বিদেশিদের নাক গলানোর সুযোগ দেয় কে?

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ‘হস্তক্ষেপ’ বা ‘নাক গলানো’ ইস্যুতে বিশ্বের ক্ষমতাধর এবং প্রতিদ্বন্দ্বী দুই রাষ্ট্র রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টাপাল্টি বিবৃতি কিছু গুরুতর প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে 'হস্তক্ষেপ' বা 'নাক গলানো' ইস্যুতে বিশ্বের ক্ষমতাধর এবং প্রতিদ্বন্দ্বী দুই রাষ্ট্র রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টাপাল্টি বিবৃতি কিছু গুরুতর প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

মানবাধিকারসহ নানা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের যে টানাপোড়েন চলছে বলে মনে করা হচ্ছে, সেটি আগামী জাতীয় নির্বাচনে কী প্রভাব ফেলবে?

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক কি সত্যিই খারাপ?

কী কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হলো?

রাশিয়া কেন এমন একটি বিষয়ে বিবৃতি দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল এবং তারপরেই যুক্তরাষ্ট্রকে কেন পাল্টা বিবৃতি বা প্রতিক্রিয়া জানাতে হলো?

এই বিবৃতির মধ্য দিয়ে রাশিয়া কি এটা বোঝাতে চাইছে যে বাংলাদেশ এখন চীন-রাশিয়ার বলয়ে?

বাংলাদেশ যদি চীন-রাশিয়ার বলয়ে ঢুকে যায় তাহলে এই অঞ্চলের অন্যতম প্রভাবশালী দেশ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের রসায়নে কি কোনো পরিবর্তন আসবে, যে ভারতের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক উষ্ণ এবং এই অঞ্চলে যেখানে ভারত ও চীনের মধ্যে একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ সম্পর্ক বিরাজমান?

বাংলাদেশ ইস্যুতে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের এই 'মুখোমুখি' অবস্থান আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কি কোনো প্রভাব ফেলবে?

এই সব প্রশ্নের বাইরে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সামনে যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে বা যে প্রশ্নটির সুরাহা করা দরকার তা হলো, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের 'হস্তক্ষেপ' বা 'নাক গলানোর' সুযোগ কে দিলো?

আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, ঘটনার সূত্রপাত গত ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী দিবসে, যেদিন ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ৯ বছর আগে নিখোঁজ বিএনপির এক নেতার বাসায় গিয়েছিলেন তার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে। ওই সময় সেখানে হাজির হয় 'মায়ের কান্না' নামে একটি সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। জিয়াউর রহমানের সেনা শাসনের সময় বিমানবাহিনীতে অভ্যুত্থান চেষ্টার অভিযোগে হত্যার শিকার পরিবারগুলোর সংগঠন 'মায়ের কান্না'। তারা পিটার হাসকে একটি বিবৃতি দিতে চেয়েছিল। কিন্তু মিস্টার হাস সেটি গ্রহণ করেননি। বরং দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে দেখা করে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কথা জানান।

এর কয়েকদিন পরে ঢাকায় রুশ দূতাবাস তাদের ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে এক বিবৃতিতে জানায়, 'রাশিয়া অন্য কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশের মতো যে দেশগুলো বিদেশি শক্তির নেতৃত্ব অনুসরণ না করে জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ নীতি গ্রহণ করে, সে দেশগুলোর প্রতি রাশিয়া পুরোপুরি সমর্থন জানায়।' রুশ দূতাবাসের এ বিবৃতির লক্ষ্যবস্তু যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সেটি বুঝতে গবেষণার প্রয়োজন নেই। ফলে দেখা গেলো এর পরদিনই এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানায় মার্কিন দূতাবাস। এক টুইট বার্তায় মার্কিন দূতাবাস ইউক্রেন রুশ আক্রমণের প্রসঙ্গ টেনে আনে। রাশিয়ার ওই বিবৃতি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদন শেয়ার করে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের টুইট বার্তায় লেখা হয়, 'রাশিয়া অন্য কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার যে নীতির কথা বলছে, ইউক্রেনের ক্ষেত্রে কি এই নীতি মানা হয়েছে?'

তবে ঘটনার সূত্রপাত এখানেই নয়। বরং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়েছে আরও আগেই—যেটি বড় আকারে দৃশ্যমান হয় পুলিশের এলিট ফোর্স র‌্যাব এবং এই বাহিনীর ৭ জন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের মধ্য দিয়ে। যদিও বাংলাদেশ সরকার এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তরফে অভিযোগ করা হচ্ছে, এই নিষেধাজ্ঞার পেছনে বিএনপির লবি দায়ী। অবশ্য বিএনপির মতো একটি দল লবি করে বাংলাদেশের কোনো বাহিনী এবং বেশ কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে—এটি কতটা বিশ্বাসযোগ্য ও বাস্তবসম্মত, সে প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। বরং আমাদের যে প্রশ্নটি করা দরকার তা হলো, যেসব অভিযোগের ভিত্তিতে ওই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, সেই অভিযোগগুলো সঠিক কি না? বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেসব অভিযোগ বছরের পর বছর ধরে জনমনে আছে, সেই অভিযোগগুলোর সবই কি ঢালাও বা মিথ্যা?

সবশেষ হাতকড়া আর ডান্ডাবেড়ি নিয়ে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার একজন বিএনপি নেতা তার মায়ের জানাজা পড়ার যে ছবিটা গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে গেছে, সেই ছবিটা কী বার্তা দিলো? এই ছবিটা নিশ্চয়ই বাংলাদেশের বাইরেও লাখ লাখ মানুষ দেখেছেন। আবার বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে উৎখাত করতে বা সরকারকে বিপদে ফেলতে এক বা একাধিক শক্তি যে ক্রিয়াশীল, সেই বাস্তবতাও অস্বীকার করা যাবে না। ফলে এখন এই একটি ছবির কারণে এখন কোনো দেশের সরকার বা আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত কোনো মানবাধিকার সংগঠন যদি মনে করে বা এই বলে বিবৃতি দেয় যে, বাংলাদেশে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও ভিন্নমতের অনুসারীদের ক্ষেত্রে মানবাধিকারের শর্ত ও মানদণ্ডগুলো মানা হচ্ছে না; এই একটি ছবির কারণে যদি কোনো সংগঠন বলে যে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ভয়াবহ—তার জবাব কী হবে?

এই ছবিটা প্রকাশিত হওয়ার পরে সরকারের পক্ষ থেকে কি দ্রুত এর তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে? ডান্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় জানাজার নামাজ পড়ার ঘটনাটি কতটা আইনসিদ্ধ এবং কতটা মানবিক— সে বিষয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকরা কিছু কি বলেছেন? উপরন্তু গণমাধ্যমের খবর বলছে, যে মামলায় ওই বিএনপি নেতাকে কারাগারে আটক রাখা হয়েছে, সেটি গায়েবি মামলা। সুতরাং একটি গায়েবি মামলায় একজন নিরপরাধ লোককে জেলে আটকে রাখা এবং মায়ের মৃত্যুর পরে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে ডান্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় তাকে জানাজার নামাজ পড়তে দেওয়ার এই ঘটনাটি কোন বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করছে? এটিকে কি একটি 'বিচ্ছিন্ন ঘটনা' বলে চালানো হবে? কোনো বিদেশি দূত কিংবা কোনো মানবাধিকার সংগঠন যদি এই ঘটনার সমালোচনা করে, সেটি কি খুব অযৌক্তিক হবে এবং এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বলে পাল্টা সমালোচনা করাটা যৌক্তিক নাকি আত্মসমালোচনা করা প্রয়োজন?

বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে ক্রসফায়ার, নিরাপত্তা হেফাজতে নিয়ে নির্যাতন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর দলীয় কর্মীর মতো আচরণসহ নানারকম অভিযোগ আছে এবং এই অভিযোগগুলো শুধু বিদেশে নয়, দেশের মানুষের মনেই আছে এবং এটি শুধু সাম্প্রতিক বছরগুলোর প্রবণতা নয় বরং এটি বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। সুতরাং এইসব ঘটনার কারণে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যদি কেউ প্রশ্ন তোলে বা সমালোচনা করে, তাহলে সেটিকে 'অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ' বলার আগে নিজেকে প্রশ্ন করা দরকার, কেন অন্য কেউ এ ধরনের সমালোচনার সুযোগ পেলো? বাংলাদেশের রাজনীতি, নির্বাচন, বাকস্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন ইস্যুতে কেউ যদি সমালোচনা করে, সেটি কি অন্যায় হবে? তারা কেন এইসব ইস্যুতে সমালোচনার সুযোগ পায়?

খুব সাধারণ যে কথাটি বলে দায় এড়ানোর চেষ্টা করা হয় তা হলো, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিনই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে। তার মানে অন্য দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয় বলে বাংলাদেশেও হতে হবে? যুক্তরাষ্ট্রে কি দেড় শতাধিক আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ আছে বা এসব দেশের নির্বাচন কি প্রশ্নবিদ্ধ হয়? যুক্তরাষ্ট্র বা প্রতিবেশী ভারতেও কি নির্বাচন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চরম অনাস্থা ও অবিশ্বাস আছে, যে অবিশ্বাসের কারণে নির্বাচনের সময় একটি অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা নিতে হয়? যুক্তরাষ্ট্র বা ভারতের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সরকারি কর্মকর্তারা কি দলীয় কর্মীর মতো আচরণ করেন? তাদের দিয়ে কি সরকার বা ক্ষমতাসীন দল চাইলেই যেকোনো কিছু করাতে পারে?

সুতরাং বাংলাদেশের রাজনীতি, নির্বাচন, মানবাধিকারসহ অন্য যেকোনো বিষয়ে কোন দেশ বা কোন সংগঠন কী বললো; তাদের কথা বলার অধিকার আছে কি নেই; কূটনীতিকরা কতটুকু কথা বলতে পারবেন বা পারবেন না; সাংবাদিকরা তাদের কী প্রশ্ন করবেন বা করবেন না—সেটি অন্য তর্ক। আসল কথা হলো আমি নিজে কতটা পরিষ্কার। আমি যদি ঠিক কাজটা করি; সঠিক পথে থাকি, তাহলে আমাকে নিয়ে খারাপ মন্তব্য করার সুযোগ অন্যরা পাবে না।

বিদেশিরা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর সুযোগ পায় কেন? আমি যদি আমার ঘর পরিষ্কার রাখি, তাহলে বাইরের লোক এসে তো এ কথা বলার সুযোগ পাবে না যে আমার ঘর নোংরা। হতে পারে যিনি বলছেন তার নিজের ঘরও নোংরা। কিন্তু আরেকজনের ঘর নোংরা বলে আমিও আমার ঘর পরিষ্কার রাখব না, সেটি কোনো কাজের কথা নয়।  

পরিশেষে, বাংলাদেশের রাজনীতি, নির্বাচন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা ও প্রেস ফিডমসহ যেকোনো ইস্যুতে বিদেশিদের নাক গলানো অবশ্যই অনুচিত এবং বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারদের কাজের পরিধি সীমিত ও সীমাবদ্ধ, এ কথাও ঠিক। কিন্তু বাংলাদেশের সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণ ও কর্মকাণ্ডও এমন হতে হবে যাতে কেউ কোনো ধরনের নাক গলানোর সুযোগ না পায়।

কে কী বললো সেটি হয়তো খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু কোনো একটি ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মতো প্রভাবশালী দুটি দেশ মুখোমুখি অবস্থানে চলে গেলে সেটি কোনো ভালো ইঙ্গিত নয়। অতএব বাংলাদেশকে সব বিষয়ে সতর্ক থাকা এবং চোখ কান খোলা রাখারও প্রয়োজন আছে। বাংলাদেশ কীভাবে চলবে, সেই সিদ্ধান্ত তার, এটি যেমন ঠিক। তেমনি মানবাধিকারের কিছু আন্তর্জাতিক রীতিনীতিও আছে এবং কোনো দেশই এখন আর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। সুতরাং বাংলাদেশের সরকার ও রাজনীতিবিদদেরই ঠিক করতে হবে যে তারা এমন কোনো কাজ করবেন কি না, যার দোহাই দিয়ে অন্য কোনো দেশ এখানে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ বা নাক গলানোর সুযোগ পায়।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন। 

 

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

 

Comments