২৬৬ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ

দেশে সাংবাদিকদের হামলা-মামলা করে হয়রানির যে পুরোনো সংস্কৃতি ছিল তাতে কোনো পরিবর্তন হয়নি। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন রূপ পেয়েছে এই দমন-পীড়ন। অর্থাৎ এ ধরনের ঘটনায় জড়িতদের শুধু পরিচয় পাল্টেছে।

গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাংবাদিকদের হয়রানির প্রধান অস্ত্র ছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ)। তবে এখন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বেশিরভাগ মামলাই হচ্ছে হত্যা ও হামলার অভিযোগে।

অভ্যুত্থানের সময়ের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গত কয়েক মাস ধরে যেসব মামলা হয়েছে সেগুলোতে অনেক সাংবাদিককে জড়ানো হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরাও যে প্রশ্নের উত্তর দিতে হিমশিম খাচ্ছেন তা হলো: সাংবাদিকতা কি হত্যায় প্ররোচনা দিতে পারে?

মিডিয়া সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছেন, '২৬ জুলাই শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনে কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক তাকে ছাত্র আন্দোলন আরও কঠোর হাতে দমনে উৎসাহ দেন। এটা স্পষ্ট যে তারা সাংবাদিক হিসেবে নয়, বরং রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে কাজ করছিলেন।'

তবে সাংবাদিকতাকে হত্যার সঙ্গে যুক্ত করার প্রশ্নটি আরও জটিল হয়ে ওঠে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে যারা কাজ করেন তাদের বেলায়। এমনিতেই বিভিন্ন ধরনের চাপের মুখে থাকতে হয় স্থানীয় সাংবাদিকদেরকে।

গত কয়েকমাসে সাংবাদিকদের ওপর মামলার একটি তালিকা করেছে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ)। সেই সঙ্গে ডেইলি স্টারের নিজস্ব তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে গত বছরের জুলাই ও আগস্টের ঘটনা-সম্পর্কিত বিভিন্ন মামলায় কমপক্ষে ২৬৬ জন সাংবাদিককে জড়ানো হয়েছে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ঢাকায় - ৮৮টি। সিলেট ও চট্টগ্রামে যথাক্রমে ৩৯ এবং ৩৬ জন সাংবাদিককে অভিযুক্ত করা হয়েছে। সাভার, নারায়ণগঞ্জ, কুষ্টিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং বগুড়ায় ১০ থেকে ২০ জন করে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এছাড়া কক্সবাজার, খুলনা, লক্ষ্মীপুর, বরগুনা, নড়াইল, পটুয়াখালী, ঠাকুরগাঁও, বরিশাল, মুন্সিগঞ্জ, বাগেরহাট, যশোর, পিরোজপুর এবং নেত্রকোনা সহ অন্যান্য জেলাগুলোতেও সাংবাদিকরা জুলাই-আগস্টের সহিংসতা সম্পর্কিত হত্যা বা অন্যান্য মামলায় আসামি হয়েছেন।

এসব মামলায় যে সাংবাদিকরা আসামি হয়েছেন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাদের প্রকাশ্য সংশ্লিষ্টতা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে ডেইলি স্টার, যা থেকে বোঝা যেতে পারে যে সাংবাদিকতার বাইরে অন্য কোনো কারণে তাদের আসামি করা হয়েছে কিনা।

অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়, নারায়ণগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের অনুসারীরা যখন ছাত্রদের উপর গুলি চালাচ্ছিল, তখন একটি ভিডিওতে দেখা যায় যে ওই দুইজন জেলা সংবাদদাতা তার সঙ্গে একটি মিছিলে ছিলেন। একজন সাংবাদিককে দুই হাতে দুটি আগ্নেয়াস্ত্র বহন করতেও দেখা গেছে ওই ভিডিওতে।

মামলাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিভিন্ন আসামি হওয়া সাংবাদিকদের মধ্যে মাত্র ১৮ শতাংশের—সংখ্যায় যা প্রায় ৫০—সরাসরি রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা বা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সুবিধাভোগী ছিলেন। এর বাইরে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিশোধমূলক কারণে সাংবাদিকদেরকে আসামি করা হয়েছে।

সিলেটে যুক্তরাজ্যের একজন প্রবাসী ও দৈনিক সময়ের আলোর যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি মনোয়ার জাহান চৌধুরীকে একটি মামলায় আসামি করা হয়েছে, যদিও কয়েক বছর আগেই যুক্তরাজ্যে চলে গেছেন তিনি। সেখানে খেলাফত মজলিসের সাবেক সাধারণ সম্পাদক খলিলুর রহমান গত বছরের ২৭ আগস্ট কোতোয়ালি থানায় নয়জন সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন। বর্তমানে পিবিআই মামলাটি তদন্ত করছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কেবল জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘটনার জন্যই নয়, ২০২১ সালের ২৬ মার্চ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ নিয়েও প্রতিশোধমূলক মামলা দায়ের করা হয়েছে। এই জেলায় মোট ১৬ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে এবং অন্তত দুইজন সাংবাদিক, যারা দুটি জাতীয় দৈনিকে কাজ করেন, মামলার কারণে তাদের চাকরি হারিয়েছেন।

গত ২৪ নভেম্বর, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ঢাকা ট্রিবিউনের খুলনা সংবাদদাতা মো. হেদায়েত হোসেনসহ ১৪ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এক বালককে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করে হত্যার অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়।

এজাহারে বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী রাকিবুল হাসান গত ৫ আগস্ট বিক্ষোভের সময় বাঁশের খুঁটির সঙ্গে বাঁধা একটি পতাকা উত্তোলন করতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন। আসামিরা ইচ্ছাকৃতভাবে তারে সংযোগ দেওয়ায় তিনি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন। হেদায়েত এর আগে ২০১৮ সালে নির্বাচন নিয়ে রিপোর্টিংয়ের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এবং দুই বছর মামলা লড়েছেন। তিনি জানান, আগের সরকারের সময়ের মতো এবারও তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার।

তার ভাষ্য, ফেডারেল ইউনিয়ন অফ জার্নালিস্টসের সদস্য হওয়ার কারণে তার নাম দেওয়া হয়েছে। রাকিবুলের বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, এই মামলা সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। সরকারি সহায়তার কথা বলে সাদা কাগজে তার স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে। আরও উদ্বেগজনক হলো, রাকিবুলের মৃত্যুর একই সময়ে আশুলিয়ায় ঘটা অন্য একটি মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের করা অন্য একটি মামলাতেও তার নাম দেওয়া হয়েছে, যদিও হেদায়েত খুলনার বাসিন্দা। তিনি প্রশ্ন তোলেন, 'উভয় মামলাতেই একই প্রত্যক্ষদর্শীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী কীভাবে একই সময়ে আশুলিয়া এবং পাইকগাছাতে থাকতে পারেন?'

বিভিন্ন সময়ে কমপক্ষে ১৪ জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ১৩ জন এখনও কারাগারে আছেন।

এছাড়া, জিটিভির কুয়াকাটা সংবাদদাতা মনিরুল ইসলাম বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের একটি মামলায় ১৬ দিন জেলে ছিলেন। তিনি জানান, ৪ আগস্টের একটি ঘটনার মামলায় তাকে জড়ানো হয় যখন তিনি ঢাকায় ছিলেন এবং তার কাছে সেই প্রমাণও ছিল। আদালতে আত্মসমর্পণ করলেও তার প্রমাণ আমলে না নিয়ে তাকে জেলে পাঠানো হয়। তিনি এখন মামলাটি নিয়ে বেশি মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছেন, কারণ তিনি আরও হয়রানির আশঙ্কা করছেন এবং চাকরি হারানোর ভয়ে জেলা ছাড়তে পারছেন না।

সাংবাদিক কামাল আহমেদ মনে করেন, স্থানীয় পর্যায়ে সাংবাদিকদের টার্গেট করার অন্যতম কারণ হলো তাদের অনেকেরই ব্যবসা বা অন্য কাজ রয়েছে। তিনি বলেন, এই সাজানো হত্যা মামলাগুলো আসলে পুরোনো শত্রুতা বা রাজনৈতিক রেষারেষির ফল। তার মতে, এই মামলাগুলোর পেছনের আসল কারণ খুঁজে বের করার জন্য স্বাধীন তদন্ত প্রয়োজন এবং এটা পুলিশের মাধ্যমে হতে পারে না।

সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কেন হত্যা মামলা দায়ের করা হচ্ছে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তারা (সাংবাদিকরা) হয়তো সরাসরি জড়িত নন, তবে তাদের বক্তব্যের মাধ্যমে সাহায্য ও উস্কানি দিয়েছেন।' তবে প্রশ্ন ওঠে: অভিযুক্ত সাংবাদিকদের মধ্যে কতজনের, বিশেষ করে রাজধানীর বাইরের, এমন প্রভাব ছিল যা আওয়ামী লীগের ক্যাডার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল? সাংবাদিক কামাল আহমেদ দৃঢ়ভাবে বলেন, এই মামলাগুলো নিঃসন্দেহে সাজানো এবং হত্যা মামলাগুলো সব অভিযোগই মিথ্যা। তার ভাষ্য, বাংলাদেশে এমন কোনো নির্দিষ্ট আইন নেই যা সাংবাদিকতাকে ব্যবহার করে হত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার জন্য একজন সাংবাদিককে বিচার করতে পারে।

সাংবাদিকদের ওপর এই ঢালাও মামলা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। জানুয়ারিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে তারা এটিকে 'হাসিনা প্রশাসনের পরিচিত দমন-পীড়নের ধারার পুনরাবৃত্তি' বলেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত গুরুতর অপরাধে যারা নির্দেশ, সহায়তা ও উস্কানি দিয়েছে, তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা জরুরি। তবে বিক্ষোভকারীদের সমর্থন না করার জন্য সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে গণহারে মামলা অন্তর্বর্তী সরকারের এই সময়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য একটি বিপজ্জনক বার্তা দেয়।

আইনি হয়রানির বাইরেও সাংবাদিকদের ওপর শারীরিক হামলার ঘটনাও ঘটছে। দ্য ডেইলি স্টার যাদের সাথে কথা বলেছে সেই সকল সাংবাদিক জানিয়েছেন যে তারা মব হামলার ভয় পাচ্ছেন, যে ধরনের হামলার কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না।

নাটোর, বরিশাল, পটুয়াখালী, শরীয়তপুর এবং ঢাকায় সাতটি পৃথক ঘটনায় কমপক্ষে ২৮ জন সাংবাদিকের ওপর হামলা হয়েছে।

ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের প্রাক্তন সাংবাদিক ওমর ফারুক ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি ভাঙার ঘটনার সংবাদ সংগ্রহের সময় আক্রান্ত হন।

ফারুক জানান, 'আমি লাইভে ছিলাম। শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে জনরোষের কথা বলছিলাম। আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে বোঝাতে 'বঙ্গবন্ধু' শব্দটি ব্যবহার করেছিলাম। এমনকি সেখানে জাদুঘরটিও বঙ্গবন্ধু জাদুঘর নামে পরিচিত ছিল। এই শব্দটি ব্যবহার করার কারণে মব আমাকে ঘিরে ধরে মারধর করে।'

ফারুক জানান তিনি ওই ঘটনায় থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করলেও তদন্তের অগ্রগতির ব্যাপারে কোনো খবর পাননি। তিনি বলেন, 'বিচার পাওয়ার আশা নেই। মব সৃষ্টিকারীরা জানে যে সাংবাদিককে মারধরে তাদের কোনো শাস্তি হবে না।'

১৪ ফেব্রুয়ারি আরএসএফ (রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস) দক্ষিণ এশিয়া ডেস্কের প্রধান সিলিয়া মার্সিয়ের এক রিপোর্টে গণমাধ্যমের উপর সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার চিত্র উঠে আসে।

তিনি বলেন, 'অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিস্থিতির উন্নতির আশা তৈরি হলেও সাংবাদিকরা এখন নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছেন। সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে তারা আক্রান্ত হচ্ছেন। তাদের লেখার জন্য আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। গণমাধ্যমের অফিসের বার্তাকক্ষে পর্যন্ত হামলা করা হচ্ছে।'

এসব হামলার জন্য দায়ীদের বিচার করা, সহিংসতার এই পুনরাবৃত্তি বন্ধ করা, এবং গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে আরএসএফ।

Comments

The Daily Star  | English

Sagar-Runi murder: Inconclusive DNA test results stall probe

The task force investigating the 2012 murders of journalist couple Sagar Sarowar and Meherun Runi in its report submitted to the High Court last month said it required more time to complete the probe as the results of the DNA samples collected from the scene were inconclusive.

6h ago