ফারদিনের মৃত্যুজট: ‘যাহা খুলিয়াও খুলিলো না’

ফারদিন
ফারদিন নূর পরশ। ছবি: সংগৃহীত

বুয়েট ছাত্র ফারদিনের মৃত্যুরহস্য ক্রমশ যেদিকে এগুচ্ছে, তা সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ডের রহস্যের মতো হতে পারে বলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন। বছরের পর বছর যাবে কিন্তু, কূলকিনারা হবে না। সাগর-রুনীর শিশু সন্তান মেঘের মতো হয়তো ফারদিনের বাবাকেও অনেক বছর অপেক্ষা করতে হবে ছেলের মৃত্যুজটের সমাধান নিয়ে যুক্তিগ্রাহ্য উপসংহারে পৌঁছানোর জন্য।

ফারদিনের মরদেহ পাওয়া গেল হারিয়ে যাওয়ার ২ দিন পর। মামলা দায়েরের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে প্রধান আসামি হিসেবে এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে আটক করা হলো। তাকে কারাগারেও পাঠানো হলো। তার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ তিনি ফারদিনের বন্ধু এবং তাকে বিকেল পর্যন্ত ফারদিনের সঙ্গে দেখা গেছে। অথচ পুলিশের তথ্য অনুযায়ী ফারদিন মারা গেছেন গভীর রাতে।

ফারদিন নূর পরশের মৃত্যুর ঘটনায় মামলার তদন্তের ফলাফল নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এক মাস তদন্তের পর ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) ও র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এক সঙ্গেই জানিয়েছে, ফারদিনকে খুন করা হয়নি, বরং তিনি 'আত্মহত্যা' করেছেন।

এখানেও প্রশ্ন উঠেছে হাতের কাছে আত্মহত্যার এত উপায় থাকতে তিনি এত দূরে গিয়ে, এত পথ ঘুরে কেনই বা আত্মহত্যা করবেন?

প্রাথমিকভাবে ২ সংস্থাই জানিয়েছিল মাদক চোরাকারবারিরা ফারদিনকে খুন করে থাকতে পারে। ফারদিনের মৃত্যুর পর র‌্যাব দাবি করে তাকে হত্যা করা হয়েছে। ডিবি জানায় যে, তিনি 'আত্মহত্যা' করেছেন। র‌্যাব দাবি করে ফারদিন চনপাড়া বা এর আশেপাশে হত্যার শিকার হন। অন্যদিকে, ডিবির দাবি তিনি চনপাড়ায় ওই রাতে যাননি।

মাদক চোরাকারবারিদের পাল্লায় ফারদিন কীভাবে পড়েছিল, কীভাবে মাদকপল্লীতে গিয়েছিল—সেগুলোর গুগল ম্যাপ ও সিসি ক্যামেরা ফুটেজ দেখে দেখে পাঠক-দর্শকদের রীতিমতো ওই রুট মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। তখনকার রিপোর্ট পড়ে মনে হয়েছিল ফারদিন 'মাদকসেবী' বা 'কারবারি'। তাদেরই চালে তাকে প্রাণ দিতে হয়েছে।

ফারদিনের মৃত্যুর দায়ে অভিযুক্ত চনপাড়া এলাকার সিটি শাহীনকে 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত দেখানো হয়েছিল। সিটি শাহীনের স্ত্রী জানতে চাইছেন, ফারদিন 'আত্মহত্যা' করলে তার স্বামীকে গুলি করে মারা হলো কেন? তিনি বলেছেন, 'আমার স্বামীকে হত্যার আগে ফারদিন হত্যায় তার জড়িত থাকার কথা বলা হয়েছিল। অথচ ডিবি ও র‌্যাব বলছে, ফারদিন আত্মহত্যা করেছে। তাহলে আমার স্বামীকে গুলি করে মারা হলো কেন?'

'আমার স্বামীর বিরুদ্ধে অন্য অভিযোগ থাকলে আইনের মাধ্যমে বিচার করত। কিন্তু, তাকে র‌্যাব এভাবে হত্যা করতে পারে না। এই হত্যার বিচার চাই,' গত ২১ ডিসেম্বর সাংবাদিকদের এ কথা বলেছেন নারায়ণগঞ্জের চনপাড়া এলাকার রাশেদুল ইসলাম শাহীন ওরফে সিটি শাহীনের স্ত্রী রোকেয়া আক্তার ইতি।

গত ১০ নভেম্বর র‌্যাবের সঙ্গে 'বন্দুকযুদ্ধে' শাহীন নিহত হন।

শিক্ষার্থী বুশরাকে শুধু সন্দেহের বশে আটক করা হয়। একজন শিক্ষার্থীকে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়ার আগেই আটক করা কতটা যুক্তিযুক্ত? সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পেলে বুশরাকে আটক করা যেতেই পারতো। অবশ্য তদন্তকারী সংস্থাগুলো এজন্য ফারদিনের বাবার কথাই বারবার বলছেন।

ফারদিনের বাবার যুক্তি, যেহেতু বুশরাকে শেষবার তার ছেলের সঙ্গে দেখা গেছে, তাই তাকে আসামি করা উচিত।

তদন্তকারী সংস্থা ডিবি পুলিশ বলেছে যে, তারা ফারদিনের মৃত্যুতে বুশরার জড়িত থাকার প্রমাণ পায়নি। তাহলে প্রশ্ন আসে, কেন বুশরা এখনো হত্যার অভিযোগে কারাগারে?

গোয়েন্দা শাখা বলছে, এজন্য তারা দায়ী নয়। ওনারা বলছেন, সবার উচিত মৃতের বাবা কাজী নূর উদ্দিনকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা। কারণ মামলাটি তিনিই করেছেন।

ধরে নিলাম ফারদিনের বাবা বুশরাকে 'অপরাধী' মনে করে মামলা করেছেন। কিন্তু, এখনতো বলা হচ্ছে ফারদিনকে হত্যা করা হয়নি, তিনি 'আত্মহত্যা' করেছেন। তাহলে কি সেই মামলা ধোপে টেকে?

আমরা জানি, যেকোনো হত্যা মামলার তদন্তের নিয়মিত ব্যবস্থা অনুসারেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু, যখন সেই মামলাই দুর্বল হয়ে পড়ে, তখনো কেন অভিযুক্ত ব্যক্তি কারাগারে থাকবে?

খবরে দেখলাম, বুশরাকে আগামী ২০২৩ সালের ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত কারাগারে থাকতে হবে। ওইদিন মামলার শুনানির পরবর্তী তারিখ ধার্য করা হয়েছে। দেখা যাক, বুশরা যে শাস্তি ভোগ করছেন এর হাত থেকে রক্ষা পান কিনা?

বুশরাও তার পরিবারের কাছে জানতে চেয়েছেন, 'আমি যদি দোষী না হই, তাহলে কেন আমার জামিন নামঞ্জুর হলো?'

আমরাও জানতে চাচ্ছি—ফারদিনের মৃত্যুর ঘটনায় যদি বুশরার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া না যায়, তাহলে তাকে এভাবে আটকে রাখা অমানবিক ও বিচার বহির্ভূত নয় কি?

একজন শিক্ষার্থী বিনা কারণে এক মাসেরও বেশি সময় কারাগারে বন্দি আছেন, এটা তার জন্য ভয়াবহ শাস্তি। তার মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দায় কে নেবেন? আমাদের সমাজে মেয়েদের দোষের শেষ নাই। চরিত্র নষ্ট হতেও এক মিনিট লাগে না। সমাজে দুর্নাম ছড়ানোর মতো মানুষের অভাব নাই।

সুপ্রিম কোর্টের মানবাধিকার আইনজীবী ইশরাত হাসান গণমাধ্যমকে বলেছেন, অনুমানের ভিত্তিতে কাউকে অভিযুক্ত করাটা ভয়ঙ্কর। গত এক মাসে যে ধরনের মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে মেয়েটাকে যেতে হয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠা তার জন্য খুব কঠিন হবে। এই ধরনের মামলা সামলানোর ক্ষেত্রে পুলিশের আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল বলেও মনে করেন তিনি।

বুশরাকে পুলিশ আটক করেছে, হত্যা মামলায় তাকে প্রধান আসামি করা হয়েছে এবং প্রায় ৪০/৪৫ দিন ধরে তিনি কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন—কাজেই তিনি যখন মুক্ত হয়ে আসবেন, তখনো অধিকাংশ মানুষ সন্দেহ করবে কিছু না কিছুতো ছিলই, নইলে বুশরার নামে মামলা হবে কেন? 'আলোচনার বিষয়' হয়ে উঠতে পারে বুশরার জীবন।

যদিও ইতোমধ্যেই জনগণ সত্যটা জানতে পেরেছে, জেনেছে যে, বুশরা নির্দোষ। কিন্তু, এরপরও কি মামলার 'আঠা' ছাড়বে? বুশরা কি মুক্তি পাবেন সামাজিক অপপ্রচারের হাত থেকে?

নূরউদ্দিন তার ছেলের 'আত্মহত্যা'র বিষয়ে পুলিশের বক্তব্য মানছেন না। তিনি এখনো বিশ্বাস করেন, এটা 'আত্মহত্যা' নয় বরং পরিকল্পিত। শুধু ফারদিনের বাবা নন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও পত্রিকায় মন্তব্য দেখলেই বোঝা যায়, ফারদিনের মৃত্যু ও এর তদন্ত নিয়ে অনেক সংশয় তৈরি হয়েছে, প্রশ্ন উঠেছে।

তদন্ত চূড়ান্ত না করেই তিনি 'আত্মহত্যা' করেছেন বলে সংস্থা ২টির এমন সিদ্ধান্তে জল্পনা-কল্পনা সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে মৃত্যুর কারণ নিয়ে ডিবি ও র‌্যাবের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য মৃত্যু সংক্রান্ত সন্দেহকে আরও জোরালো করেছে।

ডিবির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তদন্ত এখনো শেষ হয়নি, তদন্ত চলবে। তদন্তের পরবর্তী পর্যায়ে যদি অন্য কিছু পাওয়া যায়, তখন তা অন্যভাবে দেখা হবে।

এর মানে এই কাহিনি এখানেই শেষ নাও হতে পারে, ঘটনার অন্য মোড় নেওয়ার আশঙ্কা থেকেই গেল। এ যেন একটি ছোট গল্প যা 'শেষ হইয়াও হইলো না শেষ।'

শাহানা হুদা রঞ্জনা: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

The elephant in the room no one is talking about

Reform of political parties is of urgent need

11h ago