আমরাও যদি দায় নিয়ে পদত্যাগ করার মতো মন্ত্রী পেতাম!

মৃত্যু নিয়ে ইংরেজ লেখক জর্জ এলিয়ট বলেছিলেন, 'মৃতরা আমাদের কাছে ততক্ষণ মারা যান না, যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা তাদের ভুলে যাই।'

শনিবার চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কদমরসুল এলাকায় সীমা রি-রোলিং মিলের অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণে ৬ শ্রমিক মারা গেছেন। কিন্তু, আমরা যদি জর্জ এলিয়টের কথা ধরি, তাহলে তারা এখনো মারা যাননি। কারণ, আমরা তাদের এখনো ভুলে যাইনি। তবে, বেশিদিন মনে রাখব না, একসময় ভুলে যাব। যেভাবে এর আগেও অনেক দুর্ঘটনার কথা আমরা মনে রাখিনি।

শনিবার যে ৬ শ্রমিক মারা গেছেন, তারা আমাদের বিবেককে কতটা নাড়া দিতে পেরেছেন? আদৌ কি আমাদের বিবেক কখনো নড়ে? কিংবা আমাদের বিবেচনাবোধ বলে কিছু আছে? ধরে নিতেই পারি আমাদের বিবেক অনেক আগে মারা গেছে। বিবেক বলে যে কিছু আছে বা থাকে, তা আমরা ভুলে গেছি। মানে আমরা বিবেকহীন! তাই বিবেক আমাদের নাড়া দেয় না।

এই কথার সঙ্গে আপত্তি থাকতে পারে। কিংবা বিবেকহীন বলায় কষ্ট লাগতে পারে। কিন্তু, কেউ যদি মনে করেন তার বিবেক জাগ্রত আছে, তাহলে একটি প্রশ্ন করি। গত বছরের ৪ জুন রাতের কথা মনে আছে? মনে করতে পারছেন? হয়তো পারছেন না, তাই কী উত্তর দেবেন তাও ভেবে পাচ্ছেন না। কারণ আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত কিছু না কিছু ঘটছে। কিন্তু, সেদিন রাতের ঘটনা আর ১০টা ঘটনার মতো ছিল না। সেদিনও চট্টগ্রামে আগুন লেগেছিল, এই সীতাকুণ্ডেই। সেখানকার বিএম ডিপোতে আগুন থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়েছিল। এতে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যসহ ৫১ জনের মৃত্যু হয়েছিল।

৫১ জনের মৃত্যু! ভাবতে পারেন, ৫১ জন মানুষ পুড়ে মারা গেছেন। অথচ, সেই ঘটনা কিন্তু আমরা মনে রাখিনি। সেদিন অনেকে ঘটনাস্থলে পুড়ে মারা যান। অনেকে দগ্ধ শরীর নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ঘটনাস্থলে যাদের মৃত্যু হয়েছিল, তাদের কষ্ট বোঝার বোধ-বুদ্ধি কোনোটাই আমাদের নেই। কারণ, আমাদের বিবেক মরে গেছে! তবে, হাসপাতালে যারা চিকিৎসাধীন ছিলেন, তাদের কষ্ট দেখেও কিছুটা অনুভব করা যায়। ঠিক আছে, অনুভবের দরকার নেই। কারণ, এসব দেখতে দেখতে আমরা শুধু বিবেকহীন নয়, অনুভূতিহীনও হয়ে গেছি। তারচেয়ে একটি কাজ করুন। আপনার হাতের কাছে কি দেশলাই আছে? যদি থাকে, শুধু একটি কাঠি জ্বালান। তারপর হাতের চামড়ায় ধরুন। আগুনের সামান্য আঁচ কি সহ্য করতে পারছেন? হয়তো পারছেন না। তাহলে, বুঝে নিন লেলিহান আগুনে চামড়া পুড়লে কতটা কষ্ট হয়! কতটা ভয়ংকর হয় সেই মৃত্যু!

এমন মৃত্যুতো আমরা কেউ চাই না। তবুও কেন বারবার শ্রমিকদের এভাবে মরতে হচ্ছে। নাকি শ্রমিকের চামড়া একটু পুরু হয়? তাই তাদের কষ্ট হয় না! শ্রমিকের চামড়া পরীক্ষা করার জন্য দেশে ল্যাব থাকলে ভালো হতো। তাহলে জানা যেত, তাদের চামড়া অন্যদের চেয়ে পুরু কি না।

যাই হোক, এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর দায় কিন্তু কারো না কারোর ওপর বর্তায়। কিন্তু কে নেবে সেই দায়? আমাদের দায়িত্বের চেয়ারে বসা মানুষের অভাব নেই। কিন্তু দায় নেওয়া মানুষের বড় অভাব। কখনো কি শুনেছেন দেশে দুর্ঘটনার দায় নিয়ে কোনো মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন? আমরা শুনিনি। কারণ আমাদের এমন বোকা মন্ত্রী নেই, যে পদত্যাগ করে চেয়ার ছাড়বেন! তারা জানেন একবার ছেড়ে দিলে ওই চেয়ারে হয়তো আর বসা হবে না। তাই এমন ভুল তারা করেন না। তারচেয়ে মিডিয়ার সামনে কিছু একটা বলে দিলেই হলো। তাদের কেউ তো মারা যাননি। যাদের গেছে, কিছু ক্ষতিপূরণ দিলেই হয়ে গেল! একদম সহজ সমাধান।

তবে, দায় নেওয়ার উদাহরণের অভাব নেই। যেমন: কিছুদিন আগে পদত্যাগ করেছেন গ্রিসের অবকাঠামো ও পরিবহনমন্ত্রী কোস্টাস কারামানলিস। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি গ্রিসে ২টি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে ৩৮ জনের মৃত্যু হয়। তারপরের দিন ওই ঘটনার দায় নিজের ঘাড়ে নিয়ে পদত্যাগ করেন কারামানলিস। ভাবছেন, মানুষ কতটা বোকা হলে এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে?

হয়তো আমাদের দৃষ্টিতে গ্রিসের কোস্টাস কারামানলিস বোকা মানুষ। কিন্তু, সত্যি যদি আমাদের এমন কিছু বোকা মন্ত্রী থাকতেন, তাহলে কত কিছুই বদলে যেত। হয়তো আর এত শ্রমিককে এভাবে আগুনে পুড়ে মরতে হতো না। সড়ক দুর্ঘটনায় অকালে ঝরে যেত না কোনো স্বপ্ন। আমরা কি কখনো এমন বোকা মন্ত্রী পাব না? যিনি বা যারা বুক চেতিয়ে যেকোনো দুর্ঘটনার দায় নিয়ে উদাহরণ তৈরি করবেন? বদলে দেবেন আমাদের দেশকে? জাগিয়ে তুলবেন ঘুমন্ত বিবেককে?

মৃত্যু নিয়ে জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামি বলেছিলেন, 'মৃত্যু জীবনের বিপরীত নয়, বরং অবিচ্ছেদ্য।' তিনি ভুল বলেননি। শতভাগ ঠিক কথা বলেছেন। কিন্তু, সেই মৃত্যু হলো সাধারণ মৃত্যু, অস্বাভাবিক মৃত্যু নয়। সেই সাধারণ মৃত্যুর অধিকারটুকুও কি শ্রমিকরা পাবেন না? আর কত মানুষ পুড়ে মরলে সেই অধিকার পাবেন তারা? আর কত মানুষ পুড়লে ক্ষমতার চেয়ারে বসা মানুষগুলো সচেতন হবেন? এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে কেউ বাধ্য নন। কিন্তু, দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের এমন একটি প্রশ্ন থাকতেই পারে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা জোসেফ স্ট্যালিন বলেছিলেন, 'একটি মৃত্যু একটি ট্র্যাজেডি; মিলিয়ন মৃত্যু পরিসংখ্যান।' আসলেই তাই, যখন কোথাও আগুন লাগে বা দুর্ঘটনা ঘটে প্রথম দিকে প্রতিটি মৃত্যুকে ট্র্যাজেডি মনে হয়। সেই ট্রাজেডির গল্প আমরা শুনি। কখনো খারাপ লাগে, কষ্ট হয়। কিন্তু, ধীরে ধীরে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকে, তখন মৃত্যুর সংখ্যা হয়ে যায় পরিসংখ্যান। শনিবারের ঘটনাও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর পরিসংখ্যান হয়ে যাবে।

রবিউল কমল: সাংবাদিক, দ্য ডেইলি স্টার

Comments

The Daily Star  | English

Next nat’l polls: BNP urges CA, CEC to disclose what they discussed

The BNP will feel reassured if both the chief adviser and the chief election commissioner disclose to the nation what they discussed about the upcoming national polls during Thursday’s meeting, the party’s Standing Committee member Salahuddin Ahmed said yesterday.

47m ago