এআই ও শিক্ষার সংকট: চিন্তার সহজ বিকল্পে কি জ্ঞান হারিয়ে যাচ্ছে?

প্রতীকী ছবি | সংগৃহীত

আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের উপহার দিয়েছে অসাধারণ এক অর্জন –আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কিংবা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, যা সংক্ষেপে 'এআই' নাম পরিচিত। চ্যাটজিপিটির মতো শক্তিশালী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেল মুহূর্তের মধ্যে রচনা লিখে দিতে পারে, জটিল প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দিতে পারে, কিংবা বিশাল তথ্যভাণ্ডার ছেঁকে আমাদের চমকে দিতে পারে। বিশ্বজুড়ে তাই এই নতুন প্রযুক্তিকে ঘিরে বিস্ময় ও উৎসাহের অন্ত নেই। অনেকেই ভাবছেন, এত যখন পারছে, একদিন বুঝি মানুষের মস্তিষ্ককেও টেক্কা দেবে! কিন্তু প্রশ্ন ওঠে—কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি সত্যিই মানব চিন্তার বিকল্প হতে পারে?

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিঃসন্দেহে বৈপ্লবিক এক বৈজ্ঞানিক সাফল্য এবং মানবজাতির জন্য শক্তিশালী এক হাতিয়ার। তথ্য বিশ্লেষণ থেকে শুরু করে নানা নির্দিষ্ট কাজ স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন করা—বহু ক্ষেত্রেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অভাবনীয় দক্ষতা দেখাচ্ছে। তারপরও, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানব চিন্তার প্রকৃত বিকল্প হতে পারে—এমন ধারণা বাস্তবসম্মত নয়। মানুষের মস্তিষ্ক শুধু তথ্য প্রক্রিয়াকরণ করে না; সৃজনশীলতা, কৌতূহল, অনুভূতি ও নৈতিক বিবেচনা মানুষের চিন্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ—এগুলো কোনো যান্ত্রিক প্রজ্ঞায় খুঁজে পাওয়া যায় না।

বিশেষ করে শিক্ষা, উদ্ভাবন ও গবেষণার ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে দেখা উচিত সহায়ক উপকরণ হিসেবে, মানবিক সমালোচনামূলক চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলনের বিকল্প হিসেবে নয়। উদাহরণস্বরূপ, গবেষণায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিপুল তথ্য দ্রুত বিশ্লেষণ করতে বা শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় তথ্যসূত্র খুঁজে পেতে সহায়তা করতে পারে। কিন্তু নতুন তত্ত্ব গঠন করা, গভীরভাবে কোনো বিষয় অনুধাবন করা বা নৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো সৃজনশীল ও চিন্তাশীল কাজগুলো শেষ পর্যন্ত মানুষকেই করতে হয়। মৌলিক চিন্তার যে স্ফুরণ কিংবা সত্যিকারের উদ্ভাবনের যে অন্তর্দৃষ্টি, তা কেবল মনোনিবেশী মানব মস্তিষ্ক থেকেই আসে।

তবে সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, আজকাল অনেক ক্ষেত্রেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, যেন এটি মানবিক অধ্যয়ন, গভীর পাঠচর্চা ও চিন্তাশীলতার বিকল্প হতে পারে। এভাবে শর্টকাটে সবকিছু হাতের মুঠোয় পাওয়ার সহজ রাস্তা দেখানো হলে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত শেখার অভ্যাসে বাধা সৃষ্টি হয়। তারা পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তু বুঝে পড়ার পরিবর্তে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে যন্ত্রনির্ভর সারাংশ ও সম্ভাব্য প্রশ্নোত্তরের ওপর। এতে জ্ঞানের যে গভীরতা, আত্মস্থ করার যে প্রক্রিয়া এবং চিন্তার যে বিকাশ—তা থেমে যেতে বাধ্য। ছাত্ররা ধীরে ধীরে নিজেরা আর প্রশ্ন করতে শেখে না, বিশ্লেষণ করে না, বরং কৃত্রিমভাবে প্রস্তুত 'উত্তর' গ্রহণ করাকেই শিক্ষার চূড়ান্ত ধাপ বলে মনে করে। এই প্রবণতা যদি বাড়তে থাকে, তবে ভবিষ্যতের প্রজন্ম হয়ে উঠবে তথ্যগ্রাহী, কিন্তু চিন্তাশীল নয়—যা এক সময় আমাদের সমাজ ও শিক্ষাব্যবস্থার মেরুদণ্ডকে হুমকির মুখে ফেলবে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর এই ধরনের অতিরিক্ত ভরসা করে শিক্ষার্থীরা হয়তো পরীক্ষায় দ্রুত ভালো ফল পেতে পারে। কিন্তু এর দীর্ঘমেয়াদি পরিণতি কী? আমরা যদি এভাবে তাদের সবকিছু চটজলদি মুখে তুলে দিই, তবে হয়তো এমন এক প্রজন্ম গড়ে উঠবে যারা পরীক্ষায় নম্বর আদায় করতে পারদর্শী, কিন্তু স্বাধীন চিন্তাশক্তি, সৃজনশীলতা, সহমর্মিতা এবং প্রকৃত জ্ঞান-প্রজ্ঞায় পিছিয়ে থাকবে। শিক্ষার লক্ষ্য কি কেবল সনদে এ-প্লাস পাওয়া, নাকি জ্ঞানপিপাসু, উদ্ভাবনী ও নীতিবোধসম্পন্ন মানুষ তৈরি করা? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-নির্ভর এই শর্টকাট পদ্ধতি যদি শিক্ষার্থীদের মৌলিক চিন্তার অনুশীলন কমিয়ে দেয়, তবে তারা আপাতদৃষ্টিতে সফল হলেও অন্তরে একধরনের শূন্যতা থেকে যাবে।

কারণ সত্যিকার জ্ঞান মানে শুধু মুখস্থ তথ্য বা পরীক্ষায় ভালো ফল পাওয়া নয়। শেখার প্রতি ভালোবাসা, জিজ্ঞাসু মন, অন্যের প্রতি সহমর্মিতা, নতুন কিছু সৃষ্টির উদ্দীপনা এবং নৈতিক সচেতনতা—এই সব গুণ মিলেই জ্ঞানকে সত্যিকার অর্থে অর্থবহ করে তোলে। এই গুণগুলো কোনো যান্ত্রিক প্রোগ্রামে বিকশিত হয় না; কেবল মানব মস্তিষ্কেই এগুলো প্রস্ফুটিত হতে পারে। পাঠ্যবইয়ের পাতা হোক বা জীবন-বিদ্যালয়, শেখার আনন্দ এবং মানবিক মূল্যবোধের বিকাশের কাজটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কখনোই করতে পারবে না—সেটি শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের হৃদয়েই লালিত হতে হবে।

এখানেও মনে রাখা জরুরি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিজে থেকে জন্ম নেয়নি; এর পেছনে রয়েছে মানুষের সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী মস্তিষ্কের কর্মযজ্ঞ। চ্যাটজিপিটির মতো জটিল প্রযুক্তি উন্নয়ন করেছেন মানুষের দল, নিজেদের কল্পনা, গবেষণা আর পরিশ্রম দিয়ে। অর্থাৎ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও মানব প্রতিভার সৃষ্টিফল। সুতরাং স্রষ্টার চেয়ে সৃষ্টির মেধা বড় হওয়া কি সম্ভব? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা, বিশেষ করে কিশোর শিক্ষার্থীদের সক্রিয় চিন্তক হিসেবে গড়ে তোলার বদলে নিষ্ক্রিয় তথ্য-ভোক্তায় পরিণত করার ঝুঁকি নিয়ে আসে। আমরা চাই নতুন প্রজন্ম প্রযুক্তির সুফল নিক, তবে সঙ্গে সঙ্গে তাদের নিজের চিন্তাশক্তি ও অনুসন্ধানের ক্ষমতাও গড়ে উঠুক। যদি সব উত্তর সহজেই প্রস্তুত অবস্থায় সামনে হাজির হয়ে যায়, তাহলে প্রশ্ন করার, গভীরে যাওয়ার বা নিজে কিছু আবিষ্কার করার প্রবণতাটাই ধীরে ধীরে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়বে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যতই যুগান্তকারী হোক, তা মানব চিন্তার বিকল্প হতে পারে না। বিশেষ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থাকুক সহায়ক হাতিয়ার হিসেবে, শিক্ষার্থীর মস্তিষ্কের জায়গায় নয়। শিক্ষার্থীদের সত্যিকার জ্ঞানচর্চা নিশ্চিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব। তাই শিক্ষক, অভিভাবক ও পরামর্শদাতাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়ার সময়ে অত্যন্ত সতর্ক হতে হবে। চটজলদি সুবিধার মোহে শিক্ষার্থীদের এমন শর্টকাট পথ দেখানো উচিত নয়, যা তাদের শেখার স্বাভাবিক বিকাশকে ব্যাহত করে। মনে রাখতে হবে, আজকের শিক্ষার্থীরাই আগামীর সমাজ-নির্মাতা। সুতরাং প্রযুক্তির গণ্ডির মধ্যে তাদের মনকে আবদ্ধ না রেখে সৃজনশীল চিন্তার পরিপূর্ণ বিকাশে সহযোগিতা করা আমাদের কর্তব্য। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থাকুক জ্ঞানার্জনের সহায়ক হিসেবে। কিন্তু চিন্তার লাগাম অবশ্যই মানুষের হাতে থাকতে হবে। শিক্ষায় শর্টকাটের মোহে পড়ে যদি আমরা একটি প্রজন্মের চিন্তাশক্তিকে বিকল করে দিই, তা হবে শিক্ষাব্যবস্থা ও মানবসমাজের জন্য এক মহাবিপর্যয়।

এম এ আরেফিন আশরাফ: ব্যারিস্টার, কোর্টস অব ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস

Comments

The Daily Star  | English

Yunus leaves for UK on four-day official visit

The two countries are working to renew their bilateral ties, with an increased focus on economic cooperation, trade and investment

21m ago