রাষ্ট্র কি জনগণের মন বোঝে?

প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করার সময় একটা প্রশ্ন আমাকে ভাবিয়ে রাখত—রাষ্ট্র কি আসলেই জনগণের মন বোঝে? একটা কোম্পানি যখন তার গ্রাহকের চাহিদা আগেভাগে বুঝে ফেলে, সরকার কেন জনগণের সমস্যা আগে থেকে ধরতে পারে না? ধরুন, অ্যামাজন বা দারাজ আগেই বুঝে ফেলে আপনি কখন কোন জিনিস অর্ডার দিতে যাচ্ছেন। তারা সেই অনুযায়ী আপনার সবচেয়ে কাছের ওয়্যারহাউসে প্রোডাক্ট পাঠিয়ে দেয়, যাতে আপনি অর্ডার দেওয়ামাত্র হাতে পেয়ে যান।

কিন্তু রাষ্ট্র? রাষ্ট্র কেন জনগণের আকাঙ্ক্ষা বুঝতে পারে না? কেন সমস্যাগুলো বড় আকার নেওয়ার আগে সমাধান করতে পারে না? এ নিয়ে ভাবতে গিয়ে ২০০০ সালে লিখি—'কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় মানবিক রাষ্ট্র'। বইটা ছিল একটা স্বপ্ন নিয়ে—যদি প্রযুক্তিকে ঠিকঠাক ব্যবহার করা যায়, তাহলে রাষ্ট্র কি আরও মানবিক হতে পারবে না? এমন এক রাষ্ট্র, যা শুধু আইন-কানুন আর কাগজপত্রের জটিলতা নয়, বরং মানুষের চাহিদা আর অনুভূতি আগেভাগে বুঝবে?

এই চিন্তা আরও গভীর হয় যখন ২০২৪ সালের জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন বড় আকার নিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়া যদি আগেই বোঝা যেত, তাহলে কি পরিস্থিতি এতটা ঘোলাটে হতো? এই ভাবনা থেকে ক্লাসিক দার্শনিকদের লেখা খুঁটিয়ে পড়তে শুরু করি। আর এই ঈদে পড়ার জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ বই হলো প্লেটোর 'দ্য রিপাবলিক'। রিভিশন দিচ্ছি আজকে থেকে। প্লেটোও আসলে আমার মতো একই প্রশ্ন তুলেছেন—একটা রাষ্ট্র কীভাবে সবার জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে? জনগণ কী চায়, সেটা শাসক কীভাবে বুঝবে? আর কারা আদর্শ শাসক হওয়ার যোগ্য?

প্লেটোর এই বইটা একদম আড্ডা দেওয়ার মতো। মূল চরিত্র সক্রেটিস, যাকে ধরে বসিয়েছে কয়েকজন তরুণ। তারা সবাই একটা ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া করছে—ন্যায়বিচার মানে আসলে কী? কেউ বলে, 'ন্যায় মানে বন্ধুদের উপকার করা আর শত্রুদের শাস্তি দেওয়া'। আবার আরেকজন বলে, 'যার হাতে ক্ষমতা, তার সুবিধাই "ন্যায়" জিনিস!' কিন্তু সক্রেটিস এসব যুক্তি উড়িয়ে দেন। তার মতে, ন্যায় মানে—যে যার কাজ মন দিয়ে করবে, আর অন্যের ব্যাপারে বেশি নাক গলাবে না। অসাধারণ, তাই না?

প্লেটো এখানে একটা 'মজার' ভাগাভাগি করেছেন। তিনি বলেন, সমাজে তিন ধরনের মানুষ থাকে—শাসক (ruler), যোদ্ধা (guardian) আর শ্রমিক (worker)। যারা বেশি বুদ্ধিমান আর সত্যিকারের জ্ঞানী, তারা শাসক হবে। যারা সাহসী, তারা যোদ্ধা—রাষ্ট্র রক্ষা করবে। আমি সাহসী কি না জানি না, তবে এই লাইনেই হেঁটেছি। আর বাকিরা কৃষক, ব্যবসায়ী বা শ্রমিক হিসেবে কাজ করবে। এখানে আমি একটু দ্বিমত করি। কারণ এই শ্রেণিই এখন পৃথিবী চালায়। এখন এই তিনটা শ্রেণি যদি যার যার কাজ মন দিয়ে করে, তবেই সমাজে শান্তি থাকবে। কিন্তু শাসক হওয়ার জন্য শুধু বুদ্ধিমান হলেই চলবে না—তার মনটাও বড় হতে হবে। শাসককে নিজের স্বার্থ ছেড়ে জনগণের মঙ্গল চিন্তা করতে হবে। প্লেটো বলেন, যদি ভুল মানুষকে ক্ষমতা দেওয়া হয়, তাহলে সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে। এটাই আমরা দেখছি ইদানীং। সমাধান কী?

এই জন্যই তিনি একটা দারুণ ধারণা দেন—দার্শনিক-রাজা। মানে, রাষ্ট্র পরিচালনা করবে সেই ব্যক্তি, যার কাছে ক্ষমতা পাওয়া কোনো লোভের ব্যাপার নয়, বরং যিনি সত্য বোঝেন, ন্যায়বিচার বুঝতে পারেন। আর যারা শুধু চেহারা দেখে বা বাইরের জিনিসে মুগ্ধ হয়ে যায়, তারা আসল সত্য কখনো বুঝবে না। প্লেটো এই বিষয়টা বোঝাতে একটা অসাধারণ গল্প বলেন—গুহাছায়া দিয়ে ধারণা।

এই গল্পে তিনি বলেন, ধরুন, কিছু মানুষ গুহার ভেতরে বন্দি। তাদের সামনে শুধু দেয়ালে পড়া কিছু ছায়া আসে, আর তারা ভাবে সেই ছায়াগুলোই 'ডেফিনিটিভ ট্রুথ'। কিন্তু যদি কোনোভাবে একজন গুহা থেকে বের হতে পারে, সে দেখবে আসল জগতটাতে আলো আছে, রং আছে, বাস্তবতা আছে। প্লেটোর মতে, সাধারণ মানুষ ওই গুহাবন্দিদের মতো—তারা শুধু যা চোখে দেখে তাই-ই সত্য ভাবে। আর দার্শনিকরা সেই মানুষ, যারা গুহার বাইরে বেরিয়ে সত্যকে দেখতে পেয়েছে।

এই 'গুহাছায়া' আমাকে একটা চিন্তায় ফেলেছে—সরকার কি গুহার মধ্যে আটকে আছে? তারা কি শুধু ফাইল-পত্র আর কাগজে লেখা রিপোর্ট দেখছে? সাধারণ মানুষের আসল ডিমান্ড কি তারা দেখতে পাচ্ছে? প্লেটো বলতে চেয়েছেন, একটা সমাজ তখনই ঠিকঠাক চলবে, যদি যোগ্য লোক শাসন করে আর সবাই নিজের কাজ করে। যেমন, একজন অসৎ ব্যবসায়ী যদি প্রধানমন্ত্রী হয়, তাহলে তার মাথায় থাকবে নিজের মুনাফার চিন্তা। কিন্তু যদি একজন নীতিবান আর সত্যিকারের জ্ঞানী মানুষ রাষ্ট্র চালায়, তখন সে নিজের স্বার্থ ভুলে সবার মঙ্গল করবে। তাই নয় কি?

এই বইটার রিভিশনে আমার মনে হলো, রাষ্ট্রযন্ত্র কি এমনভাবে সাজানো যায়, যাতে জনগণের চাহিদা আগেভাগে জানা যাবে? যদি অ্যামাজন বুঝতে পারে আপনি কখন কোন প্রোডাক্ট চাইবেন, তাহলে রাষ্ট্র কেন বুঝতে পারবে না আপনি কখন হাসপাতাল চাইবেন, কখন শিক্ষা চাইছেন বা কখন ন্যায়বিচার চাইবেন? বইটা যেন আমার সেই পুরোনো প্রশ্নগুলোকে আবার জাগিয়ে তুললো—রাষ্ট্র কি শুধু শাসন করবে, নাকি জনগণের সত্যিকারের আকাঙ্ক্ষা বুঝে তাদের পাশে দাঁড়াবে?

রকিবুল হাসান: টেলিকম ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক লেখক এবং লিংক-থ্রি টেকনোলজিস লিমিটেডের চিফ টেকনোলজি অফিসার

Comments

The Daily Star  | English

A floating mosaic of guavas, baskets and people

During the monsoon, Jhalakathi transforms into a floating paradise. Bhimruli guava market comes alive with boats carrying farmers, buyers, and tourists.

11h ago