চামড়ায় নয়-ছয়, আমড়ায় সাত-সতেরো

নয়-ছয় না থাকলে চামড়া শিল্প এখনো 'সোনার খনি', যার কিছুটা নমুনা এবারের বাজারেও। গেল কয়েকবারের মতো এবার কোরবানির চামড়া ফেলে দেওয়া, পুঁতে ফেলা বা বিরক্তির সঙ্গে একদম আল্লাহর ওয়াস্তে দিয়ে ঝামেলামুক্তির মন্দ খবর নেই।

মৌসুমি বেপারি বা সংশ্লিষ্ট কারো চামড়া নিয়ে মাথায় হাত পড়ার অবস্থা হয়নি। কম-বেশি টাকার মুখ দেখছে সবাই। সপ্তাহখানেকের মধ্যে সরকার নির্ধারিত দরে আগামী সপ্তাহে ঢাকার বাইরের লবণযুক্ত চামড়া কেনা শুরু হবে। সেই বিশেষ প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন-বিটিএ।

এ বছর ৯০ থেকে ৯৫ লাখ পিস চামড়া সংগ্রহের আশা তাদের। রাজধানীর পোস্তাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গার আড়তগুলোতে এখন লবণ মাখানোসহ কাঁচা চামড়ার ধুম কারবার। কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে না হলেও সাভারের ট্যানারি মোকামেও মোটামুটি কর্মব্যস্ততা যাচ্ছে। সেখানকার ট্যানারি শিল্প এলাকা পুরোপুরি তৈরিতে বিসিকের ব্যর্থতার অভিযোগ থাকলেও একেবারে আশাহত হওয়ার অবস্থা নেই।

কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে এবারো বিপত্তি-নৈরাজ্য ঘটবে, সেই শঙ্কা ছিল না। কোরবানির আগে দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার পর থেকে অবিরাম হুমকি-ধমকির তীর ছুঁড়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী। বলেছেন, নয়-ছয় করলেই খবর নিয়ে ছাড়বেন। এতে কিছু কাজ হয়েছে। তবে, পূর্বাপরে আরও ঘটনা আছে। রয়েছে কিছু প্রশ্নও।

একই মানের চামড়ার জুতার ভারতে যে দাম, তার দ্বিগুণ দাম দিয়ে দেশি কোম্পানির তৈরি জুতা কেন কিনতে হয়? এরপরও কে বা কারা চামড়ার দাম তলানিতে নিয়ে যায়, সেই প্রশ্নও চলমান। এ ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছাড়া চামড়ার কারবার সম্পর্কে ধারণা সবার নেই। চামড়ার নয়-ছয়ের গোমড়টা বোঝেন সীমিত কিছু মানুষ।

দেশের লবণযুক্ত চামড়ার দুই-তৃতীয়াংশই সরাসরি চলে যায় ট্যানারিগুলোতে। বাকি চামড়া পোস্তার ব্যবসায়ীরা কেনার পর বিক্রি হয় ট্যানারির মালিকদের কাছেই। কখনো তাদের মর্জির বাইরে যেতে পারে না সরকার। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা সময় দৃষ্টে যদ্দুর পারেন সুযোগ নেয়। কোরবানিদাতাদের করনীয় কিছু থাকে না।

লবণজাতের জন্য আড়তদার ছাড়াও ট্যানারির মালিক, ব্যাপারি, ফড়িয়া ও পাইকাররা কাঁচা চামড়া কেনেন। তাদের প্রতিযোগিতাটা একদম নিয়ন্ত্রিত। কেউ কাউকে বেদম ঠকিয়ে ফতুর করে নিজে বেশুমার লাভবান হওয়ার সুযোগ নেই। তবে, না বুঝে হঠাৎ গজানো মৌসুমি ও আড়তদাররা অতি শেয়ানামির কারণে কখনো কখনো বাঁটে পড়ে যান। কাঁচা চামড়া কেনা মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কিছু লাভ হাতিয়ে কেটে পড়ার সুযোগ থাকলেও লবণযুক্ত চামড়ার ১০ শতাংশ নষ্ট হলেও পথে বসতে হয়।

ট্যানারি মালিকরা হুট করে কিছু করেন না। তারা সচেতন-সতর্ক। বেশি চাতুরি করলে আড়তদাররা বিপদে পড়েন। এ ছাড়া, ২০১৫ সাল ও এর আগে থেকে ট্যানারির মালিকদের কাছে অনেক টাকা বকেয়া রয়েছে। কেউ টাকা ফেরত দিয়েছেন, কেউ আংশিক দিয়েছেন, আবার কেউ ফেরত দেননি। এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাঝপথে ব্যবসা ছেড়ে চলে যাওয়ারা আর পেছনে আসতে পারেন না। বাজারে লগ্নি বা আটকে যাওয়া টাকা আর তাদের ভাগ্যে জোটে না।

ঢাকার বাইরে চামড়ায় লবণ দেওয়ায় সম্পৃক্তদের সংগ্রহ এবারও ভালো। তবে লবণের দাম বেড়ে যাওয়ায় চামড়া প্রতি ৫০-৬০ টাকা খরচ বেড়ে গেছে। এদিকে, ছাগলের চামড়ার চাহিদা কমতে কমতে তলানিতে পড়ে গেছে। ছাগলের চামড়ার আন্তর্জাতিক বাজারও আরও করুণ। এ বছর গরুর চামড়া কিছু দাম পেলেও ছাগলের চামড়া দর-দামহীন। কোনো মতে বেচতে পারলেই রক্ষা।

আগে দেশের কয়েকটি ট্যানারি বিশেষভাবে ছাগলের চামড়া রপ্তানি করত। তারা এখন ছাগলের এক বর্গফুট চামড়াও রপ্তানি করে না। এর পূর্বাপরেও অনেক ঘটনা। একদিকে চামড়া নিয়ে মন্দ কথা, অন্যদিকে চামড়ায় আমদানি নির্ভরতা বাড়ছে। এ বৈপরীত্যের মোজেজা কোথায়?

দেশে বহু বছর আগ থেকে কনভেনশনের মতো চামড়ার একটি ভিত্তিমূলক মূল্য ধরে দেওয়ার চর্চা আছে। এ রেওয়াজের ওপর ভিত্তি করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রতি বছর চামড়ার একটি দাম বেধে দেয়। এ প্রক্রিয়ার ভেতরে চামড়ার বাণিজ্যিক দিকটি তেমন বিবেচ্য হয় না। এখনো এটি কোরবানি দান বা সদকার পণ্যের মতো। বাজারভিত্তিতে দরদাম ধরা হলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারতো। তা না হওয়ায় চামড়ার কারবার ও বাণিজ্য চলে যাচ্ছে নির্দিষ্ট কিছু হাতে।

চামড়ার টাকাকে গরিবের হক বলা হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। আবার প্রতি বছর কোরবানি দেওয়া লাখ লাখ গরু-ছাগলের চামড়া নিয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেই। ঋণ দেওয়া, সেল গঠনসহ অনেক কিছু শোনা গেলেও এগুলোর ভেতরের রহস্যে বড় গোলমাল। বছর কয়েক আগেও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা পাড়া-মহল্লায় চামড়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়তেন। শুরু হতো চামড়া নিয়ে কাড়াকাড়ি। বিভিন্ন এলাকার নিয়ন্ত্রণ করে চামড়া কেনা নিয়ে বিভিন্ন গ্রুপে সংঘর্ষও হতো। গত ২ বছর ধরে চামড়ার কারবার ফিকে হয়ে গেছে।

এ বছর ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার মূল্য ৫০-৫৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে তা ৪৫-৪৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। টাকার অংকে গত বছরের তুলনায় যা বেশি। সে ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, এখানে ৬ শতাংশের মতো মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে। অথচ এখন মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯ শতাংশের মতো। সেই বিবেচনায় দাম বেড়েছে বা কমেছে কোনোটাই বলা যায় না।

রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল হিসেবে বিবেচনা করলে, ডলারের বিনিময়ে টাকা অবমূল্যায়িত হওয়ায় রপ্তানিকারকরা বেশি টাকা পাবেন। টাকার অবমূল্যায়ন এবং মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশ ধরা হলেও চামড়ার মূল্য ৫৪-৬০ টাকা হওয়ার কথা। সেদিক থেকে এবার চামড়ার ধার্য দর অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ। যেখানে রয়েছে নয়-ছয়ের যাবতীয় ব্যবস্থা।

এক সময় যে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে চামড়া বেচাকেনা হতো, তা অনেকের বেমালুম হয়ে গেছে গত কয়েক বছরের কাণ্ডকীর্তির কারণে। দাম না পেয়ে মাটিতে পুঁতে ফেলা বা মাগনা দিয়ে ফেলার মতো ঘটনার তোড় চামড়ায় এমন দগদগে অবস্থা করেছে, যেন কোরবানির এমন চামড়া-কাণ্ডই স্বাভাবিক।

বছর কয়েক আগেও চামড়া রপ্তানিতে ধারাবাহিক একটি প্রবৃদ্ধি ছিল। এবার কিছুটা ছন্দপতনে মন্দের ভালো অবস্থার আবহ ঘুরছে। নয়-ছয়ের মাঝেও চামড়ার অভ্যন্তরীণ অবনমিত বাজারের বিপরীতে আন্তর্জাতিক বাজার চিত্র আমলে নিলে ইতিবাচক আরও কিছুর সম্ভাবনা যোগ হতে পারে। চামড়া বা চামড়াজাত পণ্যের সাপ্লাই-চেইনে অনানুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্মের লাগাম টানা নিশ্চয়ই বেশি কঠিন কাজ নয়। বরিশাল-পিরোজপুরের আমড়া চাষিরা কিন্তু সেই সক্ষমতা দেখাতে শুরু করেছেন।

পণ্য হিসেবে বিস্তর তফাতের মাঝেও চামড়া আর আমড়া শুনতে কিছুটা কাছাকাছি। আমড়ায়ও এক সময় সমানে চলেছে সাত-সতেরো কাণ্ড। ৫০ পয়সারও কম দামে কিনে ঢাকায় এনে ৫ টাকা দামে বিক্রি হতো আমড়া। সেই দিন বদলাতে উৎপাদনস্থলেই মোচড় দেওয়ার মতো অবস্থা নিয়েছে চাষি বা গৃহস্থরা। নিজস্ব কমিউনিটিতে ছোট ছোট ইউনিটি গড়ে তুলেছেন তারা। আমড়ার কারবারিদের ফ্রিস্টাইল মাঠ ছেড়ে দিচ্ছেন না।

দক্ষিণাঞ্চলের মাটি ও পানি আমড়া চাষের জন্য বেশ উপযোগী। বিশেষ করে বরিশালের ঝালকাঠি-পিরোজপুরে সুস্বাদু আমড়ার ফলন হয় সবচেয়ে বেশি। বলা চলে, সারা দেশের আমড়ার চাহিদার ৬০-৭০ ভাগ মেটায় এ অঞ্চলের চাষিরা। কয়েক বছর ধরে বাম্পার ফলনের সঙ্গে দামও আদায় করতে পারছেন তারা। প্রথমত, তারা আমড়ার ইউটিলিটি বুঝেছেন। দ্বিতীয়ত, তাদেরকে অবিরাম ঠকানোর রহস্য জেনেছে। সেই দৃষ্টে তারাও শিখেছেন দাম নির্ধারণ।

চলতি মাসের শেষদিক থেকে শুরু করে কার্তিক পর্যন্ত স্থানীয় ব্যাপারিরা গৃহস্থদের কাছ থেকে আমড়া কিনবেন। আবার অনেকে গৃহস্থদের কাছ থেকে  কেনা গাছ থেকে এ সময়ে পর্যায়ক্রমে আমড়া সংগ্রহ করবেন। তারপর সেগুলো বস্তা গুনে ঢাকা, চাঁদপুর, মুন্সিগঞ্জ, চট্টগ্রাম, রংপুর, সিলেট, যশোরসহ দেশের বিভিন্ন মোকামে পৌঁছবে। পাঠানো হবে ভারত, মালয়েশিয়া, নেপালসহ বিভিন্ন দেশে। ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যেও আমড়ার বাজার তৈরি হয়েছে।

ভিটামিন সি, আয়রন, ক্যালসিয়ামযুক্ত এ দেশি ফলটি এখন আর ফেলনা পর্যায়ে নেই। সুস্বাদু আচার, চাটনি ও জেলি বানাতে বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতেও নেওয়া হচ্ছে। টক-মিষ্টি মিশ্রণে ভিন্ন স্বাদের কম দামের আমড়া থেকে শেখার অনেক কিছু আছে চামড়াওয়ালাদের। এরইমধ্যে চামড়ার চেয়ে আমড়ায় ভালো ব্যবসার খোঁজও পেয়েছেন কেউ কেউ।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
cyber security act

A law that gagged

Some made a differing comment, some drew a political cartoon and some made a joke online – and they all ended up in jail, in some cases for months. This is how the Digital Security Act (DSA) and later the Cyber Security Act (CSA) were used to gag freedom of expression and freedom of the press.

7h ago