ডিসি-ওসি ভোট চাইলে রাজনীতিকরা কী করবেন?

সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের প্রতি অতি আনুগত্য প্রকাশ বা তোষামোদি আখেরে সরকারকে বিপদে ফেলে। বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বেশি তোষামোদি করতেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। অথচ বঙ্গবন্ধুর খুনের মূল পরিকল্পনাকারীও এই মোশতাক।

টানা তিন মেয়াদে রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী এবং দেশের বৃহত্তম দল হিসেবে আওয়ামী লীগের একটি বিরাট ভোটব্যাংক আছে। সেই ভোটাররা তো বটেই, সাধারণ মানুষ এমনকি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও বিরাট অংশ চাইতেই পারেন যে, আওয়ামী লীগ আবারও সরকার গঠন করুক।

কিন্তু একজন সরকারি কর্মকর্তা, যিনি মূলত প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, যার বেতন হয় জনগণের ট্যাক্সের পয়সায়; দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে নাগরিকের সেবায় নিয়োজিত থাকা যার সাংবিধানিক দায়িত্ব—তিনি কি নির্দিষ্ট কোনো দলের পক্ষে ভোট চাইতে পারেন?

সুযোগ পেলে তিনি নিশ্চয়ই কোনো দলের পক্ষে কিংবা কোনো প্রার্থীকে ভোট দেবেন। কিন্তু একজন রাজনৈতিক কর্মী কিংবা সাধারণ মানুষের মতো তিনি যেমন কোনো দলের পক্ষে ভোট চাইতে পারেন না, তেমনি কোনো দলের বিপক্ষেও বলতে পারেন না। কোনো দলকে ভোট দিতে নিরুৎসাহিত করতেও পারেন না।

কেননা নির্বাচনের মূল দায়িত্বটি পালন করতে হয় প্রজাতন্ত্রের এইসব কর্মকর্তা-কর্মচারীকেই। অতএব তারা যদি নিরপেক্ষ না হন; তারা যদি নির্দিষ্ট কোনো দলের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট হন এবং সেই পক্ষপাতটি প্রকাশ করে দেন, তাহলে তার পক্ষে নির্বাচনে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়।

সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগকে আবারও ক্ষমতায় আনার আহ্বান জানানোর ঘটনা নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে জামালপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. ইমরান আহমেদকে প্রত্যাহার করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়।

গণমাধ্যমের খবর বলছে, জামালপুরের মাদারগঞ্জ পৌরসভার নবনির্মিত ভবনের উদ্বোধন উপলক্ষে গত ১১ সেপ্টেম্বর বিকেলে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে জেলা প্রশাসক মো. ইমরান আহমেদ তার বক্তব্যে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে আওয়ামী লীগ সরকারকে আবার ক্ষমতায় আনার আহ্বান জানান। একইসঙ্গে তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য মির্জা আজমকে আগামী নির্বাচনের পর মন্ত্রী হিসেবে দেখারও আশা প্রকাশ করেন।

জেলা প্রশাসকের বক্তব্যের ৩ মিনিট ৩৮ সেকেন্ডের ওই ভিডিও ক্লিপ ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর এই ঘটনার সত্যতা যাচাই করে ইমরান আহমেদের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে চিঠি দেয় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তার একদিন পরই তাকে বদলি করা হয়। (প্রথম আলো, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩)

নির্বাচন কমিশনের চিঠিতে বলা হয়, 'জেলা প্রশাসকরা সাধারণত রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। নির্বাচনের সময় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও পালন করে থাকেন। এ অবস্থায় সরকার, গণতন্ত্র, নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং নির্বাচন কমিশনের ওপর জনমানুষের আস্থা অক্ষুণ্ণ রাখার স্বার্থে মো. ইমরান আহমেদকে ওই ঘটনার সত্যতা যাচাই সাপেক্ষে, জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া এবং আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো ধরনের নির্বাচনী দায়িত্ব প্রদান করা থেকে বিরত রাখা সমীচীন হবে।' জেলা প্রশাসকদের এ ধরনের আচরণ থেকে বিরত থাকতে সতর্কবার্তা দেওয়া প্রয়োজন বলেও মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে দেওয়া ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।

এই ভিডিও নিয়ে যখন গণমাধ্যমে সংবাদ এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনা হচ্ছিলো, তখন নির্বাচন কমিশনে একটি আলোচনায় প্রসঙ্গটি তোলেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনও।

তিনি বলেন, 'জামালপুরের ডিসির মতো ডিসিদের বিরুদ্ধে আপনাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এদের দিয়ে ক্রেডিবল নির্বাচন হবে না।' এরকম বাস্তবতায় ওই ডিসিকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। যদিও এই ধরনের বদলি কোনো শাস্তি কি না—সেটি নিয়ে বিতর্ক আছে।

প্রসঙ্গত, এই ঘটনার কিছুদিন আগে একজন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও (ওসি) আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট চেয়ে আলোচনায় এসেছিলেন। গণমাধ্যমের খবর বলছে, গত ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলা প্রশাসন একটি আলোচনা সভার আয়োজন করে। এতে নাঙ্গলকোট থানার ওসি ফারুক হোসেন অর্থমন্ত্রী ও নাঙ্গলকোটের সংসদ সদস্য আ হ ম মুস্তফা কামালকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত করতে স্থানীয় মানুষের প্রতি মিনতি জানান।

ওসি ফারুক তার বক্তব্যে বলেন, 'নাঙ্গলকোট উপজেলার মানুষ গণহারে গণমানুষের মতো করে উনাকে আবার নির্বাচিত করবেন। এটা স্থানীয় আমার মনের দিক থেকে আপনাদের প্রতি মিনতি।' এই ঘটনা নিয়ে গণমাধ্যমে রিপোর্ট এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনা হলে তাকে কুমিল্লা পুলিশ লাইনে বদলি করা হয়।

অবশ্য ওসিদের ভোট চাওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও একই ঘটনা ঘটেছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে সাতক্ষীরার কলারোয়ায় এক অনুষ্ঠানে নৌকা প্রতীকে ভোট চান একটি থানার ওসি। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ওই ভিডিওতে দেখা যায় তিনি বলছেন, 'আমি প্রশাসনের পক্ষ থেকে আপনাদের একটি কথা বলতে চাই, আপনারা আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তিকে ভোট দেবেন, নৌকা মার্কায় ভোট দেবেন।' যদিও ওই ওসি তখন দাবি করেছিলেন যে, তার বক্তব্য এডিট করে বিকৃত করে ছাড়া হয়েছে। (প্রথম আলো, ২২ ডিসেম্বর ২০১৮)

ডিসি বা ওসি জনকর্মচারী। জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় তাদের বেতন হয়। তারা কোনো দলের কর্মচারী নন। অতএব তারা যখন কোনো দলের বা প্রার্থীর পক্ষে ভোট চান, তখন অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে আসে।

যেমন: পরপর এই যে দুটি ঘটনা ঘটলো, সেখানে দেখা যাচ্ছে একজন থানার ওসি প্রকাশ্যে নৌকার পক্ষে ভোট চাওয়ার পাশাপাশি আ হ ম মুস্তফা কামালকে পুনরায় তার আসন থেকে এমপি হিসেবে নির্বাচিত করার 'মিনতি' করছেন। আর জেলা প্রশাসক শুধু নৌকায় ভোট দেওয়া নয়, বরং তার আসনের এমপি মির্জা আজমকে আগামী নির্বাচনের পরে মন্ত্রী হিসেবে দেখারও আশা প্রকাশ করেন।

খতিয়ে দেখা দরকার, এই ডিসি এবং ওসি যে দুজনের পক্ষে ভোট চাইলেন, তাদের কাছ থেকে তারা কোনো বিশেষ সুবিধা নিয়েছেন কি না? তারা কি স্বপ্রণোদিত হয়ে ভোট চেয়েছেন, নাকি কোনো কিছুর বিনিময়ে? নাকি তারা ওই দুজন এমপিকে বিব্রত করতে চাইলেন?

রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে কোনো দলের পক্ষে ভোট চাওয়া কি অতি উৎসাহ? তারা কি কোনো কিছু প্রাপ্তির লোভে এই ধরনের তোষামোদি করেন নাকি নিজেদের কোনো অন্যায় অপরাধ আড়াল করার জন্য নিজেদেরকে সরকারের পক্ষের লোক প্রমাণের চেষ্টা করেন?

তারা সরকারের কিংবা সরকারের কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির তোষোমোদি করে কি পদোন্নতি বা ভালো পোস্টিংয়ের পথ পরিষ্কার করতে চান, নাকি সত্যেই তারা সরকার বা ক্ষমতাসীন দলকে ভালোবেসে আবেগের বশবর্তী হয়ে এরকম বক্তব্য দিয়ে বসেন? তারচেয়ে বড় প্রশ্ন, কোনো সরকারি কর্মকর্তা, বিশেষ করে ডিসি ও ওসিরা যদি ভোট চাওয়া শুরু করেন, তাহলে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা কী করবেন?

তাছাড়া মাঠ প্রশাসনের সর্বোচ্চ ব্যক্তি কিংবা রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি যদি কোনো একটি নির্দিষ্ট প্রতীক বা নির্দিষ্ট প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান, সেটি পুরো প্রশাসন এবং পুলিশ বাহিনীর নিরপেক্ষতাকেই শুধু প্রশ্নবিদ্ধ করে না, বরং এইসব ঘটনা জনগণের মধ্যে এরকম একটি ধারণা তৈরিতেও ভূমিকা রাখে যে, জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় বেতন হওয়া কর্মচারীরা দলনিরপেক্ষ নন—যা সামগ্রিকভাবে সরকারের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ণ করে।

অতএব একজন ডিসি কিংবা একজন ওসি কোনো একটি দলের পক্ষে ভোট চেয়েছেন বলে বিষয়টি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। বরং এই ধরনের ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত করে দেখা উচিত যে, তারা কোন উদ্দেশ্যে কথাগুলো বললেন। কেননা জাতীয় নির্বাচনে জেলা প্রশাসক এবং থানার ওসিদের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। যে কারণে তাদের নিরপেক্ষ থাকাটা অনেক বেশি জরুরি।

নিশ্চয়ই একজন ডিসি বা একজন ওসির বক্তব্য পুরো প্রশাসন কিংবা পুলিশ বাহিনীর নয়। কিন্তু কোনো একজন ডিসি বা ওসি যে এভাবে প্রকাশ্যে ভোট চাইতে পারছেন কিংবা চাইছেন, সেই বাস্তবতা তৈরি হলো কেন—সেটিরও বিশ্লেষণ করা দরকার।

তাদের এই অতি উৎসাহের পেছনে পদোন্নতির লোভ অথবা কোনো অপরাধ আড়ালের চেষ্টা আছে কি না সেটি খতিয়ে দেখা দরকার। যদি পদোন্নতি কিংবা ভালো পোস্টিংয়ের জন্য এই ধরনের তোষামোদি করতে হয় কিংবা নিজেদেরকে সরকারের লোক প্রমাণ করতে না পারলে যদি পদোন্নতি ও ভালো পোস্টিং না হয়, তাহলে সেটি সামগ্রিকভাবে সুশাসনেরও প্রশ্ন। সরকারের সব প্রতিষ্ঠানের পদোন্নতি, বদলি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্য যে এখন একটি বড় শর্ত, সেই অভিযোগও বেশ পুরোনো।

তবে মনে রাখা দরকার, সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের প্রতি অতি আনুগত্য প্রকাশ বা তোষামোদি আখেরে সরকারকে বিপদে ফেলে। বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বেশি তোষামোদি করতেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। অথচ বঙ্গবন্ধুর খুনের মূল পরিকল্পনাকারীও এই মোশতাক।

শুধু এই ঘটনাই নয়, যুগে যুগেই এটা প্রমাণিত যে অতি তোষামোদকারীরা বিপজ্জনক। তারা এইসব তোষামোদ করে নিজেদের কোনো দুরভিসন্ধি আড়াল করার জন্য। তারা যখন গভীর কোনো ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে, তখন এমন সব কাজ করে, কথা বলে যাতে তাকে কেউ সন্দেহ করতে না পারে।

সুতরাং এই সময়ে যারা নিজেদেরকে শেখ হাসিনার চেয়ে বড় আওয়ামী লীগার প্রমাণে ব্যস্ত; যাদের কর্মকাণ্ডে অতি উৎসাহ দেখা যায়, তাদের কোনো খারাপ উদ্দেশ্য থাকা অসম্ভব নয়। তাদেরকে সন্দেহ করা উচিত। কেননা এইসব অতি উৎসাহী লোকের কারণে সরকার তথা ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মানুষের কাছে ভুল বার্তা যাচ্ছে।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments