মিয়ানমারে গেরিলারা খরচপাতি যোগায় কীভাবে

শুরুতে পিডিএফগুলোর অর্থ আসত প্রবাসী সমর্থকদের দান থেকে
গত বছরের অক্টোবরে অপারেশন ১০২৭ চালু হওয়ার আগে, এনইউজি প্রায় ৩৮টি টাউনশিপ থেকে কর সংগ্রহ করতে পেরেছিল। তবে তারপর থেকে এই সংখ্যা ৫০ এর কাছাকাছি পৌঁছেছে। ফাইল ছবি: এএফপি

মিয়ানমার থেকে প্রতিদিন যুদ্ধের খবর পাচ্ছে বাকি বিশ্ব। হররোজ সেখানে বিপুল গোলা-বারুদ পুড়ছে। 'তাতমা-দ' নামে পরিচিত সরকারি বাহিনী রাষ্ট্রীয় খরচে যুদ্ধ চালায়। কিন্তু প্রতিপক্ষ গেরিলারা এত যুদ্ধরসদ কোথায় পাচ্ছে? গেরিলাদের অর্থ আসছে কোথা থেকে? এসব নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই। কিন্তু বিস্ময়কর হলো, যুদ্ধের খরচপাতি যোগাতে নেমে দেশটির গেরিলারা রীতিমতো ব্যাংক দিয়ে ফেলেছে। গেরিলাযুদ্ধের আন্তর্জাতিক ইতিহাসে ঘটনা হিসেবে এটা বেশ বিরল।

যেভাবে একটা 'গেরিলা ব্যাংকে'র শুরু

মিয়ানমারে একেক অঞ্চলে গেরিলা সংগঠনের একেক নাম। প্রান্তিক সাতটি প্রদেশে অ-বামার জাতিগুলোর গেরিলা সংগঠনের আয়ের প্রধান উৎস স্থানীয় ব্যবসা ও চাঁদা। ব্যবসার মধ্যে গাছপালা থেকে অত্যাধুনিক মাদক পর্যন্ত সবই আছে। সংগঠন হিসেবে এরা অনেক পুরোনো এবং অভিজ্ঞ।

মধ্যাঞ্চলের পরিস্থিতি পুরো সেরকম নয়। সেখানে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে তাতমা-দ'র বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামা বামার তরুণ-তরুণীরা যুদ্ধবিদ্যা ও অর্থ সংগ্রহ দুটোতেই নবীন। পিপলস্ ডিফেন্স ফোর্স বা পিডিএফ নামে পরিচিত এই গেরিলাদের ব্যবসা করে অর্থ আয়ের জন্য কোনো কোনো দেশের সঙ্গে নেই কোনো সীমান্ত।

শুরুতে পিডিএফগুলোর অর্থ আসত প্রবাসী সমর্থকদের দান থেকে। সেই অর্থ দেশের ভেতর পৌঁছানোও সহজ হতো না। সরকারের নানান নজরদারির কারণে। সরকারের কাছে নাম-পরিচয় চলে যাবে এই ভয়ে চাইলেও দেশের বাইরে থেকে অনেকে গণতন্ত্রের সংগ্রামে অর্থ সাহায্য দিতে পারতেন না। এসব সমস্যা এড়াতে যেয়ে বামার গেরিলারা অর্থ লেনদেনের পথ হিসেবে নিজেরা রীতিমতো একটা ব্যাংক খুলে ফেলে।

২০২১-২২ এ সামরিক অভ্যুত্থানের বিরোধিতা করে দেশের নানান প্রান্তে বহু মানুষ রাষ্ট্রীয় চাকুরি ছেড়েছিলেন। তাদের গেরিলা প্রশাসনের নানা কাজে লাগিয়ে নিয়মিত বেতন-ভাতা দেওয়ার প্রয়োজনও এই ব্যাংকের ধারণায় গতি দিয়েছিল। এসব উদ্যোগে লিপ্ত গেরিলারা ক্রমাগত চেষ্টা করছে প্রযুক্তির দিক থেকে জান্তার চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে থাকতে।

'গেরিলাদের ব্যাংক' কাজ করছে 'গেরিলা প্রযুক্তি'তে

অনেকের মনে আছে, সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাদের আন্দোলনের নাম দিয়েছিলেন 'বসন্ত বিপ্লব'। সেই প্রতিরোধই ধীরে ধীরে গেরিলা যুদ্ধে পরিণত হয়। সেই যুদ্ধের অর্থ যোগাতেই যেহেতু ব্যাংক সে কারণে এনইউজি (জাতীয় ঐক্যের সরকার) এর নাম রেখেছে 'স্প্রিং ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক' বা এসডিবি। গত বছর জুলাইয়ের এই ব্যাংকের শুরু। শুরুর প্রথম দিন এই ব্যাংকে এক হাজার গ্রাহক হিসাব খুলেছিলেন। এখন হিসাবধারীর সংখ্যা প্রায় লাখ ছুঁয়েছে।

চলমান যুদ্ধের পিডিএফ গেরিলাদের মতো এই ব্যাংকও গেরিলা চরিত্রের। এটা পুরোপুরি একটা ডিজিটাল ব্যাংক। যারা মূলত ব্লকচেইন পদ্ধতির ক্রিপ্টো-কারেন্সি ব্যবহার করে। এরকম কৌশল নেয়ায় জান্তা গেরিলা অর্থায়ন রুখতে অনেকখানি ব্যর্থ হচ্ছে।

এই ব্যাংক ব্যবস্থা এগিয়ে নিতে আর্থিক বিষয়ে দক্ষ এবং তথ্যপ্রযুক্তিতে উচ্চতর জ্ঞানসম্পন্ন একদল চৌকস 'গেরিলা' দল বেঁধে কাজ করছে এখন। যাদের পেছনে আছেন জান্তা বিরোধী প্রবাসী সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী টিন টুন। প্রতিষ্ঠার সময় এসডিবি প্রবাসী সরকারের 'কেন্দ্রীয় ব্যাংক' থেকে অনুমতিও নেয়। তারা দেখাতে চাইছে পুরোদস্তর একটা সরকারের ছত্রছায়ায় তাদের অবস্থান, সুতরাং গ্রাহকদের প্রতারিত হওয়ার শঙ্কা নেই।

এসডিবি'র প্রাথমিক লক্ষ্য প্রতিরোধযুদ্ধের অর্থ সংস্থান হলেও তাদের দ্বিতীয় আরেক লক্ষ্য সামরিক সরকারের আয়-রোজগারে বাধা দেওয়া। দ্বিতীয় কাজটি তারা করছে জান্তার কর আদায় ব্যবস্থায় বাধা দিয়ে, তাদের আর্থিক পণ্যগুলোর বিরুদ্ধে জনমত গঠন করে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা থেকে জান্তাকে বিচ্ছিন্নকরার চেষ্টার ভেতর দিয়ে। এসব চেষ্টায় আন্তর্জাতিকভাবে অনেক দেশে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় সম্পদ আটকে গেছে।

প্রধানত ক্রিপ্টো-কারেন্সিভিত্তিক হলেও এই ব্যাংকে হিসাবধারীরা বর্তমানে ডলার থেকে থাই বাথ পর্যন্ত অন্তত দশটি দেশের মুদ্রায়ও লেনদেন করতে পারছে। এখানে আন্তঃদেশীয় তহবিলও স্থানান্তর করা যায়।

এসডিবি কারেন্সি সোয়াপের মাধ্যমে যাত্রা করেছিল। অর্থ লেনদেনের আন্তর্জাতিক 'সুইফট' ব্যবস্থায় সংযোগ আছে এদের। নিজস্ব ডেবিড কার্ডও করেছে তারা। মিয়ানমারের প্রবাসী সরকার দেশের যেসব সম্পদ কেনা-বেচা করছে তা কেবল এই ব্যাংকের মাধ্যমেই ক্রয়-বিক্রয় করা সম্ভব। একজন 'গ্রাহক' খুব কম তথ্য দিয়ে এই ব্যাংকে যুক্ত হতে পারেন। বিশ্বজুড়ে তাদের রয়েছে শতাধিক 'রিলেশনশিপ ম্যানেজার'।

ট্রেজারি বন্ড ছেড়ে শুরুর বছর এসডিবি 'বাজার' থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার তুলেছিল। গত নভেম্বরে এই ব্যাংক তার ১০ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে ১০ মিলিয়ন ডলার আয় করে মাত্র দশ দিনে। এসব অর্থেই এখন চলতি গেরিলাযুদ্ধ সাম্প্রতিক উচ্চতায় উঠতে পারলো।

এনইউজি কার সম্পদ কীভাবে বেচাবিক্রি করছে?

রাজধানী বা প্রধান শহরগুলোতে কোনো দপ্তর না থাকার পরও মিয়ানমারের প্রবাসী সরকার যে দেশের ভেতরকার অনেক সম্পদ বেচাবিক্রি করছে সে খবর শুনে অনেকে আশ্চর্য হন। প্রবাসী সরকার এনইউজি প্রথমে যে ওএফপি (অফিসিয়াল ফান্ডরেইজিং প্রোগ্রাম) নেয় তারাই এই ধারণা নিয়ে কাজে নেমেছিল। এই ধারণার মধ্যে ছিল জান্তার প্রধান জেনারেল মিঙ অন হ্লাইসহ নেতৃস্থানীয় জেনারেলদের স্থাবর সম্পত্তি ভার্চুয়ালি বিক্রি করে দে‌ওয়া। ইতোমধ্যে এনইউজি দলিতপত্রসহ দাপ্তরিক এই নিশ্চয়তা দিয়েছে 'বসন্ত-বিপ্লব' সফল হলে এসব সম্পত্তি তারা তাদের ক্রেতাকে হাতে কলমে বুঝিয়ে দেবে। ব্যাপক উদ্দীপনার সঙ্গে এই কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয় এবং অনেক সম্পত্তি এভাবে এনইউজি বেচেছে। এ প্রক্রিয়ায় ১৫০ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে গেরিলা সরকার। এই ধরনের কর্মসূচির একটা পার্শ্বফল হলো যারা এসব সম্পত্তি কিনছেন তারা নিজেদের স্বার্থেও গেরিলাযুদ্ধকে নিরন্তর সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন। কিছু কিছু খনিজ সম্পদও বিস্তারিত নিয়ম-নীতির ভেতর দিয়ে আগাম বিক্রি হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। তবে গেরিলা অর্থনীতির পুরোটাই ভার্চুয়াল নয়।

মিয়ানমারের ৩৩০টি টাউনশিপের মধ্যে অন্তত ৫০টি থেকে এনইউজি এখন কর হিসেবে মুদ্রা সংগ্রহ করে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। এরকম করারোপ নিয়ে কোথাও কোথাও জবরদস্তির ঘটনাও ঘটছে। তবে সব মিলে জান্তার তুলনায় এখনও এনইউজির আর্থিক সামর্থ্য বেশ কম। তারা এখন মাসে পাঁচ মিলিয়ন ডলারের মতো সম্পদ সামরিক কাজে গেরিলাদের পেছনে খরচ করতে পারছে। বিপরীত দিকে, জান্তার সামরিক বাজেট অনেক গুণ বেশি। তবে জান্তার জন্য গেরিলাদের নানান আর্থিক অন্তর্গাত স্থায়ী এক চ্যালেঞ্জ।

এনইউজি একসময় জেনারেলদের দ্বারা পরিচালিত বিভিন্ন কোম্পানির প্রায় ১১১টি পণ্য ও সংস্থা বয়কটের ডাক দিয়েছিল। সেটা জান্তার আর্থিক শক্তি বেশ কমাচ্ছে। গত বছর ১২ ডিসেম্বর বার্তা সংস্থা এপি এক জরিপের ফল প্রকাশ করে লিখেছিল দেশটিতে পোশাক তৈরির বিভিন্ন কম্পানি তাদের সামর্থ্যের মাত্র ৬০ ভাগ উৎপাদন করে এখন। অন্যদিকে, প্রতি আমেরিকান ডলারের বিনিময় হার প্রায় ২১০০ কিয়াতে পৌঁছেছে। সামরিক ক্যু'র আগে যা ছিল ১৩০০ কিয়াত।

একদিকে কিয়াতের দাম পড়ে যাওয়া, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের আয় কমে যাওয়া এবং তার বিপরীতে অনেক ক্রিপ্টো-কারেন্সির দাম বাড়া মিয়ানমারের পিডিএফভুক্ত গেরিলাদের জন্য ভালো সংবাদ। এতে তাদের এসডিবি দু'ভাবে লাভবান হচ্ছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ, ভারত, থাইল্যান্ড সীমান্তে তাতমা-দ'র নিয়ন্ত্রণ হ্রাস পাওয়ায় এসব এলাকা দিয়ে যে আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য হতো তা থেকেও জান্তার আয় কমে গেছে বা কমে যাচ্ছে। বিপরীতক্রমে এসব বর্ডার এলাকার বৈধ-অবৈধ নানান ধরনের 'ব্যবসা'য় গেরিলা সংগঠনগুলোর আয় বাড়ছে। যদিও তার বড় অংশ অ-বামার গেরিলারা পাবে কিন্তু তাদের সঙ্গে বামার-পিডিএফগুলোর সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ। বর্ডার ট্রেডে জান্তার নিয়ন্ত্রণ কমে যাওয়াও এনইউজি'র জন্য আর্থিকভাবে আরেক সুসংবাদ।

সংগৃহীত অর্থের বিবিধ ব্যবহার

অনেকেই জানেন, মিয়ানমারে লটারি খুব জনপ্রিয়। সরকারি তরফে সেখানে নানান ধরনের লটারি চালু ছিল। গেরিলাযুদ্ধের শুরু থেকে এনইউজি বিভিন্ন ধরনের লটারি টিকিট ছেড়েও অনেক তহবিল যোগাড় করছে। এরকম প্রথম লটারি প্রথম ঘণ্টায় পঞ্চাশ হাজার টিকিট বিক্রি করেছিল। এই লটারির দায় দেনা পরিশোধ করতে যেয়েই এনইউজি'র সংগঠকদের মাঝে প্রথম ডিজিটাল ব্যাংকের ধারণা আসে। লটারির মতো পদক্ষেপে আয় অল্প হলেও কেবল যে এতে নিজেদের কোষাগারে তহবিল আসে তাই নয় জান্তার তহবিল কমে। গেরিলা সংস্কৃতিতে দ্বিতীয়টিও এক ধরনের সফলতা। নে-পি-দ'র শাসকরা গোলা-বারুদের হিসাবে এখনও অনেক এগিয়ে থাকলেও গেরিলা মেধা প্রতিদিন তাদের আঘাত হানছে সৃজনশীল এবং বিস্ময়কর নানান উপায়ে।

স্থানীয় অনেক শিল্পী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উন্মুক্ত নিলামের মাধ্যমে তাদের শিল্পকর্ম বিক্রি করেও এনইউজিকে অর্থ দিচ্ছেন। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ইত্যাদি দেশে মিয়ানমারের প্রবাসী নাগরিকরা তহবিল যোগাড়ের জন্য গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, টি-শার্ট বিক্রি করে এবং নিজেদের সংস্কৃতির নানান পণ্যের বাজার বসাচ্ছে নিয়মিত। এসব অনুষ্ঠানে কেউ কেউ বাসা থেকে স্রেফ নুডুলস বানিয়ে নিয়ে এসে সংহতি জানায়। অনেক তরুণ-তরুণী মিয়ানমারভিত্তিক মোবাইল গেম বিক্রি করেও দেশে অর্থ পাঠায়। যেহেতু মিয়ানমারের গেরিলা দলগুলোকে ইউরোপ-আমেরিকায় 'সন্ত্রাসী' সংগঠন  হিসেবে  তালিকাভুক্ত করা হয়নি। সেকারণে সামাজিক প্রক্রিয়ায় গণচাঁদা উত্তোলনেও সমস্যা হচ্ছে না। কেবল  বামাররা নয়, কারেন, কাচিন, রাখাইনরাও এভাবে অনেক অর্থ তুলছে। যে জাতির প্রবাসীরা যতটুকু অর্থ উঠাতে পারুক, এরকম সকল আয়োজনে দেশের ভেতর যুদ্ধরত গেরিলাদের জন্য কিছু করার উদ্দীপনাই থাকে মুখ্য। এসব অর্থে কেবল যে চোরাই বাজার থেকে গোলা-বারুদ কেনা হচ্ছে তা নয় মুক্তাঞ্চলে চলছে হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অনেক কিছু। ঘুষের প্রলোভন দেখিয়ে সরকারি জওয়ানদের ভাগিয়ে আনার চেষ্টাও আছে।

আলতাফ পারভেজ: স্বাধীন গবেষক; 'বার্মা: জাতিগত সংঘাতের সাত দশক' গ্রন্থের লেখক

Comments