আবুল বারকাতের বুকরিভিউ 

বাজেট বরাদ্দ ও বঞ্চনার খতিয়ান 

রাষ্ট্র ‘অ-জনগণ’ করে রেখেছে এরকম বর্গ সংখ্যায় বাংলাদেশে নেহায়ত কম নয়। সে সংখ্যা নিরুপণের জন্য লেখক বাংলাদেশের সংবিধানকে মানদন্ড হিসেবে বিবেচনা করেছেন। সংবিধানে উল্লেখ আছে অথচ অধিকার থেকে বঞ্চিত এরকম প্রায় ত্রিশটির বেশি বর্গ চিহ্নিত করা হয়েছে।

রাষ্ট্রে যখন অন্যায্য ব্যবস্থা বিরাজ করে, তখন এক শ্রেণী বঞ্চিত হয় যাবতীয় সুযোগ সুবিধা থেকে। যদিও এরা সংখ্যায় গরিষ্ঠ। জনগণের প্রলেপ মাখা কিন্তু রাষ্ট্রীয় নিষ্পেষণ ও বঞ্চনার অভিঘাতে এরাই ক্রমে হয়ে ওঠে 'অ-জনগণ'। 

এমনি ভাবনার একটি বই প্রকাশিত হয়েছে অধ্যাপক আবুল বারকাতের "অ-জনগণকরণের" রাজনৈতিক অর্থনীতি। এতে বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। জনগণকে তাদের সাংবিধান-স্বীকৃত অধিকার থেকে অনেক ভাবেই বঞ্চিত করা হয়। বইটি সে বঞ্চনার এক বিস্তৃত নমুনা হাজির করেছে। এজন্য লেখক নির্ভর করেছেন রাষ্ট্রের প্রধান অর্থনৈতিক দলিল বাজেট ডকুমেন্টের উপর। পিছিয়ে পড়া চারটি বর্গের মানুষের জন্য গত ৫০ বছরের (১৯৭২-২০২২) রাষ্ট্রীয় বাজেটে বরাদ্দের গতি-প্রকৃতি তুলে ধরেছেন এবং দেখিয়েছেন ধারাবাহিক বরাদ্দ হ্রাসের মাধ্যমে রাষ্ট্র কিভাবে তার বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য তৈরী করেছে বঞ্চনার এক অমোঘ ফাঁদ।

কয়েকটি কারণে বইটি বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। প্রথমত; বাংলাদেশে বাজেট-সাহিত্য অপ্রতুল। আকর উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা যায় বাজেট বক্তৃতাসমূহকে, যেগুলো নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী কোন কাজ এখনো হয়নি। বাজেটের ধরণ ও কাঠামোগত বিষয় নিয়ে সাম্প্রতিককালে কিছু গবেষণা হয়েছে। কিছু বিবরণমূলক ও সংকলনগ্রন্থও পাওয়া যায়। এছাড়া বাজেট প্রণয়ণকালে পত্র-পত্রিকায় উপসম্পাদকীয় লেখা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের বাজেট ও এর ঐতিহাসিক বরাদ্দ-প্রবণতা নিয়ে মৌলিক কোনো গবেষণা পাওয়া যায় না। গত পাঁচ দশকের বাজেট-সম্পর্কীয় প্রধান কিন্তু সহজলভ্য নয়, এমন ডকুমেন্টের উপর ভিত্তি করে বইটির মূল প্রশ্নসমূহ অনুসন্ধান করা হয়েছে। ফলে রাষ্ট্রের বাজেট-দর্শনের খণ্ডিত নয় বরং এক পরিপূর্ণ বয়ান উঠে এসেছে। এর মাধ্যমে, 'উদারনৈতিক' রাষ্ট্র বাংলাদেশের তার প্রান্তিক মানুষের প্রতি অনুদার দৃষ্টিভঙ্গির এক সুস্পষ্ট ও ব্যতিক্রমী আলেখ্য সামনে এসেছে।  

দ্বিতীয়ত, অর্থনীতিকে গতিশীল করা এবং প্রবৃদ্ধির সুফল আরও বেশী মানুষের নিকট পৌঁছানোর নামে আশির দশক থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে 'মুক্ত বাজার' নীতি গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ। এর ফলে দেশটির নীতি-নির্ধারণের প্রধান ভূমিকায় চলে আসে দাতা গোষ্ঠী। ফলে বরাদ্দ খাতেও পরিবর্তন দেখা যায়। এ গবেষণায় স্পষ্ট দেখা যায়, এ দশকের শুরুর দিক থেকে জনকল্যাণকামী খাতগুলোতে  জনসংখ্যানুপাতিক প্রকৃত বরাদ্দ কমতে থাকে। যখনই কিছুটা বাড়ছে, তখন বাড়ছে মূলত অনুন্নয়নমূলক খাতে। ফলে নয়া-উদারবাদী বাজার-অর্থনীতি ও রাষ্ট্রীয় নীতি ভ্রষ্টতার মিথস্ক্রিয়াজাত পরিণতি পাঠের দারুণ উপকরণ হিসেবে বিবেচনা করা যাবে এ বইকে। বোঝা যাবে, অপরিণামদর্শী সর্বগ্রাসী বাজার কৌশল কিভাবে বিত্তহীন জনগণকে উত্তরোত্তর অধিক হারে 'অজনগণ'-সত্তায় রুপান্তরিত করছে। 

তৃতীয়ত, বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে যাত্রা শুরু করা একটি রাষ্ট্র কিভাবে ক্রমান্বয়ে বৈষম্য-সহায়ক উপাদানসমূহের পৃষ্ঠপোষণা করে যাচ্ছে, তার ধারাবিবরণী পাওয়া যাবে। চতুর্থত, বইটিতে এমন কিছু মানুষের কথা বলা হয়েছে, যারা রাষ্ট্রের বৃহত্তর চারটি বর্গ অথচ বাজেটে তাদের জন্য স্বতন্ত্র্য 'লাইন আইটেম' নেই। পঞ্চমত, এতে ব্যবহৃত পদ্ধতি ও ফলাফল বাজেট বিষয়ক অন্য অনেক গবেষণার জন্য সূতিকাগার ও অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে। 

দুই ভাগে বিভক্ত বইটিতে মোট ১৮টি অধ্যায় রয়েছে। প্রথম অংশে বইটির জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামো দাঁড় করানো হয়েছে। ধারণা হিসেবে 'অ-জনগণকরণ' খুব বেশী আলোচিত নয়। অধিকার হরণ যখন বিধিবদ্ধ নিয়েমে পরিণত হয় তবে সেটা তুলনামূলক স্থায়ী বঞ্চনা তৈরী করে। এরকম বঞ্চনা আর্থ-সামাজিক কাঠামোর গভীরে প্রোথিত থাকে, তখন তার পরিণতির শিকার মানুষ 'অ-জনগণে' রুপান্তরিত হতে বাধ্য হয়। 

রাষ্ট্র 'অ-জনগণ' করে রেখেছে এরকম বর্গ সংখ্যায় বাংলাদেশে নেহায়ত কম নয়। সে সংখ্যা নিরুপণের জন্য লেখক বাংলাদেশের সংবিধানকে মানদন্ড হিসেবে বিবেচনা করেছেন। সংবিধানে উল্লেখ আছে অথচ অধিকার থেকে বঞ্চিত এরকম প্রায় ত্রিশটির বেশি বর্গ চিহ্নিত করা হয়েছে। গবেষণার সুবিধার্থে বইতে লেখক মূলত আলোচনা করেছেন চারটি বৃহৎ বর্গ নিয়ে:পারিবারিক কৃষি (প্রান্তিক খুদে কৃষক), গ্রামীণ নারী (উৎপাদনের উপায়ের উপর ক্ষমতা নেই), আদিবাসী এবং ভূমি-সংস্কার উদ্দিষ্ট মানুষ (জমি-জলা ও জঙ্গলের উপর জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল)। বাজেট বরাদ্দ ও আলোচনায় এসব বর্গের মানুষজন খুব বেশী মনযোগ পায় না এবং এদের নিয়ে সঠিক কোনো পরিসংখ্যানও নেই। 

অথচ বারকাতের হিসেবানুযায়ী দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ জনগণ মোটাদাগে কোনো না কোনোভাবে এ চারটি বর্গের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সংখ্যাগরিষ্টকে না 'গোণা' এবং তাদের ব্যাপারে কম ভাবার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সারবত্তাই উপস্থাপন করা হয়েছে এ অংশের সাতটি অধ্যায়ে।

রাষ্ট্র তার বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে কিভাবে ঠকায়, প্রাপ্ত বরাদ্দ কোন উপায়ে গায়েব করে দেয়, তার প্রমাণ হাতে-কলমে দেখানো হয়েছে বইটির দ্বিতীয় অংশে। সেজন্য নমুনা হিসেবে এই বইয়ে চিহ্নিত চার বর্গের মানুষের জন্য রাষ্ট্রীয় বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ যাচাই-বাচাই করা হয়েছে। প্রথমে, উন্নয়ন বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি সহ অন্যান্য যেসব প্রকল্পসমূহে বরাদ্দ রয়েছে, সেগুলোর হিসেব বেরা করা হয়েছে। বাংলাদেশে প্রথম পাঁচ দশকে উন্নয়ন বাজেটের আওতায় মোট ১,০৬,৫৩৫টি প্রকল্প বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। 

এসব প্রকল্প থেকে এই বইয়ের চারটি বর্গের প্রতিটিতে প্রতি বছর কী পরিমাণ বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তা নিরুপণ করা হয়েছে। প্রাপ্ত ফলাফল পিলে চমকে যাওয়ার মত। বাংলাদেশ তার প্রথম পঞ্চাশটি বাজেটে বৃহত্তর চারটি বর্গের মানুষের জন্য জনসংখ্যানুপাত অনুযায়ী বরাদ্দের মাত্র ১৩% বরাদ্দ দিয়েছে, বাকি ৮৭% বরাদ্দই অন্যদের দখলে গেছে। আদতে, লুট করা হয়েছে। মোটাদাগে এই বইতে দেখানো হয়েছে, প্রান্তিক মানুষের প্রতি বাজেট বরাদ্দের মূল প্রবণতা হল: জনসংখ্যানুপাতে কম বরাদ্দ দেয়া; অতি নগণ্য পরিমাণ বরাদ্দ দেয়া এবং ফলশ্রুতিতে; ক্রমবর্ধমান বরাদ্দ-বৈষম্য। 

বরাদ্দ বৈষম্যের এই অনতিক্রম্য ফাঁদ থেকে মুক্তির উপায় কী? লেখক প্রধানত গুরুত্ব দিয়েছেন একটি বিষয়ের উপর। এই চারটি বর্গের মানুষের জন্য মাথাপিছু বরাদ্দ জাতীয় মাথাপিছু বরাদ্দের সমপর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। এজন্য দুটি প্রাথমিক পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেছেন: প্রথমত; বিদ্যমান বরাদ্দ ব্যবস্থায় যে ফাঁক রয়েছে সেটা পূরণ করা এবং দ্বিতীয়ত; "ইতিবাচক বৈষম্য-হ্রাস নীতি" নিশ্চিতে অতিরিক্ত বরাদ্দ দেয়া। তবে এ সুপারিশ বাস্তবায়ন মূলত রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিষয়। লেখক নিজেই সেটা স্বীকার করেছেন। একই সাথে রাষ্ট্রীয় বাজেটে ব্যয় বরাদ্দ ও আয়- উভয় কাঠামোকেই বৈষম্য নিরসনউদ্দিষ্ট সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছেন। ব্যয় বরাদ্দের পাশাপাশি বাজেটের আয় উৎসে পরিবর্তনের কথা বলেছেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রধানত; বর্ধিত হারে সম্পদ করারোপ, বর্ধিত আয়কর, কালোটাকা উদ্ধার, অর্থপাচার রোধ। এর মাধ্যমে বাজেটের পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন, যাতে  প্রান্তজনের অনুকূল হয় এর সুফল। 

সামগ্রিকভাবে বলা যায়, বাংলা ভাষায় বাজেট বিষয়ক গবেষণা গ্রন্থ হিসেবে বইটি অত্যন্ত সার্থক ও নিদর্শনস্থানীয়। শক্তিশালী গবেষণা-পদ্ধতি বইটির গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে। তবে এর কাঠামোবদ্ধ আলোচনার ধরণ সাধারণ পাঠকের মনযোগ কমিয়ে দিতে পারে। বিশেষত বইটির দ্বিতীয় অংশ, যেখানে চারটি বর্গকে একই কাঠামোর (পরিসংখ্যান সারণি, লেখচিত্র, তথ্যসূত্র ও বিশেষ নোট ইত্যাদি) নিরিখে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এতে করে বইটিতে দ্বিরুক্তিতার পাশাপাশি পাঠকের উদ্দীপনায় ঘাটতি তৈরী হতে পারে। তবে চারটি বর্গের শুধু একটি বর্গ সম্পর্কে পড়তে চায়, এমন পাঠকের সুবিধার্থেও বইটি এভাবে সাজানো হতে পারে। এতদ্বসত্ত্বেও বিষয়বস্তুর বিচারে বইটির গুরুত্ব সব সীমাবদ্ধতাকে উতরে যায়। বাংলাদেশের বাজেট বিষয়ক আলোচনায় এ বইটি একটি বিশেষ অবদান হিসেবে বিবেচিত হবে।

Comments

The Daily Star  | English

Teesta floods bury arable land in sand, leaving farmers devastated

40 unions across 13 upazilas in Lalmonirhat, Kurigram, Rangpur, Gaibandha, and Nilphamari are part of the Teesta shoal region

1h ago