রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের অবস্থা কী?

আকর্ষণীয় দলীয় স্লোগান তৈরিতে আওয়ামী লীগের কৃতিত্ব স্বীকার করতেই হবে— যেখানে জনগণের, বিশেষ করে তরুণ জনগোষ্ঠীর মনোভাবের প্রতিফলন রয়েছে। এর মাধ্যমে দলটিকে একটি আধুনিক ধারার ভাবমূর্তি দেওয়ার পাশাপাশি অদূর ভবিষ্যতে তাদের লক্ষ্য কী হবে, সে বিষয়টিও খুব সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বিগত দুটি নির্বাচনে দলটির স্লোগান ছিল ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’। কতটা কার্যকরভাবে সেটা বাস্তবায়ন করতে পেরেছে, প্রশ্ন সেটা নয়। স্লোগানটির কারণে দলটিকে আধুনিকমনা এবং সমসাময়িক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে বলে মনে হয়। এ বিষয়ে তাদের যে রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল, সেটা তারা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

আকর্ষণীয় দলীয় স্লোগান তৈরিতে আওয়ামী লীগের কৃতিত্ব স্বীকার করতেই হবে— যেখানে জনগণের, বিশেষ করে তরুণ জনগোষ্ঠীর মনোভাবের প্রতিফলন রয়েছে। এর মাধ্যমে দলটিকে একটি আধুনিক ধারার ভাবমূর্তি দেওয়ার পাশাপাশি অদূর ভবিষ্যতে তাদের লক্ষ্য কী হবে, সে বিষয়টিও খুব সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বিগত দুটি নির্বাচনে দলটির স্লোগান ছিল 'ডিজিটাল বাংলাদেশ'। কতটা কার্যকরভাবে সেটা বাস্তবায়ন করতে পেরেছে, প্রশ্ন সেটা নয়। স্লোগানটির কারণে দলটিকে আধুনিকমনা এবং সমসাময়িক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে বলে মনে হয়। এ বিষয়ে তাদের যে রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল, সেটা তারা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

আসন্ন ২০২৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনের স্লোগান হলো 'স্মার্ট বাংলাদেশ'। যেটি অর্জনের সময়সীমা ২০৪১ সাল। আবারও ২ শব্দের খুব সুনির্বাচিত একটি স্লোগান, যার মাধ্যমে আগামী দিনের কর্মকাণ্ডকে সংক্ষেপে প্রকাশ করা হয়েছে। এখানেও খুবই বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বর্ণিত এবং আরোপিত বক্তব্য হলো, 'আমাদের সে সময় পর্যন্ত ক্ষমতায় রাখুন, যাতে আমরা প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে পারি।'

তাহলে কি আওয়ামী লীগ একটি 'স্মার্ট দল', যারা আমাদেরকে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে দিতে পারবে?

২০২২ সালের ২৪ ডিসেম্বর ৭৩ বছর বয়সী দলটি তাদের ২২তম ত্রি-বার্ষিক কাউন্সিলে আরও একবার; দশম বারের মতো তাদের ৭৫ বছর বয়সী শীর্ষ নেতাকে পুনর্নিবাচিত করেছে। ২০২৫ সালে যখন শেখ হাসিনার চলতি মেয়াদ শেষ হবে, তখন তিনি টানা ৪৫ বছর ধরে দেশের সবচেয়ে বড় ও ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলটির নেতৃত্ব দেওয়ার গৌরবের অধিকারী হবেন। ১৯৪৮ সালে যখন আওয়ামী লীগ গঠন করা হয়, তখন শেখ হাসিনার বয়স ছিল ২ বছর। প্রশ্নাতীতভাবে তিনিই আওয়ামী লীগের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী, কর্তৃত্বপরায়ণ ও সফল নেতা। আমার সবশেষ লেখায় যেমনটা বলেছিলাম, এখন শেখ হাসিনাই আওয়ামী লীগ।

আজকের প্রেক্ষাপটে একটি প্রশ্ন সামনে আসে যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এমন একটি রাজনৈতিক দল কতটুকু সফল? যেখানে কেউ কোনো পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে না, তা সেটা যত ছোট পদই হোক না কেন। এমনকি এ বিষয়ে তার ইচ্ছা প্রকাশ, সমর্থন চেয়ে প্রচার কিংবা কর্মীদের একত্রিত করতে পারে না। দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে পুনর্নির্বাচিত করার আনুষ্ঠানিকতা শেষে কাউন্সিল সর্বসম্মতিক্রমে দলের নেতাকে কমিটির বাকি সদস্য নির্বাচনের দায়ভার দেয়। দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা এই সংস্কৃতির পুনরাবৃত্তি গত ডিসেম্বরে আরও একবার দেখা গেল।

শেখ হাসিনা গত ৪২ বছর ধরে দল এবং ১৪ বছর ধরে সরকার পরিচালনা করছেন (যদি আমরা ১৯৯৬-২০০১ সালের প্রথম মেয়াদসহ ধরি তাহলে ২০ বছর)।

আগামী নির্বাচনের আগে যে প্রশ্নটি অনিবার্যভাবে সামনে আসবে তা হলো, আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতি রক্ষায় কতটা সফল।

২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে 'আমাদের বিশেষ অঙ্গীকার' নামে একটি পরিচ্ছেদ ছিল, যেখানে ১৯টি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে নারীর ক্ষমতায়ন, খাদ্যনিরাপত্তা, সার্বিক উন্নয়নে ডিজিটাল প্রযুক্তির অধিকতর ব্যবহার, মেগা প্রকল্পগুলোর দ্রুত ও মানসম্পন্ন বাস্তবায়ন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিরাপত্তা, কৃষিখাতে যান্ত্রিকীকরণ, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ, দারিদ্র্য নির্মূল এবং প্রবীণ, প্রতিবন্ধী ও অটিজমে আক্রান্তদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে।

বেশ কিছু মেগা-প্রজেক্ট সময়মতো বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু সেগুলোর খরচ বৃদ্ধি ও সার্বিকভাবে ঋণের মাধ্যমে পাওয়া তহবিল পরিশোধের বোঝা ভবিষ্যতে আমাদের অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে এবং ভোগান্তির উৎস হতে পারে। জ্বালানি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আমরা অনেক এগিয়েছি। কিন্তু প্রয়োজনের চেয়েও বেশি সময় ধরে ক্যাপাসিটি চার্জ এবং এলএনজিতে রূপান্তরের ব্যয়ের বিষয়টি বেশ গুরুত্ব সহকারে নিরীক্ষা করতে হবে। তার কারণ, ভবিষ্যতে এগুলো চালু রাখতে এবং এর জন্য নেওয়া ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের চাপ তৈরি হতে পারে।

দল হিসেবে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় ও লজ্জাজনক ব্যর্থতা হচ্ছে দুর্নীতি দমন করতে না পারা। দলটির ২০১৮ সালের ইশতেহারে ১ নম্বর 'বিশেষ অঙ্গীকার' হওয়া সত্ত্বেও বাস্তবে দুর্নীতি দমনে কোনো কার্যকরী উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। বরং এটি বর্তমানে 'নিউ নর্মাল' বা জীবনযাত্রায় পরিণত হয়েছে। দৈনন্দিন কার্যক্রমের সঙ্গে দুর্নীতিকে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে এবং ক্ষমতাসীন দল এই প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। প্রভাব-প্রতিপত্তি কিংবা অর্থ ছাড়া কোনো কাজ এগোয় না, কোনো কিছুরই বাস্তবায়ন হয় না।

ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগের স্থানীয় অঙ্গ সংগঠনগুলোর সুনাম ও তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীদের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি বড়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জনপ্রতিনিধিসহ যারা দলের উচ্চ পদগুলোতে আছেন, তাদের কথা নাইবা বললাম। স্থানীয় সরকারের কার্যক্রম, যা মূলত একটি প্রশাসনিক কাজ, সেটি আওয়ামী লীগ দখল করে নিয়েছে। নির্বাচনী প্রক্রিয়া এতটাই অর্থ-নির্ভর হয়ে পড়েছে যে সেটা প্রায় স্বাভাবিকভাবেই উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতির জন্ম দিচ্ছে। 'নির্বাচিত' হওয়ার খরচ আকাশচুম্বী হয়ে পড়াই মূলত এর নেপথ্যের কারণ।

দুর্নীতি কেবল আমাদের প্রশাসনিক প্রক্রিয়াকেই গ্রাস করেনি, বরং এটি ক্ষমতাসীন দলকে একদম ভেতর থেকে— সবচেয়ে মারাত্মকভাবে— কুরে কুরে খাচ্ছে।

২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে 'ঘুষ, কালো টাকা, চাঁদাবাজি, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি ও ঋণ খেলাপি' (নিঃসন্দেহে শেষ প্রতিশ্রুতি একটি উপহাসে পরিণত হয়েছে) নির্মূল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। ৯ বছর পর, আমরা এসব অঙ্গীকার বাস্তবায়নের কোন পর্যায়ে রয়েছি? এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কোনো প্রয়োজন আছে বলে আর মনে হয় না।

আমরা যদি আরও পেছন ফিরে তাকাই, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ যখন আবারও ক্ষমতায় আসে, তখন দলটি জনগণের কাছে কী ওয়াদা করেছিল? ইশতেহারের '২০২১ সালে কেমন বাংলাদেশ দেখতে চাই' শিরোনামের অংশে দলটির প্রতিশ্রুতিগুলো ছিল: (১) নির্ভরযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থা, সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা এবং সংসদকে কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় সকল উদ্যোগ নেওয়া; (২) রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনকে দলীয়করণমুক্ত রাখা এবং প্রশাসনে নিয়োগ ও পদোন্নতির ভিত্তি হিসেবে শুধু মেধা, দক্ষতা, জ্যেষ্ঠতা ও সততাকে বিবেচনা করা; (৩) রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি, স্বচ্ছ অর্থায়ন, শিষ্টাচার ও সহনশীল আচরণ প্রতিষ্ঠা করা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চা ও অধিকতর সংস্কারের লক্ষ্যে যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

আওয়ামী লীগ আজ তার প্রতিষ্ঠাকালীন আদর্শ এবং সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়— আমাদের মুক্তিযুদ্ধ— থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। যারা বঙ্গবন্ধুকে সত্যিকারে ভালোবাসেন ও শ্রদ্ধা করেন এবং যারা নিজেদের প্রসারের জন্য বঙ্গবন্ধুর মতাদর্শ ব্যবহার করেন; এই ২ দলের মধ্যে কোনো পার্থক্য না করাটাই বছরের পর বছর ধরে চলা সবচেয়ে বড় ভুল বলে আমার মনে হয়। এখানেই আসল ও নকল একসঙ্গে মিশে যায় এবং আদর্শিক আওয়ামী লীগাররা স্বার্থসিদ্ধি অর্জনকারীদের কাছে পরাভূত হয়। পরের গোষ্ঠীটি অনেক বেশি কুচক্রী ও ধনী— নিজেদের সুবিধা আদায়ের জন্য কারসাজির আশ্রয় নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের অসাধারণ দক্ষতা রয়েছে।

এ বিষয়ে ছাত্রলীগের কথা মাথায় আসে। ১৯৬৬-৬৭ সালের ৬ দফা এবং বিশেষ করে ১৯৬৯-৭০ সালের ১১ দফা আন্দোলনের সময় আমি ছাত্র ইউনিয়নের (মতিয়া গ্রুপ) সদস্য ছিলাম। সে সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই দেখা-সাক্ষাৎ হতো, কারণ এই ২ দল যৌথভাবে অসংখ্য সভা, মিছিল ও রাজপথের আন্দোলনে অংশ নেয়। মনে আছে, আমি শেখ কামালসহ ছাত্রলীগের হাজারো নেতাকর্মীর সঙ্গে একই মিছিলে অংশ নিয়েছিলাম, যেখানে তারা ছাত্র ইউনিয়নের অনেকের চেয়ে 'জাগো, জাগো, বাঙালি জাগো' জাতীয়তাবাদী স্লোগানের চেতনাকে আরও বলিষ্ঠ রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেই চেতনার তুলনায় বর্তমান ছাত্রলীগের প্রসঙ্গ আমি আর উত্থাপন করলাম না।

তাহলে ২২তম কাউন্সিল শেষে জাতিকে কী দেওয়ার আছে আওয়ামী লীগের? দলীয় নেতৃত্ব যদি সম্পূর্ণরূপে অপরিবর্তিত থেকে যায়, তাহলে তারা কতটাইবা পরিবর্তনধর্মী রাজনীতি আমাদেরকে উপহার দিতে পারবেন?

গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগের শাসনামলে আমাদের উন্নয়নের সূচক ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে, কিন্তু গণতন্ত্রের সূচক নিম্নমুখী ছিল। আমাদের অনেক বেশি অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, রাস্তাঘাট ও সেতু নির্মাণ হয়েছে, মাথাপিছু আয় ও রপ্তানি বেড়েছে, কিন্তু শাসনকাজ পরিচালনায় আমাদের অংশগ্রহণ কমেছে, প্রতিনিধি নির্বাচনে আমাদের ক্ষমতা দুর্বল হয়েছে এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা অনেকাংশেই বিলুপ্ত হয়েছে।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Dos and Don’ts during a heatwave

As people are struggling, the Met office issued a heatwave warning for the country for the next five days

1h ago