নতুন বাংলাদেশে আদিবাসী প্রতিনিধিত্বের সুযোগ প্রয়োজন

ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জন করেছে। কিন্তু এই নতুন বাংলাদেশে কি আদিবাসীদের আত্মপরিচয় ও মানবাধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হবে? কোনো আদিবাসী নেতা কি ক্ষমতা কাঠামোতে সত্যিকারের প্রতিনিধিত্বের সুযোগ পাবে? আদিবাসীরা তাদের আত্মপরিচয়, ভূমির অধিকার এবং তাদের প্রতি ঘটে যাওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার সুযোগ পাবেন? আদিবাসীদের মনে আবারো এইসব প্রশ্ন যেন ঘুরপাক খাচ্ছে।
ফাইল ছবি

ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জন করেছে। কিন্তু এই নতুন বাংলাদেশে কি আদিবাসীদের আত্মপরিচয় ও মানবাধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হবে? কোনো আদিবাসী নেতা কি ক্ষমতা কাঠামোতে সত্যিকারের প্রতিনিধিত্বের সুযোগ পাবে? আদিবাসীরা তাদের আত্মপরিচয়, ভূমির অধিকার এবং তাদের প্রতি ঘটে যাওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার সুযোগ পাবেন? আদিবাসীদের মনে আবারো এইসব প্রশ্ন যেন ঘুরপাক খাচ্ছে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েও আদিবাসীরা তাদের অধিকার পায়নি। ক্ষমতা কাঠামোতে কখনো প্রতিনিধিত্বেরও সুযোগ পায়নি। বরং যত দিন গেছে তাদের অধিকার খর্ব করা হয়েছে, বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ করে করা হয়েছে। অতীতের সবগুলো সরকার আদিবাসীদের দমিয়ে রেখে নানা ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ করে গেছে।

গণঅভ্যুত্থানের পর পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতল অঞ্চল থেকে যোগ্য একজন আদিবাসী প্রতিনিধি রাখার দাবি উঠে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে আদিবাসী প্রতিনিধি হিসেবে জায়গা পান পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রদূত সুপ্রদীপ চাকমা। কিন্তু তাকে আদিবাসীদের প্রতিনিধি হিসেবে মানতে অনেকেই অপারগতা প্রকাশ করেছেন। এ বিষয়ে চাকমা রানী ইয়ান ইয়ান সহ অনেক আদিবাসী নেতা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে প্রতিবাদ করেছেন। আসলে কোনো সরকারই চায়নি আদিবাসীদের যোগ্য প্রতিনিধি ক্ষমতা কাঠামোর ভিতরে আসুক। বিভিন্ন সময়ে যেসব আদিবাসী প্রতিনিধিত্বের সুযোগ পেয়েছেন তারা প্রত্যেকেই সরকারের খুব অনুগত ছিলেন। আদিবাসীদের মূল দাবিগুলো পূরণে তাদের কোনো ভূমিকা দেখা যায়নি। পুতুলের মতো তারা শুধু সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছেন। ফলে আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও সমতলের আদিবাসীদের ভূমি কমিশন গঠনে কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি।

বঞ্চনার শিকার সমতলের আদিবাসীরা আন্দোলন সংগ্রাম করতে কখনো পিছপা হয়নি। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কাঠামোর মধ্যে প্রবেশ করতে না পারলেও তারা গণসংগঠন তৈরি করে নিজেদের ন্যায্য দাবিগুলো সবার সামনে তুলে ধরেছেন। আদিবাসী এমপিরা সংসদে তাদের সম্প্রদায়ের দুঃখ-কষ্ট-বঞ্চনার কথা সংসদে উত্থাপন করেছেন। কিন্তু তাদের ভাগ্য পরিবর্তন হয়নি। সর্বশেষ ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে সমতলের কোনো আদিবাসী এমপি হতে পারেননি।

তবে ১৯৯৬ সাল বাদ দিয়ে ১৯৯১ থেকে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ময়মনসিংহ-১ সংসদীয় আসন থেকে প্রমোদ মানকিন ও তার ছেলে জুয়েল আরেং আওয়ামী লীগ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়লাভ করেছিলেন। সর্বশেষ নির্বাচনে জুয়েল আরেং আওয়ামী লীগের প্রার্থী থাকলেও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হেরে যান। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) এর প্রার্থী হিসেবে নওগাঁ-১ আসন থেকে নির্বাচন করেন মঙ্গল কিস্কু। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী হিসেবে ২০১৪ সালে দিনাজপুর-৬ সংসদীয় আসন থেকে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের প্রয়াত সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ও ১৯৯১ সালে মন্ডল সরেন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং ২০০১ সালে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সাবেক সভাপতি অনিল মারান্ডী নওগাঁ-১ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে নাটোর-৪ সংসদীয় আসন থেকে জেলা জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সাবেক সভাপতি রমানাথ মাহাতো বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ১৯৯৬ সালে গণফোরামের প্রার্থী হিসেবে ভোলানাথ মাঝি (হাঁসদা) রাজশাহী-১ আসন থেকে নির্বাচন করেন। এছাড়াও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে রাজশাহী-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রথম সাঁওতাল অ্যাডভোকেট প্রভাত টুডু ও সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়ন চেয়েছিলেন উন্নয়নকর্মী সারা মারান্ডী।

সমতল তথা উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের আদিবাসীদের অন্যতম গণসংগঠন হচ্ছে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ। এই সংগঠনটি ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে বড় বড় আন্দোলন করেছে। আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ও স্বাধীন ভূমি কমিশন গঠন, আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদান এই ধরনের দাবিগুলোকে জনপ্রিয় ও সরকারের কাছে তুলে ধরার ক্ষেত্রে এই সংগঠনটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। তবে এই সংগঠনের প্রয়াত সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন মারা যাওয়ার পর থেকে সংগঠনটি নেতৃত্ব সংকটে ভুগছে। এছাড়াও আদিবাসী মুক্তিমোর্চা, উত্তরবঙ্গ আদিবাসী ফোরাম, আদিবাসী ইউনিয়ন এর মতো সংগঠনগুলো এখনো আদিবাসীদের কাছেই ব্যাপক পরিচিতি লাভ করতে পারেনি।

আদিবাসী সংগঠনগুলোর মধ্যে নেতৃত্ব সংকট তাদের অধিকারের আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে। আদিবাসী নেতৃত্ব গড়ে না ওঠার পেছনেও অনেক কারণ আছে। অতীতের সকল সরকার চেয়েছে আদিবাসীদের শুধু ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করতে এবং তাদের মধ্যে নিজদের মধ্যে কলহ বজায় রেখে তাদের আন্দোলনবিমুখ করে রাখতে। আবার রাজনৈতিক দলগুলো আদিবাসী সংগঠনগুলোকে নিজেদের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। যখন আদিবাসী সংগঠনগুলো এসব বুঝতে পেরেছে তখন তারা আদিবাসী সংগঠনগুলোকে বিভক্ত করেছে। সুশীল সমাজ ও উন্নয়ন সংগঠনগুলোর মধ্যে থেকেও কেউ কেউ আদিবাসী আন্দোলনকে সহযোগিতার নামে তাদের উপর কর্তৃত্ব বজায় রেখেছে। কেউ তাদের মতো না চললে তাদেরকে তারা নানাভাবে অপদস্থ ও অসহযোগিতা করেছে। আমরা অনেক উন্নয়ন সংগঠনকে দেখেছি আদিবাসী গ্রাম থেকে তাদের পথচলা শুরু হয়েছে, অনেক রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দেখেছি প্রথমে তারা আদিবাসীদের অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাদের নেতৃত্বের পথচলা শুরু করেছে কিন্তু পরবর্তীতে তারা আদিবাসীদের দিকে সেভাবে ঘুরে তাকায়নি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ছাত্র সমাজ ও সাধারণ জনতার ঐক্যবদ্ধ গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে এবং তাদের অধীনে পরবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসীন হবে সেখানেও কি কোন আদিবাসী নেতৃত্ব প্রতিনিধিত্বের সুযোগ পাবে? অনেকে বলতে পারেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে পাহাড়ের একজনকে উপদেষ্টা হিসেবে রাখা হয়েছে। আবার অতীতেও যদি দেখি সমতল অঞ্চল থেকে আদিবাসীদের মধ্যে থেকে প্রমোদ মানকিন ও তার ছেলে জুয়েল আরেং আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হিসেবে ছিলেন। তিন পার্বত্য জেলাতেও তিনজন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হিসেবে ছিলেন, বিএনপির সংসদ সদস্যও ছিলেন এবং পাহাড়ের রাজনৈতিক দল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি থেকেও স্বতন্ত্র ভাবে সংসদ সদস্য হিসেবে ছিলেন। সংরক্ষিত নারী আসন থেকেও সংসদ সদস্য ছিলেন। তবে স্বাধীন বাংলাদেশে যেসব আদিবাসী নেতা জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বের সুযোগ পেয়েছিলেন তারা কেউ আদিবাসী জনসাধারণের মৌলিক দাবিগুলো উচ্চারণের সুযোগ পাননি। দলীয় লেজুড়বৃত্তি করেই তাদের সময় পার হয়েছে। তাই তাদেরকে সত্যিকার অর্থে আদিবাসীদের প্রতিনিধি বলার কোনো কারণ আমরা দেখিনি। তবে স্বতন্ত্রভাবে যারা প্রতিনিধিত্বের সুযোগ পেয়েছিলেন তাদেরকে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছিল, কোন কাজ করতে দেওয়া হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সরকারে পাহাড়ের জনমানুষের নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ক্ষোভে সংসদ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অর্জিত নতুন বাংলাদেশে আদিবাসীদের প্রতি যেসব বৈষম্য করা হয়েছে সেসবের বিলোপ হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। নতুন বাংলাদেশের সংস্কার ও উন্নয়নে আদিবাসীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে খুব দ্রুত সমতল ও পাহাড়ের আদিবাসী নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসে আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার পথকে সুপ্রশস্ত করার আহ্বান জানাচ্ছি এবং আদিবাসী সকল সংগঠনগুলোকে তাদের ভুল শুধরে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছি।

মানিক সরেন
তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক
জাতীয় আদিবাসী পরিষদ।
ই-মেইল: [email protected]

Comments