ট্যাগিং দিয়ে নিপীড়ন চলতে পারে না

২০০৪ সালের জুলাই। মাত্র ঢাকা শহরে এসেছি। শরীরে তখনো মফস্বল শহরতলীর গন্ধ। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গিনায় পা রাখা এক তরুণ হিসেবে সে সময় হাড়েহাড়ে টের পেয়েছিলাম গেস্টরুম নিপীড়ন কী ও কত প্রকার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের গেস্টরুমের কিছু রাত এখনো স্মৃতি অ্যালবামে ভীতি ছড়ায়। সেই গেস্টরুম সংস্কৃতিকে নিপীড়নের চূড়ান্ত টর্চার সেলে পরিণত করেছিল শেখ হাসিনার ছাত্রলীগ। অভূতপূর্ব জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে এই সংস্কৃতির সম্ভবত অবসান হয়েছে। গণরুম নামের গোয়াল ঘরও বন্ধ হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে। এগুলো ভালো খবর। ইতিবাচক পরিবর্তন। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের উপজাত হিসেবে শিক্ষাঙ্গনে চলে এসেছে মব সংস্কৃতি ও ট্যাগিং চর্চা—যা ধীরে ধীরে বিষিয়ে তুলছে শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ। ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি হচ্ছে জনপরিসরে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আকরাম হোসেনকে পিটিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেছে একটি ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা। অভিযোগ, আকরাম হোসেন এক সময় নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ করতো। কোনো এক সময় অপর একটি ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের ওপর হামলা করেছিল বলেও তার বিরুদ্ধে অনেকে অভিযোগ করছেন।

আবার একটি পক্ষ দাবি করছেন, আকরাম জুলাই গণআন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন, ভয়াবহ সেই দিনগুলোতে ঝুঁকি নিয়ে ছাত্র-জনতার কাতারে শামিল হয়েছিলেন। রোববার সনদ তুলতে ক্যাম্পাসে গেলে তাকে মারধর করে পুলিশে দেওয়া হয়।

এই ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে উত্তাপ ছড়িয়েছে বেশ। তালা দিয়ে বিভাগে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ করেছে পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা। আকরামকে ছাড়িয়ে আনতে থানাতেও তারা অবস্থান নিয়েছেন। আকরামের বিভাগের শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ট্যাগিং দিয়ে অন্যায়ভাবে আকরামকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।

পাল্টাপাল্টি এসব অভিযোগ ও দাবির মুখে কে ঠিক আর কে ভুল, তা নির্ণয় করা কঠিন। তবে ক্রমাগত মব সন্ত্রাস তৈরি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়ম-নীতি ও রাষ্ট্রীয় আইন না মানার প্রবণতা ভীতিকর।

জুলাই আন্দোলন বা অন্য কোনো ঘটনায় কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ থাকলে আইনের আশ্রয় নেওয়া শ্রেয়। সেই অধিকার সবার আছে। কিন্তু শিক্ষা সনদ তুলতে নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার পর তাকে কেন্দ্র করে সহিংস পরিস্থিতি তৈরি করা কাম্য নয়। এটা শুধু শিক্ষাঙ্গনে নয়, যেকোনো প্রতিষ্ঠানেই নিরাপত্তাহীনতা ও অস্থিরতা তৈরি করে। শুধু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়, দেশের বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনে কম-বেশি এই চর্চা চলছে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শিক্ষাঙ্গন তথা শিক্ষার্থীদের অবদান অনস্বীকার্য। তারাই সামনের সারিতে ছিলেন। এই বাস্তবতা শুধুমাত্র পাগল ও ফ্যাসিস্টরাই অস্বীকার করার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু এটাও মনে রাখা প্রয়োজন, এই আন্দোলনের সফলতা কাউকেই শিক্ষাঙ্গনের নিয়ম-নীতি ভাঙা বা আইন হাতে তুলে নেওয়ার লাইসেন্স দেয় না। কারণে অকারণে মব পরিস্থিতি তৈরি কাম্য নয়।

মব সন্ত্রাস কারো জন্যই যে কল্যাণকর নয়, তা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়েছে। এই মব পরিস্থিতির কারণেই আওয়ামী লীগ পরবর্তী শিক্ষাঙ্গনের প্রশাসনকে রীতিমতো খাবি খেতে হচ্ছে, ভেঙে পড়ছে প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা।

খেয়াল করে দেখুন, কুয়েটের পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি। অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে প্রথম সারির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। চূড়ান্ত বিচারে এতে ক্ষতি কার? নিঃসন্দেহে শিক্ষার্থীদের, শিক্ষাঙ্গনের, বাংলাদেশের।

বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে দলীয় লেজুড়বৃত্তির হিংসাত্মক যে রাজনীতি চলে, তা নজিরবিহীন। শুধুমাত্র রাজনৈতিক মতাদর্শ ভিন্ন হওয়ায় নিজের সহপাঠীকে নিষ্ঠুর বর্বরতায় পিটিয়ে হত্যার নজির কেবল এ দেশেই আছে বলে আমার ধারণা। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর একটা সুযোগ এসেছে শিক্ষাঙ্গনের কলুষতা দূর করার। শিক্ষাঙ্গনসহ পুরো ব্যবস্থার গুণগত মান পরিবর্তন করে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার। কিন্তু এর বিপরীতে যদি হিংসার চর্চা, হানাহানি, ট্যাগিং, মব পরিস্থিতি চলতেই থাকে, তাহলে আমাদের ধ্বংস অনিবার্য। এটা নিজ দোষে দিনে-দুপুরে প্রকাশ্য আত্মহত্যার শামিল।

বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গন ট্যাগিং ও মব সন্ত্রাস থেকে মুক্ত হোক। প্রতিষ্ঠিত হোক নিয়ন-নীতি ও আইনের শাসন।

রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Comments

The Daily Star  | English

'Frustrated, Yunus hints at quitting'

Frustrated over recent developments, Chief Adviser Prof Muhammad Yunus is considering stepping down, said sources familiar with what went down at the Chief Adviser’s Office and Jamuna yesterday.

8h ago