নতুন বাস্তবতায় মুক্ত গণমাধ্যম, শিক্ষা নিতে হবে অতীত থেকে

ভিজ্যুয়াল: সালমান সাকিব শাহরিয়ার

আগে যখন সত্য বলতাম, তখন রাষ্ট্র ও সরকারি সংস্থাগুলো আমাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিত। এখন সত্য বললে ভিত্তিহীন ও মিথ্যা অভিযোগ এবং বিদ্বেষমূলক প্রচারণার ভিত্তিতে 'ট্যাগিং' করে আমাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া হচ্ছে; তবে সেটা রাষ্ট্র করছে না।

কোনো ধরনের প্রমাণ ছাড়াই প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে উদ্ভট সব অভিযোগ তোলা হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় যে 'প্রমাণ' উপস্থাপন করা হয়, সেগুলো মিথ্যা, অপ্রাসঙ্গিক, বিকৃত কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এতে করে গণমাধ্যম এখন নতুন এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এর ফলে মিথ্যাচার, অর্ধ-সত্য ও বিকৃত তথ্যে সাধারণ পাঠক বিভ্রান্ত ও প্রতারিত হচ্ছেন।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমের সাম্প্রতিক এক বক্তব্যে আমরা আশাবাদী হয়েছি। সেখানে তিনি দেশের উন্নয়নের জন্য মুক্ত ও স্বাধীন গণমাধ্যমের অপরিহার্যতার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, গত সরকারের ফ্যাসিবাদী নীতি ও শাসন কাঠামোকে সমর্থন এবং বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতাকে বিকৃত করতে গণমাধ্যম কীভাবে ভূমিকা রেখেছে, তা পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। তিনি বারবার বলেছেন, ক্ষমতাসীনদের সবসময় জবাবদিহির মধ্যে রাখা উচিত। প্রতিটি গণমাধ্যমকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে সরকারের সব কার্যক্রম পর্যালোচনা করার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি।

আমরা তার এই অবস্থানের প্রশংসা করি এবং তার বক্তব্যের দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক সামনে আনতে চাই—আমাদের অতীত বিশ্লেষণ এবং ভবিষ্যতে গণমাধ্যমের স্বাধীন পথচলার রূপরেখা নির্ধারণ করা প্রয়োজন।

অতীতের প্রসঙ্গে বললে এটি সত্য যে, গত ১৫ বছরে বেশিরভাগ সংবাদপত্র স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারকে চ্যালেঞ্জ করেনি। তারা সেই সরকারকে জোরালোভাবে সমর্থন করেছে, সত্য লুকিয়েছে, সমালোচনাযোগ্য বিষয়গুলো এড়িয়ে গেছে, কিংবা তথ্য বিকৃত করেছে—যাতে জনগণ সরকারের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ না করে।

আমরা কয়েকটি গণমাধ্যম প্রকাশ্য ও গোপন হুমকি উপেক্ষা করেও সত্য বলার সাহস দেখিয়েছি।

২০১৬ সালে আমাদের ২৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রধান অতিথি হিসেবে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আমন্ত্রণ জানানো হলে দ্য ডেইলি স্টারের প্রতি হাসিনা সরকারের বিরোধিতা চরমে পৌঁছায়। অনুষ্ঠানটিতে কয়েক হাজার আমন্ত্রিত অতিথি এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ২২ জন সম্পাদক উপস্থিত ছিলেন। ড. ইউনূস যখন মূল বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য মঞ্চে ওঠেন, তখন আওয়ামী লীগের কয়েকজন মন্ত্রী সেই অনুষ্ঠান থেকে বের হয়ে যান এবং উচ্চস্বরে অভিযোগ করতে থাকেন, মাহফুজ আনাম তাদের অপমান করেছেন। শুধু তাই নয়, অভিযোগ তোলা হয়, ড. ইউনূস যেন হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে তাকে একটি বিশাল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম দিয়েছে দ্য ডেইলি স্টার। (ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর লাগাতার বিরূপ মন্তব্য, ব্যক্তিগত আক্রমণ ও মিথ্যা মামলা থেকে এটা স্পষ্ট যে, দ্য ডেইলি স্টার ও এর সম্পাদককে তিনি কীভাবে দেখতেন)।

এরপর থেকেই আমরা হাসিনার ঘোষিত 'শত্রু'তে পরিণত হই এবং তিনি আমাদের সঙ্গে তেমন আচরণই করেছেন। এর জেরে একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে আমার একটি মন্তব্যকে অজুহাত বানিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আমার বিরুদ্ধে মামলার ঢল নামে।

আমাকে মোট ৮৪টি মামলায় অভিযুক্ত করা হয়, যার মধ্যে ১৬টি ছিল রাষ্ট্রদ্রোহের। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার সংসদে দাঁড়িয়ে দ্য ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোকে 'রাষ্ট্রবিরোধী', 'আওয়ামী লীগবিরোধী' ও 'জনবিরোধী' বলে আখ্যায়িত করেছেন। অনেক আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য সংসদে দাঁড়িয়ে দ্য ডেইলি স্টারকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছেন এবং আমাদের বিরুদ্ধে 'ষড়যন্ত্র' করার অভিযোগ তুলেছেন। এমনকি অন্যান্য দলের কিছু সংসদ সদস্যও তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন এবং দ্য ডেইলি স্টার বন্ধ করে দেওয়ার ও আমাকে কারাগারে পাঠানোর দাবি তুলেছেন।

সংসদে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী একবার ২১ মিনিট ধরে দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদককে অপমান করেছেন, তার মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং নানা মিথ্যা অভিযোগ তুলেছেন। এর কয়েক বছর পর পদ্মা সেতু উদ্বোধনের সময় তিনি সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ তোলেন যে, ডেইলি স্টার সম্পাদক যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্টের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করে পদ্মা সেতুর জন্য ঋণ বাতিল করানোর লবিং করেছি এবং এটা নাকি ড. ইউনূসের 'ষড়যন্ত্রেরই' অংশ ছিল। এই অভিযোগ সর্বৈব মিথ্যা ও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

গত প্রায় ১৫ বছর ধরে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন বা কোনো অনুষ্ঠানে দ্য ডেইলি স্টারের কোনো প্রতিবেদককে অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়নি; প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফর, এমনকি সরকারপ্রধান হিসেবেও তাকে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। ধীরে ধীরে দুয়েকজন বাদে তার মন্ত্রিসভার প্রায় সব সদস্য দ্য ডেইলি স্টারকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে। তারা আমাদের প্রতিবেদকদের সঙ্গে কথা বলতেন না, আমাদের বিরুদ্ধে কথা বলতেন এবং সুযোগ পেলেই নানাভাবে অপদস্থ করার চেষ্টা করতেন। এর সবই হয়ে গিয়েছিল তাদের রুটিন কাজ। এই সময়ে প্রায় ৪০টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ দেওয়া হয়, তারা যেন দ্য ডেইলি স্টারে কোনো বিজ্ঞাপন না দেয়। ফলে আমাদের রাজস্ব হঠাৎ করেই ৪০ শতাংশ কমে যায়। আমাদের ওপর আওয়ামী সরকারের এই দমন-পীড়ন অব্যাহত থাকে জুলাই গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত।

আমরা গর্বের সঙ্গে বলতে পারি, আমাদের কর্মী, পরিচালনা পর্ষদ ও নেতৃত্বের দৃঢ়তার কারণে দ্য ডেইলি স্টার কখনো মাথা নত করেনি।

প্রেস সচিব কেবল অতীত বিশ্লেষণের ওপরই গুরুত্ব দেননি, বরং গণমাধ্যমগুলো জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সংবাদ কীভাবে প্রচার করেছে, সেটিও খতিয়ে দেখার ওপর জোর দিয়েছেন। আমরা এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই এবং কিছু গণমাধ্যম ভয়াবহ হুমকির মুখেও প্রতিদিন ছাত্র-জনতা হত্যার সংখ্যা প্রকাশ করায় তিনি যে প্রশংসা করেছেন, তার জন্য ধন্যবাদ জানাই।

সাংবাদিক ইউনিয়নগুলোর রাজনৈতিকীকরণের ভূমিকাও আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া উচিত সেই মিডিয়া মালিকদের ভূমিকার ওপর, যারা নিজেদের গণমাধ্যম ব্যবহার করেছেন হাসিনা সরকারকে প্রশংসায় ভাসাতে, অবৈধভাবে ব্যাংক ঋণ নিতে, লাভজনক চুক্তি হাতিয়ে নিতে, করমুক্ত আয় বাড়াতে এবং অর্থপাচার করতে। এই মালিকদের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করা ছাড়া সেসব প্রতিষ্ঠানের সাংবাদিকদের কোনো উপায়ও ছিল না। আমরা মনে করি, এই পরিস্থিতিতে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করা উচিত ছিল সম্পাদকদের। না পারলে তাদের পদত্যাগ করা উচিত ছিল।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও স্বাধীন সাংবাদিকতার সুযোগ নিয়ে অনেক প্রশংসনীয় কথা শুনতে পেলেও দুঃখজনক সত্য হচ্ছে, স্বাধীন গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে নতুন ধরনের হুমকির কিছু আশঙ্কাজনক ইঙ্গিত এখনো স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। আর এটাই মুক্ত গণমাধ্যমের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।

২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ১৪০ জন সাংবাদিককে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে এবং জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে প্রতিবেদন করার ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। এই ধরনের পরিস্থিতি দেখে আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, সরকার সাংবাদিকদের সঙ্গে যথেষ্ট সংবেদনশীল আচরণ করছে না। এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি 'হত্যা মামলায় অভিযুক্ত' সাংবাদিক রয়েছেন বাংলাদেশে। ১৪০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এসব মামলা চলমান থাকা অবস্থায় বিশ্ব কীভাবে বিশ্বাস করবে যে এই সরকার গণমাধ্যমের প্রতি ন্যায়সঙ্গত আচরণ করছে? এখন পর্যন্ত এই সরকারের বিরুদ্ধে যেসব সমালোচনা এসেছে—হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, কমিটি ফর দ্য প্রোটেকশন অব জার্নালিস্টস, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে—সেগুলোর বেশিরভাগই সাংবাদিকদের প্রতি যে আচরণ করা হচ্ছে সেটা নিয়ে।

সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পর কয়েক মাস হয়ে গেলেও আমরা এখনো জানি না যে, এসব অভিযোগ যাচাই ও তদন্তে কোনো অগ্রগতি হয়েছে কি না। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাগুলো পর্যালোচনা করতে গত ২৭ অক্টোবর আট সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি জানায়নি। অথচ, অভিযুক্ত সাংবাদিকরা তাদের নিয়মিত কাজ করতে পারছেন না, পরিবারের খরচ চালাতে পারছেন না, অনেকের সন্তানের পড়াশোনার খরচ বহন করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। তারা সামাজিকভাবে অপমানিত হচ্ছেন এবং যেকোনো সময় গ্রেপ্তার হওয়ার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।

কোনো অপরাধ বা অনৈতিক কাজে জড়িত থাকলে একজন সাংবাদিককেও অবশ্যই আইনের মুখোমুখি হতে হবে। তবে, সবার জন্য সংবিধান স্বীকৃত আইনি প্রক্রিয়ার অধিকার নিশ্চিত করা আবশ্যক।

অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে অনুরোধ—আপনারা যে মুক্ত ও স্বাধীন গণমাধ্যমের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, সেটা প্রমাণ করতে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাগুলো অবিলম্বে পর্যালোচনা করুন এবং সেগুলো গ্রহণযোগ্য আইনি মানদণ্ডে আনুন।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

 

Comments

The Daily Star  | English
tax collection target for IMF loan

Talks with IMF: Consensus likely on exchange rate, revenue issues

The fourth tranche of the instalment was deferred due to disagreements and now talks are going on to release two tranches at once.

11h ago