দুই-তিন দিনের জন্য মেয়র হয়ে ইশরাক কী করবেন?

বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন যদি এখন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে শপথ নেনও, তারপরও তিনি হয়তো দুই-তিন দিনের বেশি মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। যদি তাই হয়, তাহলে তিনিই সম্ভবত বাংলাদেশ তো বটেই, পৃথিবীর ইতিহাসেই সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত মেয়াদে মেয়র হওয়ার রেকর্ড গড়বেন!

প্রশ্ন হলো, এত অল্প সময়ের জন্য তাকে মেয়র হতে হবে কেন? এতটুকু সময়ে তিনি নগরবাসীর জন্য কী করবেন বা করতে পারবেন?

একসময় টেলিভিশনের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট ব্যক্তিদেরকে উপস্থাপক প্রশ্ন করতেন, একদিনের জন্য প্রধানমন্ত্রী হলে কী করবেন? স্কুলে অনেক সময় শিশুদেরকে লিখতে বলা হয়, তুমি যদি একদিনের জন্য দেশের প্রধানমন্ত্রী বা মেয়র হতে পারো, তাহলে কী করবে?

বিষয়টা কি অনেকটা সেরকম যে ইশরাক হোসেন দুই-তিন দিন বা এক সপ্তাহের জন্য মেয়র হলেই পুরো দক্ষিণ ঢাকার চেহারা বদলে দেবেন? সেটা সিনেমায় সম্ভব, বাস্তবে নয়। বাস্তবে ঢাকার দুই অংশের মধ্যে দক্ষিণাংশ তুলনামূলকভাবে জটিল। এখানে যেকোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করা কঠিন। ঢাকার পুরোনো তথা আদি অঞ্চল এবং দূষিত বুড়িগঙ্গা সঙ্গী করে নগরীর এই অংশ। এখানের কালচারও ঢাকার অপেক্ষাকৃত নতুন উত্তরাংশের চেয়ে অনেকটা ভিন্ন। সব মিলিয়ে গল্পের আলাদিনের চেরাগ ছাড়া দুই-তিন দিনের জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র হয়ে কারো পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয়।

কিন্তু তারপরও ইশরাক হোসেন মেয়র হতে চান। শপথ পড়ে দায়িত্ব বুঝে নিতে চান। যে দাবিতে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে রাজপথে আছেন তার সমর্থকরা। শুরুটা হয়েছিল দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কার্যালয় নগর ভবনের গেট থেকে। ধীরে ধীরে সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশের রাস্তায়। ব্লকেড তৈরি হয় গুলিস্তান ও গোলাপশাহ মাজার এলাকায়। কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে একপর্যায়ে আন্দোলনে যোগ দেন নগর ভবনের অনেক কর্মীও। তারা একপর্যায়ে নগর ভবনের প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেন। সব মিলিয়ে কার্যত অচল হয়ে পড়ে নগর ভবন। সব ধরনের কাজ বন্ধ। সেবা নিতে আসা নাগরিকদের দুর্ভোগের অন্ত নেই।

এই আন্দোলন ছড়িয়ে গেলো মৎস্য ভবন ও কাকরাইল পর্যন্ত। অর্থাৎ যেখানে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনা। ফলে এটি ছিল অনেকটা 'মার্চ টু যমুনা' কর্মসূচি। কিন্তু এরইমধ্যে গত ২২ মে হাইকোর্ট ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রজ্ঞাপন স্থগিত চেয়ে করা রিট খারিজ করে দিলে তার আইনজীবীরা বলেন যে, ইশরাককে শপথ পড়াতে আর কোনো আইনি বাধা নেই। আদালতের ওই রায় শোনার পরে মৎস্য ভবন ও কাকরাইল এলাকায় ইশরাকের সমর্থকরা আনন্দ মিছিলও করেন। ইশরাক নিজেও ৪৮ ঘণ্টার জন্য আন্দোলন স্থগিত করেন। সেই ৪৮ ঘণ্টা এরইমধ্যে শেষ হয়েছে।

কিন্তু সোমবার (২৬ মে) ইশরাককে শপথ না পড়ানোর নির্দেশনা চেয়ে দায়ের করা রিট খারিজের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করেন আইনজীবী জহিরুল ইসলাম মুসা। এদিনই ইশরাককে শপথ পড়ানোর জন্য সরকারকে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন তার সমর্থকরা। তার মানে একদিকে সরকার ও বিচার বিভাগ, অন্যদিকে ইশরাক ও তার সমর্থকদের আল্টিমেটাম।

শেষ বেলায় এসে রায়!

২০২০ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়র হন। শপথ গ্রহণ করেন ২৭ ফেব্রুয়ারি। ১৬ মে দায়িত্ব নেওয়ার পর ২ জুন প্রথম সভা হয়। আইন অনুযায়ী করপোরেশনের পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা আগামী ১ জুন।

ওই নির্বাচনের দিন থেকেই ভোটে কারচুপির অভিযোগ আনেন ইশরাক হোসেন। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ইশরাক হোসেন ঢাকার দক্ষিণাংশে বিএনপির একজন জনপ্রিয় নেতা। তার বাবা সাদেক হোসেন খোকাও দুই মেয়াদে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলেন।

২০২০ সালে পিতার উত্তরসূরি হিসেবে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র পদে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপসের কাছে তিনি হেরে যান। যদিও নির্বাচনে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ‍তুলে তিনি ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেন এবং পরবর্তীতে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর মামলাটি ঝুলেছিল।

জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পরে দেশের রাজনীতির হিসাব-নিকাশ বদলে যাওয়ার পরে গত ২৭ মার্চ ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের বিচারক ইশরাকের পক্ষে রায় দেন। রায়ে ২০২০ সালের নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেই সঙ্গে শেখ ফজলে নূর তাপসের মেয়র হিসেবে ঘোষণার গেজেট বাতিল করা হয় এবং ১০ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে গেজেট প্রকাশের নির্দেশ দেন। নির্বাচন কমিশন ২৭ এপ্রিল ইশরাক হোসেনকে ডিএসসিসির মেয়র ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করে। কিন্তু ডিএসসিসি এলাকার বাসিন্দা মামুনুর রশীদ ১৪ মে হাইকোর্টে রিট করে ট্রাইব্যুনালের রায় ও নির্বাচন কমিশনের গেজেটের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেন। এরপর ইশরাক হোসেনের সমর্থকরা নগর ভবন অবরোধসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন এবং তাকে ডিএসসিসির মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানোর দাবিতে গত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে আন্দোলন করছেন। স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া সম্প্রতি ফেসবুকে লিখেছেন, মেয়াদ সংক্রান্ত জটিলতা দেখা দিয়েছে। ফলে ইশরাক হোসেন কতদিন মেয়র থাকবেন বা আদৌ মেয়াদ আছে কি না, তা স্পষ্ট নয়।

শপথ নিয়ে জটিলতা কেন?

প্রশ্ন হলো, ইশরাক হোসেনের শপথ নিয়ে কেন এই জটিলতা? এর উত্তর তিনি নিজেই দিয়েছেন। গত ২১ মে রাতে কাকরাইল মসজিদ মোড়ে সমর্থক ও অনুসারীদের অবস্থান কর্মসূচিতে গিয়ে তিনি বলেন, 'অনেকেই হয়তো মনে করতে পারেন ঢাকায় নেতাকর্মীদের অবস্থান কর্মসূচি শুধু একজন ব্যক্তিকে মেয়রের পদে বসানোর জন্য। কিন্তু আসলে তা নয়। এই আন্দোলন কোনো এক ব্যক্তির ক্ষমতা বা কোনো একটি পদের জন্য লড়াই নয়। আজকের এই লড়াই নির্ধারণ করে দেবে যে এই বছর ডিসেম্বর মাসের মধ্যে আমরা আদৌ একটি নির্বাচন দেখতে পাব কি না। যেখানে দেশের জনগণ ভোটদানের মাধ্যমে একটি জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা হবে এটি সেই আন্দোলন।' তার মানে এখানে বিষয়টা খুব পরিষ্কার যে, প্রশ্নটা শুধু ইশরাকের শপথ কিংবা তার মেয়াদকাল নয়। প্রশ্ন জাতীয় নির্বাচনের এবং এই ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে বিএনপির যে টানাপোড়েন—তারই বহিঃপ্রকাশ।

দ্বিতীয়ত, অনেকে আদালতের ও গেজেট হওয়ার পরেও ইশরাকের শপথ আটকে যাওয়ার বিষয়টিকে স্থানীয় সরকার আসিফ উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের 'ব্যক্তিগত ইগো' বলেও মনে করেন। সেইসঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ায় জাতীয় নাগরিক পার্টির একাধিক নেতা ইশরাকের বিষয়টি নিয়ে যেসব মন্তব্য করেছেন—তাতে মনে হয়েছে এনসিপিও মেয়র হিসেবে ইশরাকের শপথের বিরোধী। সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির সঙ্গে এনসিপি যে দূরত্ব বা বিরোধ প্রকাশ্য হলো, ইশরাকের ঘটনাটি তারই বাইপ্রোডাক্ট কি না—সে প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

তৃতীয়ত, সরকার প্রধান যতই বলছেন যে আগামী ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে এবং সম্প্রতি তার প্রেস সচিবও যেখানে বললেন যে, আগামী বছরের ৩০ জুনের পরে ড. ইউনূস আর একদিনের জন্যও ক্ষমতায় থাকবেন না—তারপরও ওই সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টি নিয়ে বিএনপি এবং আরও কিছু রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে অনাস্থা ও অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে; এই ইস্যুতে একদিকে সরকার ও এনসিপি, অন্যদিকে বিএনপির শক্ত অবস্থানের কারণে রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেভাবে ক্রমশ জটিল হচ্ছে এবং ধীরে ধীরে রাজনীতি সংঘাতের দিকে যেতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, ফলে ইশরাকের শপথের বিষয়টি নানা কৌশলে আটকে রাখার চেষ্টা হচ্ছে কি না, সেই প্রশ্নও জনমনে রয়েছে।

শপথ নিলে কী হবে?

১. ইশরাক যদি শপথ নিয়ে মেয়র হিসেবে চেয়ারে বসতে পারেন, তাহলে ফজলে নূর তাপসের জয়কে অবৈধ এবং নিজের জয়কে আইনত বৈধ করার চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জিত হবে। ওই নির্বাচনের যে কারচুপি হয়েছিল, ভোটচুরি হয়েছিল সে বিষয়ে আদালত রায় দিলেও ইশরাক যতক্ষণ না শপথ নিচ্ছেন, ততক্ষণ ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হবে না।

২. ইশরাক ও তার সমর্থকরা মনে করেন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যও ইশরাককে শপথ পড়ানো জরুরি। কেননা ইশরাক হোসেন আদালতের রায়কে ন্যায়বিচারের বিজয় হিসেবে দেখছেন। তার ভাষায়: 'আমরা ন্যায়বিচার পেয়েছি, এটা হলো মূল বিজয়'। অর্থাৎ শপথ গ্রহণের মাধ্যমে তিনি এই ন্যায়বিচারকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান।

৩. ইশরাক বলেছেন, তিনি শপথ নেবেন কি না, তা সম্পূর্ণ দলীয় সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। এটি দলীয় শৃঙ্খলা ও ঐক্যের প্রতি তার প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করে। উপরন্তু ইশরাককে শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে এই বার্তাটি ছড়িয়ে পড়তে পারে যে, নির্বাচন ও গণতন্ত্রের প্রতি জনগণের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

পরিশেষে, মেয়র হিসেবে শপথ নিলে ইশরাক কি সত্যিই দুই-চারদিনের বেশি দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না, নাকি শপথ গ্রহণের পর থেকে পরবর্তী পাঁচ বছর যাতে তিনি মেয়র পদে থাকতে পারেন, এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে রিট করবেন এবং সেই ইস্যুটা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আরেক ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন তথা বিএনপির রাজনীতি ঢুকে যাবে? যেহেতু বিদায়ী মেয়র ফজলে নূর তাপসের মেয়াদ ছিল ১ জুন পর্যন্ত, ফলে আন্দোলন ও আদালতের জটিলতাগুলো ১ জুনের মধ্যে সুরাহা না হলে এই ইস্যুতে কথা বলার আর কোনো সুযোগ থাকবে কি না—সেটিও ভাবনার বিষয়।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক

Comments

The Daily Star  | English
Barishal University protest

As a nation, we are not focused on education

We have had so many reform commissions, but none on education, reflecting our own sense of priority.

5h ago