পিটিয়ে খুন, কবরে আগুন

সবশেষ দেশের দুটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুজন মানুষকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা নিয়ে নানাবিধ সমালোচনা হচ্ছে। খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কীভাবে দুজন মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করলেন তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন নাগরিকরা।

গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের পতন এবং শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে এমন সব ঘটনা ঘটছে, যা এই অভ্যুত্থানের সাফল্য ম্লান করে দিচ্ছে। অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য নিয়েও জনমনে প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে।

সবশেষ দেশের দুটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুজন মানুষকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা নিয়ে নানাবিধ সমালোচনা হচ্ছে। খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কীভাবে দুজন মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করলেন তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন নাগরিকরা। পরিতাপের বিষয় হলো, নিহত দুজনের মধ্যে একজন মানসিক ভারসাম্যহীন।

গণমাধ্যমের খবর বলছে, বুধবার বিকেলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লাকে বেদম মারধর করেন কিছু শিক্ষার্থী। গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে ভর্তি করা হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সেখানে তার মৃত্যু হয়।

নিহত শামীম মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ, গত ১৫ জুলাই রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে অবস্থানরত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ ও বহিরাগত সন্ত্রাসীদের হামলায় তিনি যুক্ত ছিলেন।

একইদিন চোর সন্দেহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে আটকে রেখে তোফাজ্জল নামে এক যুবকককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। জানা গেছে তিনি বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠালতলী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। তবে গত চার/পাঁচ বছর ধরে মানসিক ভরসাম্যহীন ছিলেন।

কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর বরাতে একটি অনলাইন পোর্টালের খবরে বলা হয়েছে, বুধবার সন্ধ্যায় চোর সন্দেহে তোফাজ্জলকে আটকের পর তাকে গেস্টরুমে নিয়ে যান শিক্ষার্থীরা। সেখানে রাত ১০টা পর্যন্ত দফায় দফায় মারধর করা হয়।

অথচ কয়েক দিন আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হল এবং বিজয় ৭১ হলকে গণরুম ও গেস্টরুমমুক্ত ঘোষণা করা হয়। আর যেদিন মানসিক ভারসাম্যহীন তোফাজ্জলকে মেরে ফেলা হলো, সেদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাসে বহিরাগত প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে একটি নির্দেশনা জারি করে। যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ, যেখানে সারা দিনই যানবাহন চলে, নানা শ্রেণিপেশার মানুষ চলাচল করেন, সেখানে বহিরাগত বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে এবং সেখানে চলাচলে বিধিনিষেধ বলতে কী বোঝানে হয়েছে, তা পরিষ্কার নয়। নির্দেশনাটি শুধুমাত্র আবাসিক হলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলে যৌক্তিত হতো। সেটি অন্য প্রসঙ্গ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দুটি ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, 'তারা তো (শিক্ষার্থী) সবচেয়ে শিক্ষিত। একজন অপরাধ করলে তাকে আইনের হাতে সোপর্দ করবেন। আইন তো নিজের হাতে তুলে নেওয়ার কারও অধিকার নেই। কেউ যেন আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়। অপরাধী হলেও ওই ব্যক্তিকে আইনের হাতে তুলে দিতে হবে।'

গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে পিটিয়ে হত্যার যে প্রবণতা শুরু হয়েছে, তাতে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে আরও কিছু ঘটনা ঘটেছে। যেমন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে হামলার অভিযোগে গত ৭ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে আব্দুল্লাহ আল মাসুদ নামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। নিহত হওয়ার চার দিন আগেই তিনি একটি মেয়ে সন্তানের বাবা হয়েছিলেন।

গণমাধ্যমের খবর বলছে, মাসুদ দীর্ঘ দিন বেকার থাকার পর নিজের দুর্দশার কথা জানিয়ে ২০২২ সালের শেষের দিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিতে একটি চাকরির ব্যবস্থা করার অনুরোধ করেন।

কাছাকাছি সময়ে বরিশালের গৌরনদীতেও রাশেদ সিকদার নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় দায়ের করা মামলার প্রধান আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এর আগে খুলনায় মহানবীকে (স.) কটূক্তি করার অভিযোগে এক তরুণকে পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে উৎসব মণ্ডল নামে এক যুবককে গণপিটুনি দেওয়া হয়। একটি জাতীয় দৈনিকের খবরে প্রথমে তার মৃত্যু হয়েছে বলে জানানো হলেও পরে বলা হয় যে, তিনি বেঁচে আছেন।

পিটিয়ে মারার এই প্রবণতা আজকের নয়। গত বছরের জুন মাসের মাঝামাঝি জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলায় সাংবাদিক গোলাম রব্বানি নাদিমকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। তখন একে 'বিচ্ছিন্ন ঘটনা' বলে দাবি করেছিলেন তৎকালীন পুলিশ সুপার নাছির উদ্দিন আহমেদ। সাংবাদিক নাদিম ৭১ টেলিভিশনের স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন।

এর আগে ২০১৯ সালের ২০ জুলাই দেশের বিভিন্ন স্থানে ছেলেধরা সন্দেহে অন্তত পাঁচজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়, যাদের মধ্যে দুজন ছিলেন নারী।

প্রশ্ন হলো কেন এমনটি হয়? মানুষ কেন আইন নিজের হাতে তুলে নেয়? সে আসলে কার বিরুদ্ধে কীসের প্রতিশোধ নেয়? আইনের শাসনের অভাব কিংবা প্রচলিত বিচারব্যবস্থার প্রতি তার আস্থা নেই নাকি সে অন্য কারণে ক্ষুব্ধ যা অন্য কোনো ঘটনার দ্বারা সেই ক্ষোভ প্রশমিত করতে চায়?

এইসব ঘটনার প্রেক্ষিতে ইদানীং কেউ কেউ বর্তমান পরিস্থিতিকে 'মবের মুল্লুক' বলে অভিহিত করছেন। মবের মুল্লুকে পিটিয়ে হত্যার কালে বিভীষিকাময় আরেকটি ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামে। গত ১৭ সেপ্টেম্বর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) নেতা ও চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখলী-চান্দগাও) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মইন উদ্দীন খান বাদলের কবরে ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। গণমাধ্যমের খবরে হামলাকারীদের 'দুর্বৃত্ত' হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়েছে।

বাদলের স্ত্রী সেলিনা খান ডেইলি স্টারকে বলেছেন, 'একটি মেরুন রঙের গাড়ি নিয়ে এসে কয়েকজন দুর্বৃত্ত কবরের ওপরের গাছ, ফটক ও নামফলক ভাঙচুর করে। এরপর কবরের ওপরে আগুন ধরিয়ে দিয়ে চলে যায়।'

নবম সংসদে মইন উদ্দীন খান বাদলকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। প্রথাগত রাজনীতিবিদদের চেয়ে তার চিন্তা ও মনন, বিশেষ করে সংসদীয় ইস্যুতে তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ছিল ঈর্ষণীয়। সংসদে তার বক্তৃতা আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম।

২০১০ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর জন্য যে বিশেষ কমিটি করা হয়েছিল, তিনি সেই কমিটির সদস্য না হলেও ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধান সংশোধন বিল পাশের দিন গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন এবং কয়েকটি সংশোধনী প্রস্তাব দেন। যেমন তিনি সংবিধান থেকে 'বিসমিল্লাহ' ও রাষ্ট্রধর্ম বাতিল এবং জনগণ জাতি হিসেবে 'বাঙালি' শব্দগুলো বর্জনের প্রস্তাব দেন। তিনি সংবিধানের প্রস্তাবনায় 'জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের' শব্দগুলোর পরিবর্তে 'জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের' শব্দগুলো প্রতিস্থাপনের প্রস্তাব করেন।

সংবিধানে ৭খ অনুচ্ছেদ যুক্ত করে ৫০টিরও বেশি অনুচ্ছেদকে সংশোধনের অযোগ্য ঘোষণা করার বিরেধিতা করে বাদল এই অনুচ্ছেদ বর্জনের প্রস্তাব দেন। এছাড়া সরকারের মেয়াদ শেষ হবার পরে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়ে তিনি যে সংশোধনী আনেন, সেখানে বলা হয়, সরকার এবং বিরোধী দলের সদস্যদের নিয়ে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একজন প্রধান উপদেষ্টা এবং দশজন উপেদষ্টা নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে। সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন ৪৫টি থেকে বাড়িয়ে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৫০টি করা হলেও মইনুদ্দিন খান বদলে সংরক্ষিত আসন ১০০টি করার প্রস্তাব করেন।

মইন উদ্দীন খান বাদল মহাজোটের শরিক দলের এমপি হিসেবে ক্ষমতার অংশীদার ছিলেন এটা ঠিক। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ছিল না। ব্যক্তিজীবনেও তাকে নিয়ে ওই অর্থে খুব বেশি বিতর্ক ছিল না। অথচ তার কবরে পর্যন্ত আগুন দেওয়া হলো!

তার চেয়ে বড় কথা, জীবিত অবস্থায় একজন মানুষ যদি খুব বড় অপরাধীও হয়ে থাকেন, তারপরও কি ওই ব্যক্তির কবর ভাঙচুর করা যায় বা সেখানে আগুন দেওয়া যায়? এটি কোনো সভ্য মানুষের কাজ হতে পারে? পরিহাসের বিষয় হলো, যারা মইন উদ্দিন খান বাদলের কবরে আগুন দিয়েছেন, তারা দেখতে মানুষেরই মতো এবং তাদের সঙ্গেই আমাদের বসবাস করতে হয়!

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক

Comments

The Daily Star  | English

Yunus sits with BNP delegation over reform commissions

BNP Secretary General Mirza Fakhrul Islam Alamgir is leading the six-member delegation at the State Guest House Jamuna.

1h ago