যত বড় বাজেট, তত বড় দুর্নীতি

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারের দুই ধরনের জবাবদিহি থাকে। প্রথমত, যারা তাদের নির্বাচিত করেছেন, সেসব মানুষের কাছে। দ্বিতীয়ত, নিজেদের কাছে, যাতে তারা জনঅসন্তোষের মুখে টিকে থাকতে পারে।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারের দুই ধরনের জবাবদিহি থাকে। প্রথমত, যারা তাদের নির্বাচিত করেছেন, সেসব মানুষের কাছে। দ্বিতীয়ত, নিজেদের কাছে, যাতে তারা জনঅসন্তোষের মুখে টিকে থাকতে পারে। নির্বাচনী অঙ্গীকারগুলো পূরণ হচ্ছে কি না এবং নিজেদের বিভিন্ন প্রকল্প ও নীতিগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না সে বিষয়ে খোঁজ-খবর ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এটা করা যায়। কোনো রাজনৈতিক দল সরকারের প্রতিনিধিত্ব করলে এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের কল্যাণে সততা ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করলে এটা সম্ভব হয়। অন্যথায় সবক্ষেত্রে জবাবদিহিকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেও এটা নিশ্চিত করা যেতে পারে। যা 'সুশাসন' হিসেবে পরিচিত। এটি হচ্ছে এমন একটি বিষয়, বর্তমান সরকার যেখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়ে মারাত্মকভাবে নিজেকে কলঙ্কিত করেছে। দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানকে ভঙ্গুর করে এবং দায়মুক্তির সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে তরুণদের মনোবল নষ্ট করেছে।

জবাবদিহি অর্জনে ব্যর্থ হওয়ার ছোট ও প্রতীকী একটি উদাহরণ দিয়ে শুরু করা যাক। ২৮ নভেম্বর নতুন করে চালু হওয়া সংবাদপত্র 'দৈনিক বাংলা' একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যার শিরোনাম 'টাকা থাকলে জেলেও মুক্ত জীবন'। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রধান ৪টি কারাগারে কোনো একটিতে প্রবেশের পর কীভাবে একজন টাকা খরচ করে থাকার জন্য ভালো জায়গা, উন্নতমানের খাবার, টেলিভিশন ও মোবাইল ফোনসহ উন্নত জীবনযাপনের যাবতীয় উপকরণ পেতে পারেন। কারাগার থেকে অবৈধ ব্যবসা ও জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মোবাইল ফোন ব্যবহারের কথাও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। আদালতে নিয়মিত হাজিরা দেওয়ার সময় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করার বন্দোবস্তও করা যায়। চাইলে প্রথম সপ্তাহের জন্য ১০ হাজার ও পরবর্তী সপ্তাহগুলোর জন্য এর অর্ধেক পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে হোটেলের মতো করে হাসপাতালে থাকার ব্যবস্থা করা যায়। এখানে ইয়াবা ও অন্যান্য মাদকদ্রব্যও পাওয়া যায়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিষয়গুলো জানেন, কিন্তু এ বিষয়ে তারা কিছু করতে পারছেন না বা করেন না।

দাবি করা হয় কারাগারগুলো পুরোপুরি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। যদি কারাগারের ভেতরেই অপরাধমূলক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে জনগণ কীভাবে ভরসা করবে, কর্তৃপক্ষ বাইরের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে?

জবাবদিহি ব্যর্থ হওয়ার আরেকটি বড় উদাহরণ হলো প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব এবং বড় প্রকল্পে ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা। পাশাপাশি কেন তা সম্ভব হচ্ছে না, সে বিষয়ে কাউকে জবাবদিহির আওতায় না আনা। ২৮ নভেম্বর যুগান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, ত্রুটিপূর্ণ নকশা, সঠিক সম্ভাব্যতা যাচাই না করা, বাড়তি কাজ, সুষ্ঠু নেতৃত্ব ও তদারকির অভাব, তহবিল পেতে বিলম্ব ও অন্যান্য কারণে ১০টি মেগা-প্রকল্পের খরচ বেড়েছে ৫২ হাজার কোটি টাকারও বেশি। একটি প্রকল্পও নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি এবং এগুলো বাস্তবায়নের জন্য ২ থেকে ৯ বছর পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়েছে এবং হচ্ছে। এই ১০টি প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করা মোট তহবিলের পরিমাণ ছিল ৬৩ হাজার ৭৫৭ কোটি টাকা। বর্তমান এগুলোর প্রাক্কলিত ব্যয় ১ লাখ ১৬ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা।

ঔপনিবেশিক আমলে প্রচলিত একটি প্রবাদ ছিল এরকম, 'সরকার কা মাল, দরিয়া ম্যায় ঢাল (যেহেতু এটা সরকারের টাকা, একে সমুদ্রে ফেলে দিলেও কোনো সমস্যা নেই)।' বর্তমানে সমুদ্রে না ফেলে টাকা পকেটে ভরা হয়।

এ বিষয়ে আবারও আমাদের প্রশ্ন, কেন এত বিশাল পরিমাণ অর্থের অপচয় হওয়া সত্ত্বেও এর জন্য কাউকে জবাবদিহির আওতায় আনা হয় না? ৫২ হাজার কোটি টাকা খরচ করলে খুব সম্ভবত গলি-ঘুপচিসহ ঢাকার প্রতিটি সড়ক ও অত্যাবশ্যক পানি সরবরাহ ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করা যেত। ভুলে গেলে চলবে না, উল্লিখিত পরিমাণটি শুধু ১০টি আলোচিত প্রকল্প থেকে আসা। এরকম আরও শত শত প্রকল্প রয়েছে।

মনিটরিংয়ের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) নামে একটি সংস্থা রয়েছে। আমরা মাঝেমধ্যেই তাদের প্রতিবেদনের বিষয়ে শুনে থাকি, কিন্তু খুব বেশি পরিবর্তন ছাড়াই প্রকল্পে অনবরত সময় এবং ব্যয় বৃদ্ধি চলতে থাকে।

সম্ভবত দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিপজ্জনক ত্রুটি রয়েছে আর্থিক খাতে। গত ১৭ নভেম্বর প্রকাশিত আমার কলামে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির বিষয়ে উল্লেখ করেছিলাম– ১৯৯০ সালে ৪ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ ছিল। আজ সেটা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। এ কয় বছরের মধ্যে ঋণখেলাপি ২৯ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আবারও বলতে হয়, যেখানে সব ধরনের যুক্তি ও জাতীয় স্বার্থকে অস্বীকার করে প্রকৃতপক্ষে দোষীদের সহায়তা ছাড়া আর কোনো কিছুই করা হয়নি। মাত্র কয়েকদিন আগে হাইকোর্টের একজন বিচারক ক্ষুব্ধ হয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক আইনজীবীকে ভর্ৎসনা করে বলেছেন, 'বড় ঋণখেলাপিরা কি ধরা-ছোঁয়ারা বাইরে থেকে যাবে? তারা হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করছে। দুদক বড় ঋণখেলাপিদের নয়, ছোটদের ধরতে ব্যস্ত।'

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের (আইবিবিএল) ৭ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের খবরটি গত কয়েক দিন ধরে আর্থিক খাতকে ব্যাপকভাবে নাড়া দিয়েছে এবং এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা ও তদারকি নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে।

ইসলামী ব্যাংক এ বছর রাজশাহী-ভিত্তিক নাবিল গ্রুপের ৯টি সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে ৭ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। গত মাসের প্রথম ১৭ দিনেই ইসলামী ব্যাংক থেকে ২ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ব্যাংক কর্মকর্তারা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, বেশিরভাগ কোম্পানি তাদের ঋণ আবেদনে ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করেছে। কীভাবে এটা সম্ভব হলো? ঠিকানা হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্যে একটি যা ব্যাংকগুলো কোনো ঋণ আবেদন বিবেচনার আগে যাচাই করে দেখে– এবং এ ক্ষেত্রে ঋণের পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি টাকা। এ ধরনের আরও অনেক ত্রুটি রয়েছে, যা এ ধরনের বড় মাপের ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে কল্পনাও করা যাওয়ার কথা না। এক্ষেত্রে হয় ইসলামী ব্যাংকের কর্মীরা ব্যাংকিং ভুলে গেছেন, অথবা ব্যাংকটির উচ্চপদস্থরা সেটি সঠিকভাবে চালানোর চেয়ে অনিয়মে বেশি আগ্রহী হয়ে পড়েছেন।

উল্লেখ্য, ইসলামী ব্যাংক এক সময় দেশের সেরা ব্যাংকগুলোর তালিকায় ছিল। কয়েক বছর আগে হঠাৎ করে ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ নতুন সদস্যসহ পরিচালনা পর্ষদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), চেয়ারম্যান ও বেশ কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়। কীভাবে এই পরিবর্তনটি ঘটেছিল সে বিষয়ে রহস্য থাকলেও এর প্রভাব এখন পরিষ্কার। আশ্চর্য বিষয় হলো, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন অন্যান্য ব্যাংকের এমডিদের ব্যক্তিগত ভ্রমণের বিষয়টি পর্যন্ত নজরদারিতে রাখলেও ব্যাংকের এই আকস্মিক নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে দেশের জনগণ এবং আমানতকারীদের কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি।

এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা কী সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের (এসআইবিএল) এলসি-সম্পর্কিত ঘটনাটিও বর্তমানে আলোচনায় রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে প্রমাণিত হলে সেটাও সমান ভয়ঙ্কর। শার্প নিটিং অ্যান্ড ডাইং লিমিটেড একটি পণ্য রপ্তানির পরিবর্তে একটি বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা ব্যবহার করছে। এই প্রক্রিয়ায় কোম্পানিটি ৭ বছরে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে জানা গেছে।

জবাবদিহির অভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটার পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

ঠিক এই মুহূর্তে ব্যাঙ্কগুলো এতটাই অব্যবস্থাপনা এবং খেলাপি ঋণে ভারাক্রান্ত যে, সরকার আইন সংশোধন করে ব্যাংকের বোর্ডে একই পরিবারের বহু সংখ্যক সদস্যকে আগের চেয়ে দীর্ঘ মেয়াদে রাখার অনুমতি দিয়েছে।

এর ফলে ব্যাংকগুলোতে পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আর্থিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে পেশাদার পরিচালকদের ক্ষমতাকে দুর্বল করেছে, যেটা জবাবদিহির কফিনে আরেকটি পেরেক।

বড় বাজেট, বড় প্রকল্প, বড় তহবিল, বড় ঋণখেলাপি, বড় দুর্নীতি, প্রকল্পের অর্থের বড় চুরি, বড় ধরনের মানি লন্ডারিং, মালয়েশিয়া ও কানাডায় বড় বড় বাড়ি এবং কম জবাবদিহি।

সত্যিই, একটি রোল মডেল!

পাদটীকা

চলতি সপ্তাহে, অর্থমন্ত্রী গণমাধ্যমের কাছে জানতে চান, 'ব্যাংকের অবস্থা কোথায় খারাপ, লিখিত দেন, আমরা খতিয়ে দেখব।' বোঝাই যায়, তিনি সংবাদপত্র পড়েন না। তার তো একটি বড় কর্মীদল থাকার কথা, যারা তাকে দেশের আর্থিক খাতের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাবেন, তাই নয় কি? মন্ত্রী জানেন না, তার মানে কি এটাই, তার মন্ত্রণালয়ও জানে না? তারা যদি না জানে, তাহলে তারা কী করছে এবং কেন তারা জনগণের পকেট থেকে আসা বেতন ও ভাতা পাওয়ার যোগ্য? যদি তারা জেনেই থাকেন, তাহলে কেন তাদের মন্ত্রী সেটা জানেন না? সন্দেহজনক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে দেওয়া বড় আকারের ঋণের বিষয়ে সম্প্রতি গণমাধ্যমে বেশ কিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের দেওয়া কিছু ঋণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু করেছে এবং ব্যাংকটিকে নতুন ঋণ বিতরণ না করার নির্দেশ দিয়েছে। সম্প্রতি অনুমিত হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যার শিরোনাম 'সোনালী ব্যাংকের ঋণ পরিস্থিতি ভীতিকর'।

এত কিছুর পরেও, অর্থমন্ত্রী কিছুই জানেন না। তার এই অজ্ঞতা খুবই দায়িত্বজ্ঞানহীন, বিপজ্জনক এবং একেবারেই মেনে নেওয়া যায় না। বিশেষত দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Will there be any respite from inflation?

To many, especially salaried and fixed-income individuals, this means they will have no option but to find ways to cut expenditures to bear increased electricity bills.

6h ago