হত্যাকারী চিহ্নিত হোক
মধ্য জুলাই থেকেই আমরা এক ধরনের প্রচণ্ড মানসিক আঘাতের মধ্যে রয়েছি। গুলি, হত্যা, রক্তপাত, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগসহ চারদিকের নিদারুণ সব নিষ্ঠুরতা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। এ ছাড়া স্বৈরাচার শেখ হাসিনার শাসন-পরবর্তী বাংলাদেশে অনেকেই যেমন নতুন দিনের স্বপ্ন দেখছেন, ঠিক তেমনি অনেকের জীবনে তৈরি হয়েছে অনাকাঙ্ক্ষিত অনিশ্চয়তা। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ নেতা, সমর্থক ও অলিগার্কদের প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের আকাশে এখন অনিশ্চয়তার কালো মেঘ। যা অনেকের নিত্যদিনের হিসাব-নিকাশকে কঠিন করে তুলেছে।
নতুন বাংলাদেশে ২৮ আগস্ট সকালে এমনই এক মৃত্যু নেটিজেনদের আচ্ছন্ন করে। ঘুম থেকে উঠেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাংবাদিক রাহনুমা সারাহর অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবরটি জানতে পারি। এত অল্প বয়সী, তরতাজা একটি নারী পানিতে তলিয়ে গেল! হাতিরঝিলের শীতল জলে মিশে গেল মেয়েটির শেষনিশ্বাস। অনেকক্ষণ রাহনুমা সারাহর কয়েকটি ছবি দেখলাম। কেন যেন খুবই পরিচিত মনে হচ্ছিল। পরে জানলাম, তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহকর্মী রাবিতা সাবাহর বোন। রাবিতা সাবাহ ও আমার বিভাগ একই ভবনে। সেই কারণে চেহারাটা বেশি পরিচিত মনে হচ্ছিল।
রাহনুমা সারাহর মতো তরুণ একজন সাংবাদিক, তাজা একটি প্রাণ কেন ঝরে পড়ল, তা পুরোপুরি জানতে সময় লাগবে। কিন্তু যতটুকু জানা যায়, রাহনুমা সারাহকে তার পেশাগত অনিশ্চয়তা আচ্ছন্ন করেছিল। কর্মস্থল স্যাটেলাইট টেলিভিশন জি টিভিতে মাসের বেতন অনিয়মিত হয়ে পড়েছিল। চাকরি নিয়ে ছিল অনিশ্চয়তা। রাহনুমা সারাহর বোন স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, চাকরির স্থায়িত্ব ও পরের কর্মস্থল নিয়ে রাহনুমা দুশ্চিন্তায় ছিলেন। এ ছাড়া কাজের চাপ ছিল প্রচণ্ড। এই পরিস্থিতি রাহনুমাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছিল। এর সঙ্গে হয়তো যোগ হয়েছিল রাহনুমার একান্ত ব্যক্তিগত জীবনের কিছু জটিলতা।
হঠাৎ ঝরে পড়া রাহনুমা সারাহ সম্পর্কে জানতে তার ফেসবুক ওয়ালে দৃষ্টি দিয়েছিলাম। ২৮ আগস্ট তিনি আপলোড করেছেন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের স্থিরচিত্র। হাসিখুশি, বিজয়ী বেশ। তার আগে ফেসবুকে সক্রিয় ছিলেন নিজের জন্মস্থান নোয়াখালীর বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে। মানুষের দুঃখ, দুর্দশায় উদ্বিগ্ন রাহনুমা চেষ্টা করছিলেন দুর্গতদের পাশে দাঁড়াতে। তবে তার আগের দুটি স্ট্যাটাস খুবই ইঙ্গিত বহন করে। তিনি ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন ঢাকা শহরের বাড়ি ভাড়া নিয়ে।
ওই দিনই লিখেছেন, 'প্রতিদিন এতো আন্দোলন কাভার করতে গিয়ে শুধুমাত্র সাধারণ সাংবাদিকরাই তাদের ন্যায্য পাওনা, বেতন-ভাতা ইত্যাদি নিয়ে আন্দোলনে নামার টাইম পাচ্ছে না! আমাদের কাজ শুধু নিউজ কাভার করা। পেটে ভাত না জুটলেও চলবে।' রাহনুমার এই মন্তব্যটি আমলে নেওয়া প্রয়োজন। যত দূর জানা যায়, রাহনুমার কর্মস্থল জিটিভিতে বেতন হচ্ছিল না। প্রতিষ্ঠানটির আওয়ামী অলিগার্ক মালিক জেলে। তার সম্পদ লুটপাট হচ্ছে, পুড়ে গেছে হাজার কোটি টাকার কারখানা। সার্বিকভাবে রাহনুমার হতাশাগ্রস্ত হওয়া খুব স্বাভাবিক।
আমার ধারণা রাহনুমার মৃত্যুর পেছনে পেশাগত অনিশ্চয়তা একটা বড় নিয়ামক। যুক্ত থাকতে পারে ব্যক্তিজীবনের টানাপোড়েনও। তবে তারপরও একজন তরুণ সাংবাদিকের এভাবে চলে যাওয়া মেনে নেওয়া যায় না। রাহনুমা তার ফেসবুক প্রোফাইলে শেষ ছবি যুক্ত করেছেন একটি ইঙ্গিতপূর্ণ বাণী দিয়ে। তাতে ছিল, বিদায়ের বার্তা 'চলে যাওয়ার সময়'। কিন্তু রাহনুমার পরিবার, স্বজন ও সহকর্মীরা নিশ্চিতভাবেই জানেন এটা তার চলে যাওয়ার সময় নয়। হয়তো প্রবল মানসিক চাপ ও পেশাগত অনিশ্চয়তার কারণেই তিনি আগেভাগে বিদায় বলতে বাধ্য হয়েছেন। যা কাম্য হতে পারে না।
রাহনুমার মৃত্যুর কারণ এখনো নিশ্চিত নয়। আত্মহত্যা নয়, এটা হত্যাও হতে পারে। তবে এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, প্রতিটি আত্মহত্যা নিশ্চিতভাবেই এক ধরনের হত্যাকাণ্ড। আত্মহত্যায় হত্যাকারীরা থাকেন কালো ছায়া হয়ে। তাদের দেখা যায়, কিন্তু ধরা যায় না। রাহনুমা সারাহর হত্যাকারী চিহ্নিত হোক।
রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
Comments