ভিয়েনা কনভেনশন এবং উন্নয়ন অংশীদারদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক

পরিবারের মধ্যে বিরোধ থাকলে যেমন প্রতিবেশীরা সেখানে জড়ানোর সুযোগ পায়, তেমনি কোনো দেশে রাজনৈতিক বিরোধ থাকলেও আঞ্চলিক বা বৈশ্বিক শক্তির আকর্ষণ তৈরি হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।

হিরো আলম ভাগ্যবান মানুষ। উপনির্বাচনে জয় না পেলেও তিনি নিশ্চিতভাবেই যতটা প্রাপ্য, তারচেয়ে অনেক বেশি মনোযোগ পেয়েছেন। অনেক দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের 'বাংলাদেশ ডেস্ক'-এ তার নামটি পরিচিত হয়ে উঠেছে।

আমাদের চোখে এটা 'চায়ের কাপে ঝড়' তোলার মতো ঘটনা। এর জন্য পশ্চিমের ১৩ রাষ্ট্রদূতের যৌথ বিবৃতি দেওয়ার যেমন দরকার ছিল না, তেমনি এই বিবৃতির জন্য পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সেই রাষ্ট্রদূতদের ডেকে নেওয়ারও প্রয়োজন ছিল না। প্রথমে যৌথ বিবৃতি, তারপর জাতিসংঘের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক সমন্বয়ককে 'তলব', এরপর ১৩ রাষ্ট্রদূতকে ডাকা—এর সবই উভয়পক্ষের অতি প্রতিক্রিয়া দেখানোর উদাহরণ।

সম্মানের সঙ্গেই বলতে চাই, আমাদের মতে এই ঘটনাটি রাষ্ট্রদূতদের যৌথ বিবৃতি দেওয়ার মতো বিষয় নয়। যৌথ বিবৃতির ব্যবহার খুবই কম হওয়া উচিত। তারা যে বার্তা দিতে চেয়েছেন, তা ভিন্নভাবেও দেওয়া যেত।

অপরদিকে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিক্রিয়া আরও কাঠামোগত সূক্ষ্ম হতে পারত। কূটনীতিতে অনেক সময় 'কী' বলা হচ্ছে সেটার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে 'কীভাবে' বলা হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে আমরা অস্বীকার করলেও বহির্বিশ্ব বিষয়টিকে এভাবেই দেখবে যে আমরা এই রাষ্ট্রদূতদের 'তলব' করেছি। এর কি প্রয়োজন ছিল?

শাহরিয়ার আলমের প্রেস ব্রিফিং থেকে আমরা বুঝতে পেরেছি, গত বুধবার ১৩ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকের মূল কারণ ছিল তাদেরকে ভিয়েনা কনভেনশনের বিধান স্মরণ করিয়ে দেওয়া, যা তারা যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে লঙ্ঘন করেছেন। যৌথ বিবৃতিটিকে 'অকূটনৈতিক আচরণ' হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে, যা 'বস্তুনিষ্ঠতা, নিরপেক্ষতা ও পক্ষপাতহীনতা' বর্জিত এবং এর ফলে 'কেবলই পারস্পরিক আস্থার সংকট তৈরি করবে'।

ওয়েস্টার্ন গ্রুপ নামে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, স্পেন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই ১৩ রাষ্ট্রদূতকে একসঙ্গে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে খুব কমই ডেকে নেওয়া হয়েছে। কোনো অবস্থাতেই আমরা আমাদের সম্পর্ককে 'আস্থার সংকটে'র দিকে যেতে দিতে পারি না।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী গণমাধ্যমকে প্রধান অপরাধী বানিয়ে বলেছিলেন, 'আমাদের মিডিয়া তাদেরকে (রাষ্ট্রদূতদের) অযথা গুরুত্ব দেয়, যা তারা উপভোগ করে। এতে করে তারা নিজেদের এ দেশের রাজা মনে করে এবং সবকিছু নিয়ে মন্তব্য করে।' বিদেশিদের খবর খুব বেশি প্রচার করার জন্য সাংবাদিকদের সমালোচনা করে এবং তাদের দেশে পুলিশ কী করে তা খুঁজে বের করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, 'আপনারা দেখেছেন ইংল্যান্ডে পুলিশ কীভাবে নির্যাতন করে? আপনারা দেখেছেন আমেরিকায় পুলিশ কীভাবে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে।' বর্তমানে বাংলাদেশে যে ইস্যুগুলো তৈরি হয়েছে তার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য পুলিশের কাজের সম্পর্ক কী? এসব দেশের পুলিশের দিকে নজর দিলে আমাদের বর্তমান সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে? রাষ্ট্রদূতদের বিরুদ্ধে নিজেদেরকে বাংলাদেশের 'রাজা' ভাবার অভিযোগ তোলা এক ধরনের অপরিপক্কতার উদাহরণ, যা বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে ভালো কিছু বয়ে আনতে পারে না।

উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, দীর্ঘদিনের দৃঢ় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কগুলোকে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পরীক্ষার মধ্যে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। নির্বাচনের বাইরেও আরও অনেক কিছু আছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগের মতো আরও অনেক কিছু আছে, যা নির্বাচনের পরেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে থাকবে। আমরা সেগুলোর কথা ভাবছি বলে মনে হচ্ছে না।

হ্যাঁ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এই নির্বাচন নিয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। কিন্তু, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের জন্য জোর দেওয়া তো আমাদের সাংবিধানিক উদ্দেশ্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ। শুধু তাই নয়, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রত্যাশা নাগরিক ও ভোটার হিসেবে আমরা সবাই করি।

সুষ্ঠু নির্বাচন কখন অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপে পরিণত হয় এবং কখন সেটা সরকার প্রধানের ঘোষিত নীতির বিরুদ্ধে যায়? আমাদের প্রধানমন্ত্রী, অসংখ্য মন্ত্রী, নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচন সম্পর্কিত প্রতিটি সংস্থা বারবার বলে আসছেন যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করাই আমাদের লক্ষ্য। তাহলে বিদেশি মিশনগুলো একই কথা বললে সেটা কেন অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হবে?

যার অবস্থান যাই হোক না কেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই যে আমাদের রাজনৈতিক সমস্যার অমীমাংসিত অবস্থানের কারণে আগামী নির্বাচন নিয়ে পুরো জাতিই চিন্তিত।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যাবে না এবং আওয়ামী লীগ এই দাবির সম্পূর্ণ বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। ফলে, সম্পূর্ণ অচলাবস্থায় আমাদের রাজনীতি। যখন বাহ্যিকভাবে দৃশ্যমান যে তীব্র রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হয়েছে, তখন সংকট কাটাতে পর্দার আড়ালে গোপন আলোচনা হয় বলে আমরা অনেক দেশে দেখেছি এবং অনেক সময় এর ফলাফলও পাওয়া গেছে। কিন্তু আমাদের এমন কোনো উদাহরণ নেই। এমনকি যোগাযোগ স্থাপনের সামান্যতম প্রচেষ্টাকেও উভয়পক্ষ থেকে অন্তর্ঘাত হিসেবে নিন্দা করা হতে পারে।

আমরা এখন একটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক অচলাবস্থার মুখোমুখি হয়েছি, যার সমাধানের কোনো ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিদিনই বক্তৃতায় হুমকি ও পাল্টা হুমকির সুর চড়ছে। পরিবারের মধ্যে বিরোধ থাকলে যেমন প্রতিবেশীরা সেখানে জড়ানোর সুযোগ পায়, তেমনি কোনো দেশে রাজনৈতিক বিরোধ থাকলেও আঞ্চলিক বা বৈশ্বিক শক্তির আকর্ষণ তৈরি হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।

আমরা বিশ্বের কাছে বলছি, নিজেদের সমস্যা আমরা নিজেরাই সমাধান করতে পারি, অথচ সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রসঙ্গ এলেই আমরা একে অপরের টুঁটি চেপে ধরি। এরপরও যদি প্রত্যাশা করি যে বহির্বিশ্ব প্রকাশ্যে বা গোপনে কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখাবে না, তাহলে নিশ্চয়ই আমরা বোকার স্বর্গে বাস করছি।

সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরোধী দলের চেয়ে সরকারকেই বেশি উদ্যোগী হতে হবে। কারণ, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সরকারের হাতে ন্যস্ত, বিরোধীদের হাতে নয়। আলোচনার দায়িত্ব সেই পক্ষের ওপরই বর্তায় যারা ক্ষমতায় আছে।

কোনো দেশই বিচ্ছিন্ন নয়। বিশেষ করে এই ডিজিটাল বিশ্বে তো নয়ই। আমরা কেউই, এমনকি রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের মতো বড় দেশগুলোও বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারে না। অনেকে তাদের ইচ্ছা অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু এরপরও এটা পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল একটি বিশ্ব, যার বাইরে কেউ নয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা রয়েছে, যেগুলো আমরা অত্যন্ত কার্যকরভাবে কাজে লাগাতে পেরেছি। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে পাওয়া সুযোগ-সুবিধা, জিএসপি সুবিধার ফলে রপ্তানিতে সহায়তা, সহজ শর্তে ঋণ, জাতিসংঘের দেওয়া সব সুবিধা আমরা উপভোগ করেছি বৃহত্তর আন্তর্জাতিক বোঝাপড়া এবং একটি নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার ফলে, যার মধ্যে রয়েছে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করা এবং একটি সুষ্ঠু ও জবাবদিহিমূলক শাসন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা। এই মুহূর্তে আমাদের দৃষ্টি মূলত নির্বাচনের ওপর আছে বলে বাকি বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। অভ্যন্তরীণ অগ্রাধিকার যাই হোক না কেন, কূটনৈতিক বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমরা বৃহত্তর স্বার্থ ভুলে যেতে পারি না, ভুলে যাওয়া উচিত না।

মাহফুজ আনাম, সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুল্লাহ আল আমীন

Comments

The Daily Star  | English
Digital journalism has not been kind to rural journalists

Digital journalism has not been kind to rural journalists

As the mainstream media adapts to the demands of digital age, the ugly sides of digital journalism continue to emerge.

7h ago