কবর সংরক্ষণ কেন আইনত নিষিদ্ধ করা উচিত

কবর সংরক্ষণে নাগরিকদের নিরুৎসাহিত করতে ফি বাড়িয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। গণমাধ্যমের খবর বলছে, বনানী কবরস্থানে ১৫ বছরের জন্য কবর সংরক্ষণ করতে লাগবে ১ কোটি টাকা, আর ২৫ বছরের জন্য গুনতে হবে দেড় কোটি টাকা।

কবর সংরক্ষণে নাগরিকদের নিরুৎসাহিত করতে ফি বাড়িয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। গণমাধ্যমের খবর বলছে, বনানী কবরস্থানে ১৫ বছরের জন্য কবর সংরক্ষণ করতে লাগবে ১ কোটি টাকা, আর ২৫ বছরের জন্য গুনতে হবে দেড় কোটি টাকা।

একইভাবে উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরের কবরস্থানে ১৫ বছরের জন্য ৭৫ লাখ টাকা আর ২৫ বছরের জন্য ১ কোটি টাকা; উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের করবস্থানে ১৫ বছরের জন্য ৫০ লাখ আর ২৫ বছরের জন্য ৭৫ লাখ টাকা; উত্তরা ১৪ নম্বর সেক্টরের কবরস্থানে ১৫ বছরের জন্য ৩০ লাখ আর ২৫ বছর বছরের জন্য ৫০ লাখ টাকা সংরক্ষণ ফি নির্ধারণ করা হয়েছে।

এই খবরের প্রসঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকেই লিখেছেন, 'মরতেও এত টাকা!', কেউ লিখেছেন, 'মরেও শান্তি নেই' ইত্যাদি।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, ২৫ লাখ হোক আর ৫ কোটিই হোক— রাজধানীর কোনো কবরস্থানে কারো কবর বাঁধাই করে স্থায়ী করা বা দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণের সুযোগ থাকা উচিত কি?

এই মহানগরে প্রায় ২ কোটি মানুষের বসবাস। কিন্তু ২ সিটিতে সরকারি কবরস্থান আছে মাত্র ১০টি। এগুলো হচ্ছে আজিমপুর কবরস্থান, জুরাইন কবরস্থান, মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান, বনানী কবরস্থান, খিলগাঁও কবরস্থান, রায়েরবাজার কবরস্থান, উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টর ও ১২ নম্বর সেক্টরে রয়েছে ২টি কবরস্থান। এ ছাড়া, ধলপুর কবরস্থান ও মুরাদপুর শিশু কবরস্থান নামে আরও ২টি কবরস্থান রয়েছে।

এসব কবরস্থানে নতুন করে জায়গা বাড়ানোর সুযোগ নেই। ফলে বাঁধাইকৃত বা দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষিত নয় এমন কবরগুলো একটু পুরনো হলেই সেখানে নতুন কবর খোঁড়া হয়। কিন্তু সংরক্ষণের বাইরে যে পরিমাণ জায়গা আছে, সেগুলো খালি রাখা না গেলে বা সেসব জায়গায় কবর বাঁধাই কিংবা দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণের সুযোগ দিলে একসময় মানুষকে কবর দেওয়ার মতো শূন্য জায়গা অবশিষ্ট থাকবে না। ফলে নতুন করে কোনো কবর বাঁধাই কিংবা ১০, ১৫ বা ২৫ বছর মেয়াদে কোনো কবর সংরক্ষণের সুযোগ আদৌ থাকা উচিত কি না— সে প্রশ্নটিই উঠছে।

বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর অন্যতম। মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ভেতরে প্রায় ২৮ কোটি মানুষের বসবাস। ২০৪১ সালে যখন বাংলাদেশ উন্নত-সমৃদ্ধশালী দেশ হবে বলে আশা করা হচ্ছে, তখন যে দেশের এই জনসংখ্যা আরও অনেক বাড়বে এবং তখন যে আরও বেশি অবকাঠামো নির্মাণ ও শিল্পায়নের কারণে আরও বেশি জমির প্রয়োজন হবে, তথা জমির সংকট দেখা দেবে— সেটাই স্বাভাবিক। সুতরাং ঢাকায় নতুন করে কবরস্থান বাড়ানোর সুযোগ নেই। জায়গায়ও নেই। তারচেয়ে বড় কথা, কবর বাঁধাই করা কিংবা দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তাই বা কতটুকু?

স্বজনের মরদেহ নিয়ে মানুষের আবেগ থাকে। সেই আবেগের কারণেই তারা কবর বাঁধাই কিংবা দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণ করতে চায়। কিন্তু রাজধানী ঢাকায় সেই সুযোগ অব্যাহত রাখা হলে ভবিষ্যতে কবর দেওয়ার মতো কোনো জায়গা খালি থাকবে না। কারণ একদিকে জীবিকার টানে ঢাকায় মানুষের আগমন ও স্থায়ী হওয়ার পরিমাণ বাড়ছে, অন্যদিকে টাকাওয়ালা মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। আর যেহেতু কবর সংরক্ষণের সঙ্গে আবেগ ও সামাজিক স্ট্যাটাস জড়িত, ফলে টাকাওয়ালা মানুষ চাইবে তাদের স্বজনদের কবরগুলো বাঁধাই করে স্থায়ী করতে বা দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণ করতে। উপরন্তু কালো টাকা ও নানাভাবে অবৈধ পথে টাকা আয়ের প্রবণতাও যেহেতু বাড়ছে, ফলে সিটি করপোরেশন কবর সংরক্ষণের ফি যত টাকাই ধার্য করুক না কেন, সমাজের বিরাট অংশের মানুষের জন্য সেটি খুব বড় অংক হবে না।

অতএব ফি বাড়ানোই সমাধান নয়। বরং রাজধানীতে কবর স্থায়ী করা বা দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণ করার বিষয়টি আইন করে নিষিদ্ধ করা এখন সময়ের দাবি। এখানে ব্যতিক্রম হতে পারেন জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিশিষ্ট নাগরিক— যাদের কবরে প্রতি বছর তাদের জন্ম-মৃত্যু দিবসে সাধারণ মানুষের ও রাষ্ট্রীয়ভাবে শ্রদ্ধা জানানোর ব্যাপার রয়েছে। সেসব কবর রাষ্ট্রীয়ভাবেই সংরক্ষণ করা যেতে পারে।

তবে ঢাকার বাইরে, অর্থাৎ ব্যক্তিগত জমিতে যদি কেউ কবর বাঁধাই করেন বা কবর সংরক্ষণ করেন, সেখানে রাষ্ট্র হয়তো বাধা দেবে না। তবে এখানেও রাষ্ট্রীয়ভাবে নিরুৎসাহিত করা প্রয়োজন। কারণ বাংলাদেশকে বলা হয় 'ল্যান্ড হাংরি কান্ট্রি' বা ভূমিক্ষুধার দেশ। এখানে প্রতিটি ইঞ্চি জমিই উর্বর ও মূল্যবান। অবকাঠামো ও শিল্পায়নের কারণে প্রতিদিন যে হারে জমি কমছে, তাতে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন কবরস্থানগুলোকেও যদি বাঁধাইকৃত কবরে ভরে ফেলা হয়, ২০-৩০ বছর পরে সেসব কবরস্থানেও জায়গার সংকট দেখা দেবে। সুতরাং সবাইকেই কবর সংরক্ষণ না করা তথা কবর বাঁধাই না করার বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন। মানুষ বাড়তে থাকলে খাদ্যের চাহিদাও বাড়বে। কিন্তু কৃষিভিত্তিক দেশে প্রতিনিয়তই কৃষিজমি কমছে। এটিও বিরাট উদ্বেগের বিষয়।

সবচেয়ে বড় কথা, কবর বাঁধাইকে ইসলামও সমর্থন করে না। আবেগ, সামাজিক স্ট্যাটাস ও আর্থিক ক্ষমতার কারণে গণহারে সবাই তাদের স্বজনদের কবর বাঁধাই করে স্থায়ী করতে থাকলে ভবিষ্যতে ঢাকার বাইরেও কবরস্থানের সংকট দেখা দেবে— যেহেতু সারা দেশেই টাকাওয়ালা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। আগামীতে আরও বাড়বে। ফলে রাষ্ট্রকে এখনই এ বিষয়ে খুব কড়া অবস্থান নিতে হবে।

এনটিভির ধর্মীয় অনুষ্ঠান 'আপনার জিজ্ঞাসা'র ১৬তম পর্বে এক দর্শক কবর সংরক্ষণ ও স্থায়ী করার ব্যাপারে ইসলামের বিধান কী জানতে চাইলে আলোচক ড. মুহাম্মাদ সাইফুল্লাহ বলেন, 'কবর পাকা করা যেমন হারাম, তেমনি কবরে নাম লেখা, জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ লেখা— এর কোনোটাই জায়েজ নয়।'

গত ২৩ জানুয়ারি নেক্সাস টেলিভিশনের লাইভ শো ইসলামি জীবনবিধানেও একই বিষয়ে প্রশ্ন এলে আলোচক গাজী মো. সানাউল্লাহ রাহমানী বলেন, 'পৃথিবীতে মাত্র ২টি কবরস্থানকে বরকতময় বলা হয়। একটি জান্নাতুল মাওয়া এবং অন্যটি জান্নাতুল বাকি। জান্নাতুল বাকি, যেখানে মহানবীর (স.) সাহাবিদের কবর রয়েছে, সেখানে দুয়েকটি কবর ছাড়া কোনো কবর সংরক্ষিত নেই। মহানবী (স.) বলেছেন, কবরকে মিশিয়ে দাও। কোনো কোনো গ্রন্থে এসেছে তিনি বলেছেন, কবরগুলো উটের কুঁজোর মতো কিছুটা উঁচু করে দাও। পুরুষ হলে মাথার উপরে একটি পাথর, আর নারী হলে পায়ের কাছে একটি পাথর দিয়ে দাও যাতে করে নারী-পুরুষের কবরগুলো আলাদাভাবে চেনা যায়।' আলোচক বলেন, 'কোটি কোটি টাকা খরচ করে কবর বাঁধাই করা, সংরক্ষণ করা, এর কোনো ফজিলত নেই।'

পরিশেষে, কবর বাঁধাই বা সংরক্ষণ করতে যেহেতু সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা তথা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে মোটা অংকের ফি দিতে হয়, ফলে প্রতিষ্ঠানের রাজস্ব বাড়ানোর কথা ভেবে হয়তো এই নিয়ম চালুর পক্ষে অনেকে কথা বলবেন। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে দেশের কল্যাণ বিবেচনায় নিয়ে কবর সংরক্ষণ ও স্থায়ী করার প্রবণতা বন্ধে রাষ্ট্রকে খুব জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে এখনই।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

DMCH doctors threaten strike after assault on colleague

A doctor at Dhaka Medical College Hospital (DMCH) was allegedly assaulted yesterday after the death of a private university student there, with some of his peers accusing the physicians of neglecting their duty in his treatment

5h ago