ঢাকার ক্ষত-বিক্ষত বাস আগন্তুকদের কী বার্তা দেয়

ঢাকা শহরে এসব আনফিট বাসের বেপরোয়া চলাচল কি বন্ধ হবে না?
এই শহরের বাসগুলো দেখলে মনে হয় যেন এখনই মারামারি করে ফিরলো। ছবি: প্রবীর দাশ/স্টার ফাইল ছবি

দেশের নানা প্রান্ত থেকে যারা প্রথমবার রাজধানী ঢাকায় ঘুরতে বা যেকোনো কাজে আসেন, তাদের কাছে প্রথম দর্শনে ঢাকার রাস্তায় চলাচল করা পাবলিক পরিবহনগুলো কী বার্তা দেয়?

প্রথম বারের মতো ঢাকায় আসা মানুষটির মনে হয়তো ধারণা রয়েছে যে এই শহরের মানুষগুলো খুব সুন্দর; পোশাক-পরিচ্ছদে কেতাদুরস্ত; বাহারি রঙের পোশাক; নানা রকমের সাজগোজ; চুলে বাহারি ফ্যাশন; মানুষগুলো খুবই স্মার্ট ও ব্যস্ত; রং-বেরঙের বড় বড় দালান-কোঠা; প্রশস্ত রাস্তাঘাট; নগরের রাস্তায় রিকশা থেকে শুরু করে চলছে হাজারো গণপরিবহন; সবচেয়ে দামি প্রাইভেট কার।

এই শহরে মানুষ সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেন বাস। সকালে বাসে চড়ে কেউ যাচ্ছেন অফিস-আদালতে, কেউবা অন্য কোনো গন্তব্যে। তবে এই বাসগুলোর শরীর নানা আঁচড় ভরা। লম্বা-লম্বা দাগ, টানা আঁচড়। অনেক বাসের দিকে তাকালে গাঁ শিউড়ে উঠবে, যেন ক্ষত-বিক্ষত শরীর। তবুও মানুষ হুড়োহুড়ি করে সেই বাসের পেটে ঢুকে যাচ্ছে।

বিপরীতে প্রাইভেট কারগুলো কত চকচকে। রং একেবারে পাকা। কথাও কাঁটা-ছেঁড়ার দাগ নেই।

এই আগন্তুক যদি বিদেশি হন, তাহলে? তার কি মনে হবে যে বাংলাদেশ গরিব দেশ বলেই এই শহরের বাসের গাঁয়ে এমন কাটছেরা দাগ? নিশ্চয় না। তারা নিশ্চই বুঝতে পারবেন যে বাস চালকদের বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর জন্য কোনো জবাবদিহি করতে হয় না বলেই এই পরিস্থিতি।

এই শহরের বাসগুলো দেখলে মনে হয় যেন এখনই মারামারি করে ফিরলো; অথবা সেই মারামারি থামেনি এখনো। রাস্তায় এমন অস্থির প্রতিযোগিতা চলছে সবসময়। মনে হয়, বাসটিকে পিছন থেকে কেউ হত্যা করার জন্য তাড়া করছে। প্রায় সব বাসের চিত্র একই হলেও রাস্তায় এ নিয়ে জনগণের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। যখন কোনো বাস অন্যটির গায়ে ধাক্কা দেয়, তখন যাত্রীরা হয়তো মৃদু প্রতিবাদ করেন।

সম্প্রতি ঢাকায় এসে ফার্মগেট এলাকায় উঠেছি এক বন্ধুর বাসায়। সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুনেছি বাড়ির পাশের স্কুলে শিশুরা জাতীয় সংগীত গাইছে। খুব মধুর সুরে। 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি'। ঢাকা শহরের এই শিশুরা কি বড় হয়েও এই 'বাংলা'র রাজধানীকে ভালোবাসতে পারবে—যখন তারা বুঝতে পারবে যে এই শহরের বুড়োরা তাদের জন্য একটা অবাসযোগ্য নগরী রেখে গেছে? যেখানে জীবের মধ্যে যেমন অস্থিরতা, তেমনি জড়ের মধ্যেও রয়েছে অস্থিরতা। যে অস্থিরতা মানুষ চাইলে কমাতে পারতো, কিন্তু কোনো চেষ্টাই করেনি!

দেশের যেকোনো সরকারি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গেলে দিনের বেশির ভাগ সময় আহত রোগী ও তাদের আত্মীয়-স্বজনের আর্তনাদ বা কান্না শুনতে পাবেন (নিহতের আত্মীয়-স্বজনরা বেশি কাঁদেন)। এই রোগী কিংবা স্বজনরা কাঁদেন, কারণ তার স্বজনের শরীরের কোথাও ব্যাধি বা কাটছেরা বা ক্ষত আছে। সেটা হতে পারে চামড়ার নিচে বা উপরে।

তর্কের খাতিরে যদি ধরি, কাল থেকে ঢাকা শহরের এই ছেঁড়া-ফাঁটা বাসগুলো মানুষের মতো কথা বলতে পারবে। তাহলে কী হবে? রাস্তায় যেতে পারবেন? গেলেও কি এই বাসে অফিস-আদালত কিংবা বাড়ি ফিরতে পারবেন? কারণ, এই ৭ হাজার (বিআরটিএ সূত্রে) বাস-মিনিবাস তো সারাদিন উচ্চস্বরে কাঁদতে থাকবে; আকুতি করতে থাকবে, 'আমাকে বাঁচাও, বাঁচাও। আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাও।' বাসগুলোর আর্তনাদে প্রকম্পিত হবে ঢাকা। অথবা তাদের অভিশাপে ভারী হবে এই শহরের আকাশ-বাতাস।

ঢাকায় যারা এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা করে রাস্তায় বাস চালান, ২ বাসের চাপায় মানুষের হাত-পা বিচ্ছিন্ন করে দেন, অসুস্থ প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে বাসচাপায় মানুষ মেরে ফেলেন; নিয়ম মেনে বাস চালালে কি তাদের আয় বন্ধ হয়ে যাবে? বিষয়টি কি এমন যে এভাবে প্রতিযোগিতা না করলে কেউ অনেক বেশি আয় করে ফেলবেন আর কেউ আয়ই করতে পারবেন না? যৌক্তিকভাবে চিন্তা করলে সহজেই বুঝতে পারবেন যে, সবাই আইন মেনে বাস চালালে এখন যে পরিমাণ আয় করছেন, তখনই একই পরিমাণ আয়ই করতে পারবেন।

অধিক যাত্রীর আশায় প্রায় সবাই অসুস্থ প্রতিযোগিতা করছে, বেপরোয়াভাবে বাস চালাচ্ছে। ফলে সবার আয় প্রায় একই রকমের হচ্ছে। তাদের আয়ে আকাশ-পাতাল পার্থক্য নিশ্চই হয় না। বেপরোয়াভাবে বাস না চালিয়ে বরং সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে চালিয়ে যদি একই আয় হয়, তাহলে জীবনকে এত ঝুঁকিপূর্ণ করে কী লাভ?

২০১৮ সালে কারওয়ান বাজারে ২ বাসের রেষারেষিতে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী রাজীব হাসানের হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে নিহত হওয়ার নির্মম ঘটনা কি কেউ ভুলতে পেরেছি? সারা দেশে আলোড়ন তুলেছিল রাজীবের সেই ছিন্ন হওয়া হাতের ছবি। কতই না প্রতিবাদ করেছিল দেশের মানুষ! কিন্তু, সেই থেকে আজ অবধি পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়েছে? ঢাকা শহরের বাসের শরীরের সেই আঁচড় এখনো আগের মতোই আছে, চালকরা আজও সেই একই বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালান, এখনো ঘটে নির্মম দুর্ঘটনা। অবশ্য এগুলোকে দুর্ঘটনা বললে ভুল হয়ে যাবে। এটাকে বরং 'ইচ্ছাকৃত হত্যা বা অপরাধ' বললে হয়তো যথার্থ বলা হবে।

গত ১০-১৫ বছরে ঢাকা শহরের কতই না পরিবর্তন হয়েছ, উন্নতি হয়েছে। এই শহরের রাস্তাঘাট বড় হয়েছে, সাজসজ্জা বেড়েছে, ফ্লাইওভার হয়েছে, আন্ডারপাস হয়েছে, সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে মেট্রোরেল। আওয়ামী লীগ সরকারের চলমান শাসন আমলে ঢাকা শহরে অনেক পরিবর্তন এলেও বাসের গা থেকে ওঠেনি সেই অস্থিরতার আঁচড় বা কাটাছেঁড়ার ক্ষত। যদিও মাঝে মাঝে বাসগুলোর গাঁয়ে রং মাখিয়ে ক্ষত ঢাকার চেষ্টা করেন অনেক বাস মালিক।

প্রশ্ন হলো, ঢাকা শহরে এসব আনফিট বাসের বেপরোয়া চলাচল কি বন্ধ হবে না?

একটি দেশের রাজধানী সেই দেশের প্রতিনিধিত্ব করে। দক্ষিণ এশিয়ার ৮ দেশের কোনো একটি রাজধানীতে আপনি এমন চিত্র দেখতে পাবেন না যে পাবলিক বাসের গায়ে গুটি বসন্তের মতো খানাখন্দরে ভরা।

প্রতিবেশী দেশের বেশ নিকটতম রাজ্য কলকাতা শহরেও কিন্তু মানুষ বাসে চড়েন। এই সংখ্যাটা নেহায়েত কমও না। কিন্তু সেখানকার বাসের গায়ে এমন ক্ষত দেখতে পাবেন না। ঢাকার একই রাস্তায় চলাচল করে যদি প্রাইভেট কারের শরীরে আঁচড় না লাগে, তাহলে পাবলিক পরিবহনগুলোতে এত আঁচড় থাকবে কেন?

ঢাকার এই পাবলিক বাসের গায়ে থাকা ক্ষতগুলো কি একগুঁয়েমি, যেটা কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না? হতে পারে। কারণ, এটা আর যাই হোক ঢাকা শহরের মানুষের অস্থিরতার কোনো চিত্র নয়। এটা হচ্ছে জবাবদিহিতার অভাব। প্রাইভেটকার চালকদের জবাবদিহিতা আছে বলে প্রাইভেটকারে এই ক্ষত থাকে না। প্রাইভেটকারগুলো ক্ষত-বিক্ষত বাসের পাশাপাশি চললেও নিজেদের ক্ষত-বিক্ষত করতে চায় না।

সরকার চাইলেই বাসগুলোর এই রেষারেষি বন্ধ হবে না। চাইতে হবে সবাইকে—বাস মালিক, চালক, সরকার এবং অবশ্যই যাত্রীদেরও। ক্ষত-বিক্ষত বাস এড়িয়ে চলার মাধ্যমে এসব বাসের মালিকদের ও চালকদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারেন যাত্রীরা। নিজেদের এই সুন্দর শহরে এমন অসুন্দর বাস থাকবে কেন?

সরকার চাইলে এই সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান করতে পারে। যেসব বাসের গায়ে ক্ষতের চিহ্ন থাকবে, সেগুলোর চালক ও মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে, ড্রাইভিং লাইসেন্স ও গাড়ির রুট পারমিট বাতিল করতে পারে, এমন নানাভাবে তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যেতে পারে। জবাবদিহিতা না থাকলে এই অবহেলা কোনো দিনই বন্ধ হবে না।

মোস্তফা সবুজ দ্য ডেইলি স্টারের বগুড়া প্রতিনিধি

Comments

The Daily Star  | English

The contradiction of comfort

How comfortable is it to not have clean air to breathe?

6h ago