আ. লীগের ১৬ বছরের শাসনামলে মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে কেন এই বেহাল দশা

যেখানে গণতন্ত্র থাকবে না সেখানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক।

টানতে টানতে টানতে সব শেষ হইয়া যায়…সব প্রশ্নের থাকে না অ্যানসার—সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই গানটি ছড়িয়ে পড়েছে। গানের ভিডিওতে দেখা যায়, আলোচিত-সমালোচিত নায়ক জায়েদ খান একটি মেয়ের পা ধরে টানছেন। আমার আলোচনা যেহেতু জায়েদ খানকে নিয়ে না, তাই সেদিকে না গিয়ে বরং আসল কথায় আসা যাক।

ওই গানের সুর ধরে বলতে চাই, 'কমত কমতে কমতে সব শেষ হইয়া যায়'। প্রশ্ন হলো কী 'শেষ হইয়া যায়'? সহজ উত্তর হলো গণমাধ্যমের স্বাধীনতা 'শেষ হইয়া যায়'।

জায়েদ খানকে গানে যেমন সেই মেয়ের পা ধরে টানতে দেখা গেছে, তেমনি গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে টানতে টানতে নামিয়ে আনা হয়েছে। গানটির মতোই গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকের অবনতির পেছনে যারা জড়িত তাদের কাছে কোনো 'অ্যানসার' বা উত্তর না থাকলেও আমাদের কাছে আছে।

সেসব উত্তর দেওয়ার আগে দেখে নেওয়া যাক গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানের একটি তুলামূলক চিত্র।

২০২৪ সালের সবশেষ মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৫তম, যা এ যাবত কালের মধ্যে সর্বনিম্ন। মূলত ২০০২ সাল থেকে মুক্ত গণমাধ্যম সূচক প্রকাশ করা হচ্ছে। ওই বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১৮তম যা ২০০৬ সালে ওই মেয়াদে বিএনপি সরকারের শেষ বছরে নেমে হয় ১৩৭তম।

আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায়। এই ১৫ বছরে মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ৪৪ ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ।

মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ২০০৯ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২১তম এবং ১০০ এর মধ্যে স্কোর ছিল ৪২ দশমিক ২; ২০২২ সালে ১৬২তম এবং স্কোর ৩৬ দশমিক ৬৩; ২০২৩ সালে ১৬৩তম এবং স্কোর ৩৫ দশমিক ৩১। চলতি বছর এই সূচক গতবছরের চেয়ে আরও দুই ধাপ কমেছে। এ বছর বাংলাদেশের স্কোর ২৭ দশমিক ৬৪।

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচক তৈরিতে আরএসএফ মূলত পাঁচটি বিষয় বিবেচনায় নেয়। সেগুলো হলো—রাজনৈতিক সূচক, অর্থনৈতিক সূচক, আইনি সূচক, সামাজিক সূচক ও নিরাপত্তা সূচক। গত বছরের তুলনায় পাঁচটি সূচকেই বাংলাদেশের অবনতি হয়েছে।

২০২৩ সালে রাজনৈতিক সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৩৯.০৬, এ বছর তা কমে হয়েছে ১৯.৩৬। অর্থনৈতিক সূচকে গতবছর স্কোর ছিল ৩৬.১১, এ বছর ২৭.৮৩। আইনি সূচকে গতবছর বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৩৫.২২, এ বছর ৩১.৩২। সামাজিক সূচকে গতবছর স্কোর ছিল ৩৬.৫৫, এ বছর ৩২.৬৫। নিরাপত্তা সূচকে গত বছরের চেয়ে ২.৫৭ পয়েন্ট পিছিয়ে এ বছর বাংলাদেশের স্কোর ২৭.০৩।

এই পাঁচটি সূচকের তথ্য বিশ্লেষণ করা দেখা যায়, গতবছরের তুলনায় রাজনৈতিক সূচকের স্কোরে বাংলাদেশের দ্বিগুণ অবনতি হয়েছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। শুধু গত এক বছরে না, ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর দেশের রাজনীতির অবস্থা কারও অজানা নয়। একদলীয় শাসনের অনেকগুলো লক্ষণ এখন দেখা যাচ্ছে। দেশে গণতন্ত্র আছে কি না, সর্বশেষ তিনটি জাতীয় নির্বাচনসহ অন্যা নির্বাচনগুলোর অবস্থা দেখলেই বুঝতে পারার কথা। যেখানে গণতন্ত্র থাকবে না সেখানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক।

আমরা যদি ২০২৪ সালের মুক্ত গণমাধ্যম সূচকের দিকে তাকাই, সেখানে দেখা যায় যে বাংলাদেশের নিচে রয়েছে সৌদি আরব, কিউবা, ইরাক, মিসর, মিয়ানমার, চীন, ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়া, আফগানিস্তান। এসব দেশে গণতন্ত্র নেই বললেই চলে। সুতরাং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে আগে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশে ভয়ের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এর ফলে লোকজন এখন নিজের অধিকার নিয়েও কথা বলতে ভয় পায়, সমালোচনা করা তো দূরের কথা।

গণমাধ্যম সূচকের এই অবনতির পেছনে যেসব কারণ রয়েছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সরকারের বিভিন্ন নীপিড়নমূলক আইন, দলীয় বিবেচনায় গণমাধ্যমের লাইসেন্স দেওয়া এবং গণমাধ্যমকে একটি ভয়ের মধ্যে রাখা। তবে, শুধু সরকারই এর পেছনে এককভাবে দায়ী, তা বলা যাবে না। গণমাধ্যমের মালিক, সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন এবং সাংবাদিক নেতাদের দায়ও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

গণমাধ্যমের লাইসেন্স পেতে আবেদনকারীর রাজনৈতিক পরিচয়ই প্রধান বিবেচনার বিষয় হয়ে যায়। এর পাশাপাশি যেসব করপোরেট প্রতিষ্ঠান গণমাধ্যমের লাইসেন্স পান, তারা গণমাধ্যমকে যতটা গণমানুষের স্বার্থে ব্যবহার করেন, তারচেয়ে বেশি ব্যবহার করেন তাদের স্বার্থ রক্ষায়।

আমাদের সাংবাদিক সংগঠনের নেতারা রাজনৈতিক দলগুলোর স্তুতি করতে করতে একবারেই নিকৃষ্ট পর্যায়ে পৌঁছেছেন। এই নেতারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলে ব্যস্ত। ফলে দেখা যায় কেউ সরকারি প্লট পাচ্ছেন, কেউ সরকারি টাকায় বিদেশে সফর করছেন, এমন কি কেউ কেউ সংসদে যাওয়ার চেষ্টা করছেন বা যাচ্ছেন। এসব সুবিধা আদায়ে তারা এখন অনেকটাই রাজনৈতিক দলের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছেন।

প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে সাংবাদিকতায় কি পরিবর্তন আসবে না? এর উত্তর হলো, আসতে পারে। তবে সহসাই সেই সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এই পেশাটিকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে ভালোবেসে সাংবাদিকতায় আসা তরুণের সংখ্যা বর্তমানে অনেক কম। যারা এই পেশায় আছেন, তারাও সুযোগ বুঝে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। এই পেশায় নিরাপত্তা বলতে তেমন কিছুই নেই। মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের নিরাপত্তার স্কোর বর্তমানে ২৭.০৩। মুক্তগণমাধ্যম সূচকে সবার উপরে থাকা নরওয়েতে নিরাপত্তা সূচকের স্কোর ৯৪.৭৪, যার সঙ্গে বাংলাদেশের স্কোরের পার্থক্য আকাশ-পাতাল।

মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের উন্নতি করতে চাইলে সবার আগে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দেশের গণমাধ্যমগুলোকে গণমানুষের হয়ে কথা বলতে হবে। কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি না করে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশ করতে হবে। সাংবাদিকদের লোভ-লালসা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। রাষ্ট্রের নীপিড়নমূলক আইনগুলো দূর করতে হবে।

সুমন আলী: শিক্ষার্থী, কমিউনিকেশন স্টাডিজ বিভাগ, বল স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র

Comments

The Daily Star  | English

15pc VAT on Metro Rail: Quader requests PM to reconsider NBR’s decision

Dhaka is one of the most unliveable cities in the world, which does not go hand-in-hand with the progress made by the country, says the road transport and bridges minister

1h ago