‘ইলিশ ধরা’ বন্ধের মৌসুমে সিইসির ‘পুলিশ ছোঁয়া’
গ্রহণযোগ্য-অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রত্যাশার পর দলবাজ পুলিশ ও প্রশাসন নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ বার্তা দিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আওয়াল। উষ্মা প্রকাশ করে বলেছেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পুলিশ অনেক ক্ষেত্রে দলীয় কর্মীর ভূমিকায় নামে। এদের বিষয়ে কী করবেন তিনি?- সেই জবাব দেননি। ইসি বিট করা সাংবাদিকদের কেউ তাৎক্ষণিক তাকে এ বিষয়ক প্রশ্নও করেননি।
বছরখানেক বাদেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এর আগে রয়েছে সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের বেশকিছু নির্বাচন। জেলা পরিষদ নির্বাচন এক সপ্তাহ পরই। জেলা পরিষদ নির্বাচনে কী হচ্ছে আর কী হওয়ার বাকি আছে?- এ প্রশ্ন এখন অনেকটাই অবান্তর। এসব নির্বাচনে মাঠ প্রশাসন ও পুলিশের পারফর্ম দৃষ্টে সামনের বাকি নির্বাচনগুলোর সম্ভাব্য ধরন অনেকটাই স্পষ্ট। এর মাঝেই ইলিশ ধরা বন্ধের মৌসুমে শনিবার হলিডেতে পুলিশকে ধরেও ধরলেন না সিইসি। কিঞ্চিত ছুঁয়েছেন। ৬১ জেলার ডিসি-এসপিকে ডেকে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে বৈঠকে খানিকটা উষ্মা প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, নির্বাচনে অনেক ক্ষেত্রেই দলীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় পুলিশ।
নিঃসন্দেহে এটি তার যৌক্তিক উপলব্ধি। কমিশন এবার এ বিষয়ে শক্ত অবস্থানে থাকবে বলেও জানিয়েছেন। কেমন হবে সেই অবস্থানটা? আরও গুরুতর প্রশ্ন- এ ধরনের দলবাজ পুলিশের কোনো তালিকা করবেন তিনি বা তার কমিশন? পুলিশ কিন্তু নির্বাচন সামনে রেখে বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের তালিকা এগিয়ে নিচ্ছে। এর সাফাইও দিয়েছে। ইসির বৈঠকে অংশ নেয়া অন্যতম পুলিশ কর্মকর্তা ডিআইজি আতিকুল ইসলাম বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের তালিকা করা তাদের রুটিন ওয়ার্ক। ইসির কী প্রশাসনকে নিয়ে এ ধরনের কোনো রুটিন ওয়ার্ক থাকতে নেই? বিশেষ করে পুলিশের দলবাজদের তালিকা করার মতো রুটিন?
ভাব নমুনায় সে রকম লক্ষণ নেই। পুলিশ দলবাজি বন্ধ না করলে বা নির্বাচনে তা অব্যাহত রাখলে কমিশন কিছু করবে কিনা, এমন কোনো আভাসও মেলেনি সিইসির কণ্ঠে। দায়িত্ব নেয়ার পর নির্বাচন কমিশনের সাথে মাঠ প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তাদের বড় পরিসরে এটিই ছিল প্রথম বৈঠক। তাও টানা ৩ ঘণ্টা। বৈঠক শেষে আলাদাভাবে সংবাদ সম্মেলন করেন সিইসি এবং প্রশাসনের মুখপাত্ররা। পুলিশ নিয়ে সিইসির আক্ষেপপূর্ণ মন্তব্যের কোনো জবাবে না গিয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা ইভিএম, ভোটকেন্দ্রসহ আশপাশের প্রসঙ্গে টেনে এনেছেন দৃঢ়তার সঙ্গে। প্রান্তিক এলাকায় ইভিএম ব্যবহারে নানা প্রতিকূলতার পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় ভোটকেন্দ্র না দেয়ার কথা বলেছেন। ভোটকেন্দ্র কমালে পুলিশ প্রশাসনের কাজের সুবিধা হবে বলে মত দিয়েছেন জননিরপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব আক্তার হোসেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী আউয়ালের গড়পড়তা মন্তব্য: কমিশন এবার শক্ত অবস্থানে থাকবে। নির্বাচনে মাঠ প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা পর্যবেক্ষণ করা হবে। এ শক্তের ধরনটা কেমন হবে? সাংবাদিকদের দিক থেকে এ ধরনের প্রশ্ন না থাকায় সিইসিকে এর জবাবও দিতে হয়নি। নির্বাচন সামনে রেখে বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের তালিকা করা পুলিশের রুটিন ওয়ার্কের মধ্যে পড়ে কিনা, এ প্রশ্নের জবাবও দিতে হয়নি তার। তবে, অতিরিক্ত আইজিপি আতিকুল ইসলাম কিন্তু অতিরিক্ত জবাবটা দিয়েছেন। জবাবে বলেছেন, ইসির নির্দেশ অনুযায়ী নির্বাচনী মাঠে পুলিশ দায়িত্ব পালন করে থাকে। তার কথা সত্য হলে, বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের তালিকা করার কাজটাও ইসির নির্দেশে?
এই পুলিশ বা প্রশাসনের কর্মকর্তারা সিইসির ডাকদোহাই না শুনলে তার কী করার আছে? অথবা নতুন করে নিয়োগ দেয়ার মতো ঈমানদার-পেশাদার ডিসি-এসপি তালাশ করে পাবেন কিনা-এ প্রশ্নও থেকে যায়। নির্বাচনের বাইরেও গত ক'দিন ধরে পুলিশের অতিরিক্ত কাজের ধরনে সামনের দিনগুলো নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ বা ক্ষমতাসীন অন্য কোনো লীগ ছাত্র অধিকার নামের একটি খুচরা দলকেও ঢাকা বিশ্বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পেটালো সেদিন। এটি সরকারের বিরুদ্ধে কোনো কর্মসচি ছিল না। বুয়েটে নিহত আবরারের স্মরণসভাটিও বরদাশত করতে পারেনি ছাত্রলীগ। তাদের হামলায় পুলিশ নীরব থেকে সহায়তা দিয়েছে। বেদম মার খেয়ে আহতরা হাসপাতালে গিয়েও রক্ষা পায়নি। সেখানেও হামলা হয়েছে। পুলিশ হাসপাতালে গিয়ে মার খাওয়াদেরই আটক করেছে। মামলায় আসামিও করেছে।
এ সময়ই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাড়া-মহল্লায় বিরোধীমতের নেতা-কর্মীদের বাসা-বাড়ি, পদ-পদবি, স্বজন-পরিজন, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি তথ্য নিয়ে বিশেষ তালিকার কাজ চলছে নতুন উদ্যমে। সেইসঙ্গে বিরোধীদের নামে মামলা দেওয়ার ক্ষেত্রে আসামির তালিকায় যেন আর মৃত ব্যক্তির নাম না থাকে সে বিষয়ে মাঠ পুলিশকে বিশেষ সতর্ক করা হয়েছে। পুলিশকে এভাবে অপব্যবহার যে দিনকে দিন একটা প্রক্রিয়া হয়ে যাচ্ছে তা রোখার আলোকরেখাও দেখা যাচ্ছে না। নিজেও এ প্রক্রিয়ার যাবতীয় সুবিধা নিয়ে বিদায়ের দিন ছোট্ট করে কথাটি বলে গেছেন সদ্য সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ। দেশে এক ধরনের নষ্ট রাজনীতির দুষ্ট চর্চা চলছে মন্তব্য করে রাজসম্মানে অবসরে কেটে পড়েছেন তিনি। দীর্ঘ প্রায় সাড়ে ৩৪ বছরের কর্মজীবন শেষে অবসরে যাওয়ার সময় এই 'নষ্ট রাজনীতি ও দুষ্ট চর্চার কথা মনে পড়েছে তার। বেনজীরের আগেরজন শহীদুল হকও কর্মজীবনের দীর্ঘ ক্ষমতা-জৌলুস শেষে অবসরপ্রাপ্ত পরিচয়ে বলেছেন, 'দেশের রুলিং পার্টি মনে করে পুলিশ তাদের নিজস্ব সম্পত্তি। নিজেদের ইচ্ছা মতো তারা পুলিশকে ব্যবহার করেন'।
ক্ষমতাকালে না হোক অন্তত অবসরে এসেও নির্জলা সত্যটা যে পুলিশ প্রধানরা স্বীকার করছেন সেখানে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের জন্য কিছুটা বোধের জোগান হতে পারে। নির্বাচনের মাঠে ডিসি-এসপিদের দলীয় কর্মী না হয়ে সরকারি কর্মচারী হিসেবে দায়িত্ব পালন কতোটা করাতে পারবেন, তার না জানার-বোঝার কথা নয় একজন জাদরেল আমলা হিসেবেও। এরপরও কিছু বাকি থেকে গেলে সিইসি হিসেবে সেটা নিশ্চয়ই টের পাচ্ছেন হাড়ে-হাড়ে। সদিচ্ছা থাকলেও রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অধিক্ষেত্রে তিনি বা তার কমিশন কতোটা প্রবেশ করতে পারবে সেই আলামতের তেমন কিছু অবশিষ্ট নেই। আলোচিত বৈঠকটিতে ডিসি-এসপিদের প্রতি তার আহ্বানমূলক বক্তব্যটি ছিল: 'আপনাদের আচরণে এমন কিছু যেন প্রতিফলিত না হয় যাতে জনগণ মনে করতে পারে, আপনারা পক্ষপাতদুষ্ট। আপনারা নিরপেক্ষ নন'।
আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবন মিলনায়তনের বৈঠকটিতে নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খানও বক্তব্য রেখেছেন। পরে তার বক্তব্যের লিখিত অনুলিপি সাংবাদিকদের দেওয়া হয়। সেখানে লেখা আছে: 'আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অতি উৎসাহী হয়ে এমন কোনো আচরণ করবেন না, যাতে নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে এবং নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়'। একই পরামর্শ ও আহ্বান কি কাজী, খানসহ অন্যান্য মহোদয়ের প্রতিও প্রযোজ্য নয়?
মোস্তফা কামাল: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments