৭৫ শতাংশ ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েও নির্বাচন আয়োজনের পথে মিয়ানমারের জান্তা

সরকারবিরোধী বিক্ষোভ দমন করছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। ফাইল ছবি: রয়টার্স
সরকারবিরোধী বিক্ষোভ দমন করছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। ফাইল ছবি: রয়টার্স

সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখলের পর থেকেই অস্বস্তিতে মিয়ানমারের সামরিক সরকার। সম্প্রতি আরাকান আর্মিসহ একাধিক সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর কাছে কার্যত নাস্তানাবুদ হয়েছে জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের অনুগত সেনাবাহিনী।

সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে দেশের ৭৫ শতাংশেরও বেশি ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন জেনারেল মিন অং হ্লাইং। চার ভাগের এক ভাগ দখলে রেখে এখনো 'সরকার' চালাচ্ছে সেনাবাহিনী।

এমন পরিস্থিতিতে আগামী ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আয়োজনের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে দেশটির সামরিক জান্তা।

মিয়ানমারে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ। ফাইল ছবি: রয়টার্স
মিয়ানমারে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ। ফাইল ছবি: রয়টার্স

গতকাল মঙ্গলবার এই তথ্য জানিয়েছে মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম ইরাবতী।

লোক-দেখানো নির্বাচন?

চার বছর আগে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং তৎকালীন নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করেন। সে সময়ের সরকার প্রধান ও নোবেল জয়ী অং সান সুচিকে পাঠানো হয়ও নির্বাসনে।

তবে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা তো দূরে থাক, চার বছরের প্রায় প্রতি দিনই সংঘাত মোকাবিলায় কেটেছে জান্তা সরকারের। শুরুতে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ-প্রতিবাদ চললেও এক পর্যায়ে একাধিক সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে সরকারি বাহিনী।

এই গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্যেও আগামী ডিসেম্বর নির্বাচন আয়োজনে এগিয়ে যাচ্ছে সরকার।

মিন অং হ্লাইং তার সেনাদের এমন প্রার্থীদের সমর্থন দিতে অনুরোধ করেছেন যারা 'প্রকৃত অর্থে দেশের স্বার্থে কাজ করবেন।'

সম্প্রতি, মিয়ানমারের পূর্বাঞ্চলীয় শান রাজ্যের কেংটুং শহরে সফরে গিয়ে নির্বাচনের তথ্য দেন জান্তাপ্রধান। বিশ্লেষকদের মতে, হ্লাইং এখন সেনা-সমর্থিত রাজনৈতিক দলের প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন।

কেংটুং শহরে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং। ফাইল ছবি: সংগৃহীত
কেংটুং শহরে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং। ফাইল ছবি: সংগৃহীত

কয়েকদিন আগে তিনি নির্বাচনে জয়ী দলের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন।

তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন—এটি লোক-দেখানো ও প্রহসনমূলক নির্বাচন ছাড়া আর কিছুই নয়।

নির্বাচনে সেনাদের দল ইউএসডিপি'র ভূমিকা

ডিসেম্বরের নির্বাচনে সম্ভাব্য বিজয়ী হিসেবে ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (ইউএসডিপি) কথা শোনা যাচ্ছে। এর আগে, জান্তা সরকার গণতন্ত্রপন্থি কয়েকটি দলকে নিষিদ্ধ করে। এর মধ্যে আছে ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ও শান ন্যাশনালিটিজ লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এসএনএলডি)।

২০২০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পেয়ে সরকার গঠন করেছিল সুচির দল এনএলডি।

জান্তাবিরোধী বিক্ষোভে এনএলডির পতাকা ওড়াচ্ছেনে এক সমর্থক। ফাইল ছবি: রয়টার্স
জান্তাবিরোধী বিক্ষোভে এনএলডির পতাকা ওড়াচ্ছেনে এক সমর্থক। ফাইল ছবি: রয়টার্স

ইউএসডিপির চেয়ারম্যান ও সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খিন ই জানান, তার দল নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত।

২০২০ সালের নির্বাচনে দলটি ১০-২০টি আসন পেলেও তারা মিন অং হ্লাইংয়ের অভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দলটি অন্যান্য ছোট রাজনৈতিক দলকে এক করে 'ভোট কারচুপির' অভিযোগ এনে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ কামনা করে।

বাকিটা ইতিহাস।

সে সময় ইউএসডিপির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন খিন ই। তিনি ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানের আগে ও পরে সামরিক বাহিনীর সমর্থনে সমাবেশের আয়োজন করেন। উদ্দেশ্য ছিল সেনাবাহিনীর উদ্যোগকে বৈধতা দেওয়া।

২০২০ সালের নির্বাচনকে বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক 'নিরপেক্ষ ও মুক্ত' বলে অভিহিত করেন।

মিন অং হ্লাইংয়ের স্বপ্ন

পর্যবেক্ষকদের মতে, মিন অং হ্লাইং ইউএসডিপির পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন। দলটির বেশিরভাগ নেতাই সাবেক সামরিক কর্মকর্তা।

মিয়ানমারের সামরিক জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং। ফাইল ছবি: রয়টার্স
মিয়ানমারের সামরিক জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং। ফাইল ছবি: রয়টার্স

শান রাজ্যে জনপ্রিয় ইউএসডিপি। সেখানে ২০১৫ সালের নির্বাচনে সার্বিকভাবে এনএলডি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও শান রাজ্যে ইউএসডিপি বেশি আসন পেয়েছিল। ২০২০ সালে নির্বাচনে কিছুটা ভালো করলেও সব মিলিয়ে বলা যায়, ওই রাজ্যে ইউএসডিপি সবচেয়ে জনপ্রিয় দল।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এনএলডি ও এসএনএলডি দৃশ্যপটে না থাকায় ইএসডিপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার। ডিসেম্বরের নির্বাচনে জিতে সেনাদের 'আজ্ঞাবহ' পার্লামেন্ট তৈরিতে অবদান রাখবে ইউএসডিপি। পরে সহজেই মিন অং হ্লাইংয়ের প্রেসিডেন্ট হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে। এমনটাই বলছেন বিশ্লেষকরা।

২০০৮ সালের তৎকালীন সামরিক জান্তার তৈরি সংবিধান অনুসারে—মিয়ানমারের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ, উচ্চকক্ষ ও সামরিক বাহিনী প্রত্যেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য একজন করে প্রার্থী দেয়। ওই ব্যক্তি আইনপ্রণেতাও হতে পারেন আবার অন্য কোনো রাজনীতিবিদও হতে পারেন। সামরিক বাহিনীর জন্য পার্লামেন্টের ২৫ শতাংশ আসন সংরক্ষিত থাকে। পাশাপাশি, ইউএসডিপির সমর্থন পেলে অভ্যুত্থানের নেতা মিন অং হ্লাইংকে কেউ ঠেকাতে পাড়বে না বলেই মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।

সব মিলিয়ে বলা যায়, জান্তা প্রধানের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও ভবিষ্যৎ স্বপ্নপূরণে গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি হিসেবে ইউএসডিপি নিজেদের অবস্থান পোক্ত করে ফেলেছে।

ভোটে চীন-রাশিয়ার সমর্থন

সুচি'র সরকারের নেতা ও অন্যান্য বেসামরিক ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত ছায়া সরকার 'ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট', জান্তাবিরোধী সশস্ত্র সংগঠন ও সাধারণ মানুষ ইতোমধ্যে এই নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করেছে।

মান্দালায় অঞ্চলে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ। ফাইল ছবি: রয়টার্স
মান্দালায় অঞ্চলে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ। ফাইল ছবি: রয়টার্স

তাদের মতে, এই নির্বাচন সামরিক শাসনকে দীর্ঘায়ত করার অজুহাত। পশ্চিমের বেশ কয়েকটি দেশও তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়েছে।

তবে মিয়ানমারের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র চীন ও রাশিয়া এই ভোটে সায় দিয়েছে।

মিয়ানমারের জান্তাকে সহিংসতার অবসান ঘটিয়ে নির্বাচন আয়োজনের অনুরোধ জানিয়েছে আসিয়ান জোটের সভাপতি মালয়েশিয়া।

গত রোববার মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহামাদ হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, 'যে নির্বাচনে মিয়ানমারের সব মানুষ অংশ নিতে পারবে না, সে নির্বাচন আয়োজনের মানে হয় না।'

অপরদিকে, সরকারও এই নির্বাচনের বৈধতা আদায়ে উঠে পড়ে লেগেছে। এখন পর্যন্ত ৫৪টি দল নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অনুমতি পেয়েছে। তবে এই দলগুলোর মধ্যে ইউএসডিপির পাশাপাশি জান্তার অনুগত একাধিক দল আছে।

নির্বাচনের তিন মাস আগে আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু হবে বলে সংবাদ প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English

Uncertainty created as specific polls date has not been announced: Tarique

Tarique reiterated the demand that the national election be held by December

1h ago