ঔষধি গাছ: বাংলাদেশের সবুজ অর্থনীতি ও স্বাস্থ্যশিল্পের এক নতুন দিগন্ত

বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদে এক সময় প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় ঔষধি গাছের উপস্থিতি ছিল এক পরিচিত দৃশ্য। কারো ঠাণ্ডা-কাশি হলে বাসক পাতা সেদ্ধ, কারো হজমে সমস্যা হলে তুলসী। আবার রক্তচাপ বাড়লে অর্জুনের ছাল। এসব ছিল ঘরোয়া চিকিৎসার অমূল্য ভাণ্ডার। এই গাছগুলো শুধু রোগ প্রতিকারের উপকরণ ছিল না, বরং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চিত স্থানীয় জ্ঞানের এক বহমান ধারা। কিন্তু আধুনিক ওষুধ শিল্প, শহুরে চিকিৎসা, ফার্মাসিউটিক্যাল বিপ্লবের ফলে বায়োমেডিকেল চিকিৎসার একক আধিপত্য, কৃষিতে একমুখী ফসল নির্ভরতা ও বাণিজ্যিকতার চাপে এই ঐতিহ্য আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।
বর্তমানে চিকিৎসা বলতে মানুষ শুধু প্যাকেটবন্দি ট্যাবলেটকেই বোঝে। অথচ, যেসব রসায়ন ও রাসায়নিক উপাদান দিয়ে আধুনিক ওষুধ তৈরি হয়, তার বহু উপাদানের উৎসই প্রাকৃতিক গাছপালা। উদাহরণস্বরূপ, পেইনকিলার হিসেবে ব্যবহৃত অ্যাসপিরিন এসেছে উইলো গাছ থেকে; ক্যানসার চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ভিনক্রিস্টিন পাওয়া যায় 'মাদাগাস্কার পেরিউইঙ্কল' নামক এক ধরনের ফুল থেকে।
তবে আশার কথা, বিশ্ব এখন আবার প্রাকৃতিক চিকিৎসার দিকে ফিরছে। হারবাল ওষুধের প্রতি মানুষের আগ্রহ, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ও পরিবেশবান্ধব চিকিৎসার চাহিদা নতুন করে আলোচনায় এনেছে ঔষধি গাছভিত্তিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও শিল্পের সম্ভাবনা। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জন্য তৈরি হয়েছে এক বড় সম্ভাবনার জানালা—স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও পরিবেশকে একসঙ্গে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ।
বাংলাদেশের ঔষধি গাছ: সম্পদের ভাণ্ডার
বাংলাদেশে প্রায় ৫০০ প্রজাতির ঔষধি উদ্ভিদ পাওয়া যায়। এর মধ্যে ১০০টিরও বেশি উদ্ভিদ নিয়মিতভাবে ইউনানি, আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। চট্টগ্রাম, সিলেট, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সুন্দরবন ও মধ্যাঞ্চলের বনাঞ্চল এই উদ্ভিদগুলোর প্রাকৃতিক আবাসস্থল। আদিবাসী জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে গারো, সাঁওতাল, খাসিয়া, চাকমা ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই উদ্ভিদজ্ঞান এখনো জীবন্ত। তবে বনাঞ্চল সংকুচিত হওয়ায় এবং প্রজন্মান্তরের জ্ঞান সংরক্ষণের উদ্যোগ না থাকায় এ সম্পদ এখন হুমকির মুখে।
বিশ্ববাজারে হারবাল পণ্যের উল্লম্ফন: বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়?
বর্তমানে বৈশ্বিক হারবাল ওষুধের বাজার প্রায় ৫৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের। ২০২৮ সালের মধ্যে এ বাজার প্রায় ৮০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চীন, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম এরই মধ্যে এই বাজারে সক্রিয়। চীন তাদের ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রীয় নীতি ও বাণিজ্যের অংশ করেছে। ভারতও আয়ুর্বেদ, যোগ, ইউনানি, সিদ্ধ ও হোমিওপ্যাথিকে আন্তর্জাতিক মানে তুলে ধরছে। ভারতের আয়ুর্বেদ, চীনের টিসিএম (ট্র্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন), দক্ষিণ কোরিয়ার হানবাং চিকিৎসা পদ্ধতি—সবগুলোই নিজ নিজ ঐতিহ্য ও ঔষধি গাছের ওপর নির্ভর করে বহু বিলিয়ন ডলারের বাজার গড়ে তুলেছে।
বাংলাদেশের বাস্তবতা হলো এখানে ঔষধি গাছের প্রাপ্যতা আছে। কিন্তু এ শিল্পে বিনিয়োগ নেই। অন্তত ১০০টির বেশি ঔষধি গাছের কার্যকারিতা নিয়ে দেশের বিভিন্ন গবেষণাগারে কাজ হয়েছে। ইউনানি, আয়ুর্বেদ ও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা ব্যবস্থায় এসব গাছ ব্যবহার হয় নিয়মিত। বেশ কিছু কোম্পানি যেমন হামদর্দ, সেন্ট্রাল হোমিও, কেয়া কসমেটিকস ও ইউনানি ল্যাবরেটরি ইতোমধ্যেই এই খাতে সক্রিয়। দেশীয় বাজারে আয়ুর্বেদ ও হারবাল ওষুধের মোট বাজার প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার। এর বেশিরভাগ কাঁচামাল এখনো ভারত, চীন কিংবা নেপাল থেকে আমদানি করা হয়। অথচ চাহিদা রয়েছে, ক্রেতা রয়েছে এবং যথেষ্ট কাঁচামাল দেশের ভেতরেই চাষ করা সম্ভব। তবে বড় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো এ খাতে এখনো প্রবেশ করেনি। এ নিয়ে গবেষণাও প্রান্তি পর্যায়ে। অথচ আমাদের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য, স্থানীয় জ্ঞান এবং কম খরচের উৎপাদন সক্ষমতা এই বাজারে প্রবেশের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। আমরা যদি এখনই উদ্যোগ নেই, তবে হারবাল ওষুধ ও প্রসাধনী রপ্তানিতে বড় ধরনের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।
ওষুধ শিল্পে গাছভিত্তিক চিকিৎসার সম্ভাবনা
বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যতম শক্তিশালী। বর্তমানে প্রায় ৯৮ শতাংশ ওষুধ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয় এবং ১৫০টিরও বেশি দেশে এগুলো রপ্তানিও হয়। কিন্তু এই সাফল্যের মধ্যেও হারবাল ওষুধ বা প্লান্ট-বেসড মেডিসিন এখনো মূলধারায় নেই। কিছু ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক প্রতিষ্ঠান পণ্য তৈরি করলেও তা মূলত স্থানীয় বাজারে সীমাবদ্ধ। বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা, ক্লিনিকাল ট্রায়াল ও আন্তর্জাতিক মান নিয়ন্ত্রণের অভাবে এগুলো এখনো বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে।
অন্যদিকে বিশ্বের বড় বড় কোম্পানিগুলো উদ্ভিদের উপাদান বিশ্লেষণ করে নতুন ওষুধ তৈরি করছে। সেখানে বাংলাদেশে এ ধরনের গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়-শিল্প প্রতিষ্ঠান সমন্বয় নেই। জাতীয় পর্যায়ে 'প্লান্ট-বেসড ড্রাগ ডিসকভারি সেন্টার' প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নতুন ওষুধের সন্ধান, প্রমাণভিত্তিক ভেষজ চিকিৎসা উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক পেটেন্ট অর্জন সম্ভব।
কৃষি ও উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন সম্ভাবনার ক্ষেত্র
ঔষধি গাছ চাষ একদিকে যেমন পরিবেশবান্ধব, তেমনি এটি গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। অনেক গাছের ফলন তিন-চার মাসের মধ্যে হয় এবং রপ্তানিযোগ্য উপাদান সরবরাহ করা যায়। যেমন: তুলসী, বাসক, কালমেঘ, নিম, শতমূলি, অশ্বগন্ধা ইত্যাদি গাছ সহজে চাষযোগ্য এবং আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদাসম্পন্ন। এই খাতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো গেলে তা হবে নারী-নেতৃত্বাধীন সবুজ উদ্যোগের পথপ্রদর্শক। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং এনজিওদের যৌথভাবে ঔষধি গাছ চাষে প্রশিক্ষণ, বীজ সরবরাহ ও বাজার সংযোগে কাজ করতে হবে।
ঔষধি গাছভিত্তিক শিল্পায়ন: সম্ভাবনার বুনিয়াদ
অন্যান্য প্রচলিত ফসলের তুলনায় ঔষধি গাছ চাষে শুরুতে খরচ কিছুটা বেশি হলেও, একবার প্রতিষ্ঠিত হলে লাভের পরিমাণ অনেক বেশি হতে পারে। কিছু ঔষধি গাছের ফসল ঘনত্ব তুলনামূলকভাবে বেশি হওয়ায় কম জমিতেও ভালো ফলন পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ, অ্যালোভেরা, সর্পগন্ধা, বাসক বা তুলসীর মতো গাছগুলো ছোট পরিসরেও চাষ করে ভালো আয় করা সম্ভব। দীর্ঘমেয়াদি ফসল হওয়ায় একবার রোপণের পর বহু বছর ধরে ফলন পাওয়া যায়, যা কৃষকদের জন্য স্থিতিশীল আয়ের উৎস হতে পারে।
এই খাতে নারী উদ্যোক্তা ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। ছোট আকারে ঔষধি গাছের বাগান তৈরি, তা থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ, শুকানো ও প্রাথমিক প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে তারা স্বাবলম্বী হতে পারেন। গ্রামীণ নারীরা তাদের বাড়ির আঙিনায় বা পতিত জমিতে ঔষধি গাছ চাষ করে বাড়তি আয় করতে পারেন।
এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড এবং বিভিন্ন এনজিওগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তারা কৃষকদের প্রশিক্ষণ, উন্নত জাতের বীজ সরবরাহ, প্রযুক্তিগত সহায়তা ও বাজারজাতকরণে সহযোগিতা দিতে পারে। বিশেষ করে, চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদ ও প্রক্রিয়াকরণ শিল্পগুলোর সঙ্গে কৃষকদের সংযোগ স্থাপন করে একটি শক্তিশালী সরবরাহ শৃঙ্খল তৈরি করা জরুরি। এর ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন গতি আসবে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
যদি পরিকল্পিতভাবে ঔষধি গাছের চাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং গবেষণা শুরু করা হয়, তাহলে বাংলাদেশে নতুন একটি 'গ্রিন ফার্মাসিউটিক্যাল' খাত গড়ে উঠতে পারে। এতে অন্তত তিনটি দিক থেকে সুফল আসবে: কৃষকদের জন্য বিকল্প আয়ের উৎস, রপ্তানিযোগ্য পণ্য ও গ্রামীণ শিল্পের বিকাশ। ধান, পাট বা সবজির তুলনায় অনেক ঔষধি গাছ তুলনামূলকভাবে কম পরিচর্যায় চাষ করা যায় এবং অধিক দামে বিক্রি করা সম্ভব। যেমন: কালমেঘ, অশ্বগন্ধা, তুলসী, অর্জুন গাছ, আমলকী—সবগুলোই চাষযোগ্য ও উচ্চমূল্যের গাছ। অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী হারবাল কসমেটিকস, হেলথ সাপ্লিমেন্ট, ও ট্র্যাডিশনাল মেডিসিন পণ্যের বাজার দ্রুত বাড়ছে। বাংলাদেশেও সঠিক মান অনুযায়ী ঔষধি পণ্য প্রস্তুত করে রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব। আর ঔষধি গাছভিত্তিক প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্যাকেজিং, মান নিয়ন্ত্রণ ও রিসার্চ—সবকিছু মিলে একটি বিকেন্দ্রীকৃত গ্রামীণ শিল্প খাত তৈরি করা সম্ভব।
ঐতিহ্যগত জ্ঞান ও ন্যায্যতা সংরক্ষণ
বাংলাদেশের আদিবাসী ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে হাজার বছরের পুরোনো ভেষজ জ্ঞান এক অমূল্য সম্পদ। এই ঐতিহ্যবাহী জ্ঞানকে সঠিকভাবে নথিকরণ করা অত্যন্ত জরুরি। এটি কেবল বিলুপ্তির হাত থেকে জ্ঞানকে রক্ষা করবে না, বরং এর বৈজ্ঞানিক যাচাই-বাছাই ও আধুনিক ওষুধ শিল্পে ব্যবহারের পথও সুগম করবে। এই জ্ঞানের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বায়োপাইরেসি প্রতিরোধে কঠোর আইন ও নীতির প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। বিদেশি বা দেশি কোনো প্রতিষ্ঠান যেন এই ঐতিহ্যগত জ্ঞানকে বিনামূল্যে বা অন্যায়ভাবে ব্যবহার করে বাণিজ্যিক লাভ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো জ্ঞান ও সম্পদের ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত করা। অর্থাৎ, যদি এই ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান ব্যবহার করে কোনো বাণিজ্যিক পণ্য তৈরি হয়, তবে তার থেকে প্রাপ্ত লাভের একটি অংশ অবশ্যই সেই আদিবাসী বা গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে ফিরিয়ে দিতে হবে, যারা এই জ্ঞানের ধারক ও বাহক। এটি তাদের অধিকারের স্বীকৃতি দেবে এবং ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান সংরক্ষণে উৎসাহিত করবে।
আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও গ্রামীণ জনগণের ভেষজ চিকিৎসাজ্ঞান পণ্যে রূপান্তরের পথে নানা জটিলতা রয়েছে। 'বায়োপাইরেসি' বা জৈবচুরির ঝুঁকি থাকায় স্থানীয় জনগণের অনুমতি ও অংশীদারত্ব নিশ্চিত করা জরুরি। জাতিসংঘের নাগোয়া প্রটোকল অনুযায়ী, স্থানীয় সম্পদ ব্যবহার করলে তাদের 'অ্যাক্সেস অ্যান্ড শেয়ারিং'-এর ভিত্তিতে লাভের অংশ দিতে হয়। বাংলাদেশ এখনো এই চুক্তি পুরোপুরি কার্যকর করেনি। ফলে বহুজাতিক কোম্পানিরা স্থানীয় সম্পদ নিয়ে গবেষণা করলেও, তাতে স্থানীয় জনগণের লাভ হয় না।
কী করণীয়? নীতিগত প্রস্তাবনা
বাংলাদেশে এখনো ঔষধি গাছভিত্তিক কোনো জাতীয় নীতি নেই। 'ন্যাশনাল হারবাল মেডিসিন পলিসি' তৈরি করে চাষ, গবেষণা ও শিল্পায়নের রূপরেখা নির্ধারণ করতে হবে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই গাছগুলোর বায়োঅ্যাক্টিভ উপাদান চিহ্নিতকরণ, নিরাপত্তা যাচাই এবং ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালানোর মতো ল্যাব ও তহবিল গঠন করে বিনিয়োগ করতে হবে। এছাড়া স্থানীয় কবিরাজ, গারো, সাঁওতাল, চাকমা বা মারমা সম্প্রদায়ের মতো আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ঔষধি জ্ঞান সংগ্রহ করে একটি ন্যাশনাল ইনভেন্টরি বা ডিজিটাল আর্কাইভ তৈরি করা জরুরি। কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নির্দিষ্ট অঞ্চলে ঔষধি গাছ চাষে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমেই এটি সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে কিছু সতর্কতাও জরুরি। অনিয়ন্ত্রিত ও অবৈজ্ঞানিক হারবাল পণ্যের বিজ্ঞাপন বন্ধ করতে হবে। সব হারবাল ওষুধকে রেজিস্ট্রেশনের আওতায় আনতে হবে এবং মান নিয়ন্ত্রণে ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের একটি আলাদা সেল গঠন করতে হবে।
বাংলাদেশের ঔষধি গাছের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য। এর প্রথম ধাপ হলো একটি সুসংহত মেডিসিনাল প্লান্টস পলিসি বা গ্রিন ফার্মা ভিশন ২০৪০ প্রণয়ন করা। এই নীতিতে ঔষধি গাছের চাষাবাদ, সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, গবেষণা, মান নিয়ন্ত্রণ ও বাজারজাতকরণের সব দিক অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
দ্বিতীয়ত, এই খাতে গবেষণা ও উন্নয়নে সরকারি বরাদ্দ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করতে হবে। আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে ঔষধি গাছের গুণাগুণ যাচাই, নতুন ভেষজ ফর্মুলেশন তৈরি এবং ক্লিনিকাল ট্রায়াল পরিচালনার জন্য এই বিনিয়োগ অপরিহার্য।
তৃতীয়ত, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের মাধ্যমে প্লান্ট-বেসড পণ্যের উন্নয়ন ও উৎপাদনে জোর দিতে হবে। এতে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ও দক্ষতা কাজে লাগানো যাবে।
চতুর্থত, বিশ্বমানের গবেষণা ও পরীক্ষাগার গড়ে তুলতে হবে। বিশ্বমানের ল্যাবরেটরি ও টেস্টিং সুবিধা গড়ে তুলতে পারলে দেশের পণ্যগুলো আন্তর্জাতিক মানদণ্ড (জিএমপি, আইএসও, এফডিএ) অনুযায়ী নিশ্চিত হবে।
পঞ্চমত, প্রান্তিক জনগণের জ্ঞান ও অধিকার সংরক্ষণের জন্য নীতি ও আইন প্রণয়ন করতে হবে।
ষষ্ঠত, ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ব্যবস্থার মানোন্নয়ন ও আধুনিকীকরণ করতে হবে। এই পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশের ঔষধি গাছ শিল্পকে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে এবং দেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে।
সবুজ স্বপ্নের পথে
ঔষধি গাছ শুধু রোগের প্রতিকার নয়, এটি আমাদের স্বাস্থ্যসেবা, পরিবেশ সংরক্ষণ ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার রক্ষার একটি বিকল্প পথ। এখনই সময় হারানো ঐতিহ্যকে বিজ্ঞানের আলোয় ফিরিয়ে আনার। কেননা বাংলাদেশের ঔষধি গাছ একদিকে যেমন স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিকল্প পথ হতে পারে, তেমনি এটি হতে পারে সবুজ অর্থনীতির চালিকা শক্তি। উন্নত বিশ্বের মানুষ যখন প্রাকৃতিক চিকিৎসার দিকে ঝুঁকছে, তখন আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যই হতে পারে নতুন উন্নয়নের ভিত্তি। এজন্য দরকার বিজ্ঞান, নীতি, ঐতিহ্য ও বাজারকে একই প্ল্যাটফর্মে আনা। আমরা যদি এখনই উদ্যোগ না নেই, তবে একদিকে যেমন এই ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে, তেমনি একটি সম্ভাবনাময় শিল্পও আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যাবে। সময় এসেছে, বাংলাদেশ যেন ঔষধি গাছকে ওষুধশিল্পের মূলধারায় তুলে এনে দেশের অর্থনীতি, স্বাস্থ্য ও পরিবেশকে একসঙ্গে শক্তিশালী করে।
মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম: জনস্বাস্থ্য ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ এবং ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগের সিনিয়র লেকচারার।
Comments