্যায়ন বা মর্যাদা দিতে আমাদের যত কার্পণ্য। সম্মানটাও সঠিক ভাবে আমরা দিতে শিখিনি। পদবীধারীদের আজ সদা বিচরণ সর্বস্থানে ও সম্মুখভাগে। সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা না দিতে পারলেও, মিথ্যে অহমিকার উচ্চারণে তারা শীর্ষে।
আমরা এক আরামপ্রিয় আর চেয়ারলোভী জাতিতে পরিণত হয়েছি গত শতাব্দীর শেষ দিক থেকে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন আর আমলাতান্ত্রিক সামন্তপ্রভুদের কাছে, এ দেশের মানুষ আজ অসহায়, পরিত্যক্ত। রাজনীতি আজ সামাজিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সব পরিমণ্ডলকে গ্রাস করেছে। রাজনীতি না করলে, যার কুলির কাজও জুটত না, সেও আজ রাজনীতির বদলে সর্বখানের প্রভু সেজে বসেছে। স্কুল-কলজের অনুষ্ঠানে, দেখবেন রাজনৈতিক লোকদের ভিড়ে, স্কুল-কলেজের প্রতিষ্ঠান প্রধানরা পর্যন্ত মঞ্চে বসার জায়গা পায় না। পাতি নেতা তার প্রভুনেতার পাশের জায়গা দখল করতে গিয়ে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের বসার জায়গা দখল করে ফেলে। ঠিক এমনি ভাবে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মিটিং বা প্রোগ্রামে, রাজনীতিবিদরা আলেম সেজে বসে পড়ে সামনের সারিতে। সারা বছর মসজিদের বারান্দায় না উঠেও শুধু রাজনীতির জোরে মসজিদ-মাদ্রাসার চেয়ারগুলো দখল করে থাকে। এদের এমন অনাচার দেখে, ভদ্রলোকেরা আজ আর সামাজিক, ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে আসেন না।
রাজনৈতিক প্রভুদের পাশাপাশি, এদেশে চলে সরকারি আমলাদের এক মহা দৌরাত্ম্য। ইনারা শুধু বসতে চায়। চায় একছত্র কর্তৃত্ব। চায় মোটা ভারি ভারি চেয়ার। নিজেদের যোগ্যতার ঘাটতি বা জবাবদিহিহীনতার প্রায়শ্চিত্ত যেন তারা করতে চান তাদের সব রাজকীয় চেয়ার দিয়ে। সরকারি অফিস আদালতের তোয়ালে পেঁচানো চেয়ারের কর্মচারীরা, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের লোকদের ছাড়া, শক্তিহীন সাধারণ মানুষকে খুব একটা আমলে নিতে চান না। মোটা চেয়ারে বসা মোটা মানুষগুলোর হম্বিতম্বি দেখে, সাধারণ মানুষ তাদের স্যার বলবে নাকি ম্যাডাম বলবে, তাই নিয়ে সারাক্ষণ থাকে দ্বিধাদ্বন্দ্বে। যেখানে, সরকারি কর্মচারীদের উচিৎ ছিল, এদেশের সাধারণ মানুষদের স্যার বলে ডাকা, সেখানে তারা নিজেরা যদি কখনো স্যার ডাক শুনতে না পান, তাহলে তাদের মেজাজ হয় দেখার মতো। অবশ্য, এক শ্রেণির তেলবাজদের কল্যাণে, নির্বাহী কর্মচারীরা, কর্মকর্তা এমনকি রাষ্ট্রকর্তাও সেজে বসার সুযোগ পান। সরকার, তাদেরকে রাজনৈতিক উদ্দেশে ব্যবহার করার কারণে, এক পর্যায়ে এরা রাজনৈতিক সরকারকেও তাচ্ছিল্য দেখাতে ভ্রুক্ষেপ করে না। বসে বসে কাজ করার মতো আরামের এমন দেশ যে আর কোথাও নেই। তাই তো, এটা অনেকের কাছে বেহেস্তের মতো।
তবে, সব মঞ্চের চেয়ারগুলো যদি 'তপ্ত লোহার' তৈরি হতো, তাহলে অযোগ্য, অবিবেচক লোকদের বসা নিয়ে বাড়াবাড়িতে, এদেশের সাধারণ মানুষের কোনো ক্ষোভ থাকত না।
এম আর ইসলাম: শিক্ষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments